আফগানিস্তান এখনও রহস্যে মোড়া দেশ। এই আফগানিস্তানের মাটি থেকেই কত সুফি কবির জন্ম হয়েছে। আবার হিটলারি, দোনলা বন্দুকের মাধ্যমে পট-পরিবর্তনের ঐতিহ্যও এখনও চলছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়’ গ্রন্থে আফগানিস্তান নিয়ে ছিল সাংঘাতিক কিছু আশঙ্কা ও ভবিষ্যদ্বাণী। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’ বইটা নিয়ে আমরা সবসময় আলোচনা করি। কিন্তু হাতে এসে ঠেকল তাঁর সম্ভবত শেষ রচনাটি। সংকলনটির নাম ‘পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়’। এই বইটি ‘মিত্র ও ঘোষ’ প্রকাশ করেছিল ১৩৮০ সন বা ১৯৭৩ সাল নাগাদ। বইটির তখন দাম ছিল নয় টাকা। এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলি বাংলাদেশের ‘পূর্ব দেশ’ নামক সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। রচনার প্রথম ও প্রধান যে বক্তব্য, সেটি হল, রাজনীতিতে সর্বদা পুরাতনই পুনরাবৃত্ত হচ্ছে। সৈয়দ মুজতবা আলী বলছেন, যা আপাতদৃষ্টিতে পরিবর্তন বলে মনে হয়, আসলে তা পুরাতনেরই ‘বেশ’ পরিবর্তন। লেখক আফগানিস্তানের মতো দেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহাশক্তির রাজনীতির পর্যালোচনা করেছিলেন এবং তিনি বারবার বলেছিলেন যে, তালিবানি দেশে সরকার বদলায়, কিন্তু সন্ত্রাসবাদের চেহারা বদলাচ্ছে না। এই অপ্রচলিত বইটি থেকে কিছু অংশ আপনাদের জানাতে ইচ্ছা করছে।
লেখাটা শুরুই হয়েছে, আলী এক ফরাসির সঙ্গে পেভমেন্টের উপর শামিয়ানা খাটানো কাফেতে বসে কফি খাচ্ছেন, রসালাপ করছেন। এমন সময় তিনি তাঁর পরিচিত এক ইংরেজকে দেখে চেয়ার-টেবিল বাঁচিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। ফরাসির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনি অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট- অনার্স।’ সেদিনের আড্ডায় ফরাসিটি বলছেন, ‘শুনেছি, জর্মানদের ন্যাশনাল পাসটাইম, বিশ-তিরিশ বছর অন্তর অন্তর একটা বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া।’ মুজতবা আলী এর উত্তরে বলছেন, “নস্যি, নস্যি মসিয়ে, বিলকুল ধূলিপরিমাণ! আফগানিস্তানের নাম শুনেছেন? সেখানে কওমে কওমে ধনাধন্ গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি করে দু’দশ জনকে খতম করে দেওয়া তো নিত্যদিনের ওয়ারজিস, জিমনাসটিক্। আর তাবৎ মুল্লুক জুড়ে লড়াই, এক বাদশাহকে তখ্ৎ থেকে হটