কান ছুঁয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় সহানুভূতিতে ভেসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার জয় প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করছে আবিশ্ব। এতে বিশেষ খুশি হতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তবে এ-ও ঠিক, আপাদমস্তক ব্যবসায়ী ট্রাম্পের আমেরিকার সঙ্গে নতুন করে সমীকরণও সাজাতে হবে ভারতকে। লিখলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
গুলি কান ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় এখন অনেকের ধারণা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) আরও একবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। জো বাইডেনের (Joe Biden) জনপ্রিয়তার লেখচিত্র কিছু ভুল ও অগোছালো কথাবার্তার দরুন এমনিতেই নিম্নমুখী। বিতর্ক সভায় তাঁকে টেক্কা দিয়েছেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রার্থী হিসাবে বাইডেনকে বদলানোর একটা মৃদু দাবিও উঠেছে। সেসবের মোকাবিলা শেষ পর্যন্ত করতে পারলেও পেনসিলভেনিয়ার হামলা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে পাল্লাটা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে।
পুত্র এরিকের পোস্ট করা রক্তাক্ত বাবার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ছবি শুধু ভাইরালই হয়নি, ছবির সঙ্গে তঁার মন্তব্য, ‘আমেরিকার এই ধরনের যোদ্ধারই প্রয়োজন’ ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার গ্রাফ চড়িয়ে দিয়েছে। নভেম্বরের মহারণ পর্যন্ত তা ধরে রাখা গেলে যুক্তরাষ্ট্রের (US) ইতিহাসে ১৩২ বছর পর তিনিই হবেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি দ্বিতীয় দফায় হেরে তৃতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হবেন। ২২তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ১৮৮৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৮৮৮ সালে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু চার বছর পর ১৮৯২ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন এই ডেমোক্র্যাট। ট্রাম্প জিতলে রিপাবলিকানদের মধ্যে তিনিই হবেন প্রথম এবং সেক্ষেত্রে বড় ভূমিকা থাকবে এই গুলি-কাহিনির।
[আরও পড়ুন: মাসে ১০ হাজার! ভোটমুখী মহারাষ্ট্রে পুরুষদের জন্য ‘লাডলা ভাই’ প্রকল্পের ঘোষণা শিণ্ডের]
আমেরিকায় গুলি-কাহিনি অবশ্য জলভাত। ১৮৬৫ সালে অাব্রাহাম লিঙ্কনের পর আরও তিন প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড (১৮৮১), উইলিয়াম ম্যাকিনলে (১৯০১) ও জন এফ. কেনেডি (১৯৬৩) গুলিতে নিহত হয়েছেন। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রবার্ট এফ. কেনেডির দশাও তেমনই হয়েছিল। হত্যা-চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় প্রাণে বেঁচেছেন আরও পঁাচ প্রেসিডেন্ট, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট, জেরাল্ড ফোর্ড, রোনাল্ড রেগান, বিল ক্লিন্টন ও জর্জ ডব্লিউ বুশ। বুশকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল জর্জিয়ার টিবিলিসি-তে। জনসভায় তঁাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়েছিল গ্রেনেড। ফাটেনি। ক্লিন্টন-হত্যার চেষ্টা হয়েছে বহুবার। তিনিও ভাগ্যবান। প্রতিটিই ব্যর্থ।
রেগান শেষ প্রেসিডেন্ট যিনি গুলিবিদ্ধ হয়েও মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। ট্রাম্প ভাগ্যের সহায়তা পাওয়ার পর রেগানের অভিনেত্রী কন্যা সুলেখিকা প্যাটি ডেভিস ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় এক নিবন্ধে ১৯৮১ সালের ৩০ মার্চ তঁার মানসিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। রোনাল্ড রেগান সেদিনই ওয়াশিংটন ডিসিতে এক অনুষ্ঠানে ভাষণের পর গাড়ির দিকে এগনোর সময় গুলিবিদ্ধ হন। গুলি আটকেছিল বঁা-কঁাধে। পঁাজরের হাড় ভেঙেছিল। দু’-সপ্তাহ যমে-মানুষে টানাটানির পর তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন।
[আরও পড়ুন: দিল্লিতে ছিঁড়ল জোটের সুতো, আপকে ‘পথ দেখিয়ে’ বিধানসভায় একা লড়ার ঘোষণা কংগ্রেসের]
প্যাটি ডেভিস লিখেছেন, “হাসপাতালের বিছানায় শোয়া বাবার চেহারা ছিল ফ্যাকাসে। চোখ দুটো খোলা কিন্তু দৃষ্টি যেন বহু দূরে কোথাও। গোটা দেশ ঝিম মেরে ছিল ক’টা দিন। কিছু দিনের জন্য রাজনীতি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছিল। গুলি চালানোর সময় ট্রাম্পের পরিবারের সবাই কে কোথায় ছিলেন জানি না। তবে তঁারা যে বিরাট ধাক্কা খেয়েছিলেন, তা অনুমান করতে পারি। সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেওয়ার জন্য একটা বুলেটই যথেষ্ট।” প্যাটি আরও লিখেছেন, ‘১৯৮১ সালের তুলনায় আমেরিকা এখন অনেক বেশি হিংস্র। ক্ষুব্ধ। এই ঘটনা সেই হিংস্রতা ও ক্ষোভ প্রশমনে সাহায্য করবে কি না জানি না। এ-ও জানি না, এই অভিজ্ঞতা ট্রাম্পকে বদলে দেবে কি না। দিলে কীভাবে তাও জানি না।’
এই কথাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার রোডস লিখেছেন একটু অন্যভাবে, ‘যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে ফিরে আসা ট্রাম্প তঁার সমর্থকদের উন্মত্ত ও উত্তেজিত করে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি ঝেড়ে ফেললে আমেরিকার সমাজ ও রাজনীতি ভিন্ন খাতে বইতে পারে। কিন্তু বিভাজনের রাজনীতি না বদলালে এই গুলিকাণ্ড আমেরিকার বিপজ্জনক সময়ের সূচনালগ্ন হয়ে উঠবে।’
রাজনৈতিক হত্যায় ভারতও পিছিয়ে নেই। গান্ধীজির পর গুলিতে ঝঁাজরা হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আত্মঘাতী বোমায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছাড়াও শিখ সন্ত্রাসবাদী, ইসলামি মৌলবাদী ও অতি-বাম সন্ত্রাসী আক্রমণে নিহত হয়েছেন ললিত নারায়ণ মিশ্র, লালা জগৎ নারায়ণ, সর্দার বিয়ন্ত সিং, বিদ্যাচরণ শুক্লা, ললিত মাকেন-সহ অগুনতি রাজনৈতিক নেতা। অকালি দলের সন্ত হরচঁাদ সিং লঙ্গোয়াল, কাশ্মীরের পিপল্স কনফারেন্স নেতা আবদুল গনি লোনেরাও সহিংসতার শিকার। ১৯৭০ সালের ৩১ মার্চ পাটনা রেল স্টেশনে আক্রান্ত হয়েছিলেন জ্যোতি বসু। হাতের কড়ে আঙুল ছুঁয়ে সেই গুলি প্রাণ কেড়েছিল দলের কমরেড ইমাম আলির। প্রতিটি হত্যাই রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বইয়ে দিয়েছে সহানুভূতির হাওয়া। সেই হাওয়ায় বদলে গিয়েছে রাজনীতির ক্যানভাস। কখনও সাময়িকভাবে, কখনও বা প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
ট্রাম্পও তেমন সহানুভূতিতে ভেসে দ্বিতীয়বার জিতলে অবশ্যই খুশিতে ডগমগ হবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দ্বিতীয় দফার ভোটের আগে যিনি টেক্সাসে ‘বন্ধু’-র হাত ধরে কূটনৈতিক শিষ্ঠাচারের ধার না ধেরে ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান দিয়েছিলেন, কে জানে এই গুলিকাণ্ডের পর তিনি ট্রাম্পের বিজয় উদ্যাপনের ছক আগাম কষে রাখছেন কি না!
ট্রাম্পকে মোদি সবসময় ‘প্রকৃত বন্ধু’ মনে করেছেন। ট্রাম্পও মোদিকে তাই মনে করেছেন। চার বছর বিরতির পর সেই বন্ধুর প্রত্যাবর্তনে মোদি যারপরনাই খুশি হবেন সন্দেহ নেই। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার কতটা প্রতিফলন ঘটবে এখনই বলা কঠিন। প্রথমবারের মতো ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ও ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’ নীতি কঠোরভাবে পালন করলে মোদির ভারতের কপালের ভঁাজ গাঢ় হবে।
আপাদমস্তক ব্যবসায়ী ট্রাম্প তঁার প্রথম শাসনে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি দেখে চিন্তান্বিত হয়েছিলেন। ঘাটতি মেটাতে চেষ্টায় ত্রুটি রাখেননি। অথচ, ২০১৮ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতির বহর বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালে যে-ঘাটতি ছিল ২০.৯ বিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪৫.৭ বিলিয়ন! নভেম্বরে জিতলে এই ঘাটতি মেটাতে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই ভারতের বাজারে আরও বেশি করে ঢোকার চেষ্টা চালাবেন। এত মাখামাখি সত্ত্বেও ২০১৯ সালে ট্রাম্প ‘জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্স’-এর (জিএসপি) সুবিধা ভারতের জন্য বাতিল করে দিয়েছিলেন। কারণ, ভারত চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানির উপর ‘প্রাইস ক্যাপ’ বসিয়েছিল। ট্রাম্পের সেই সিদ্ধান্তে মোদির ভারতের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল কারণ, জিএসপি-র অধীনে ভারত বছরে ৬ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য শুল্কহীন পণ্য যুক্তরাষ্ট্র পাঠাত।
মনে রাখতে হবে, শুল্কের কারণেই সেই বছর ট্রাম্প ভারতকে ‘শুল্কের রাজা’ বা ‘ট্যারিফ কিং’ বলে খোঁটা দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে বাণিজ্যের এই লড়াই এবং ভিসা-নীতির কড়াকড়ি ট্রাম্প নতুন উদ্যমে শুরু করলে মোদির চিন্তা বাড়বে বই কমবে না। জো বাইডেনের আমেরিকার সঙ্গে মোটামুটি যে বাণিজ্যিক ধারাবাহিকতা আছে, তা ঘেঁটে যেতে পারে।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বিশ্বে কী প্রভাব পড়তে পারে তার একটা সমীক্ষা করেছে ‘ইকোনমিক ইন্ট্যালিজেন্স ইউনিট’। নাম দিয়েছে ‘ট্রাম্প রিস্ক ইনডেক্স’। সেই অনুযায়ী ঝুঁকিতে পড়বে বাণিজ্য, নিরাপত্তা, অভিবাসন, সামরিক সহায়তার মতো বিষয়ে।
বাণিজ্য নিয়ে চিনের সঙ্গে রেষারেষি বাড়বে। এশিয়ায় অসুবিধায় পড়বে ভারত ও ভিয়েতনাম। সবচেয়ে চিন্তায় পড়বে মেক্সিকো, কোস্টা রিকা, জার্মানি, জাপান ও ইউক্রেন। বৈশ্বিক রাজনীতিতে দোলাচল বাড়বে।
অবশ্য মোদিকে স্বস্তিতে রাখবে সংখ্যালঘু নির্যাতন, মানবাধিকার হরণ ও গণতান্ত্রিক আবহের দ্রুত বিলুপ্তি সংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়গুলি, যা নিয়ে বাইডেন প্রশাসন চার বছর ধরে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করে চলেছে। ট্রাম্পের কাছে এসব বিষয় বরাবরই অর্থহীন। অতি দক্ষিণপন্থী হিসাবে তঁার পুনরুত্থান অতি-দক্ষিণপন্থী মোদিকে স্বস্তি দেবে। যদিও ভারত এখনও জানে না, বাইডেন প্রশাসনের আনা ‘পান্নুন হত্যা ষড়যন্ত্র’ অভিযোগের ভবিষ্যৎ ট্রাম্পের আমলে কোন রূপ নেবে। এটুকু বলা যায়, পালাবদল ঘটলে নরেন্দ্র মোদির ভারতকে নতুনভাবে ভারসাম্যের খেলায় নামতে হবে।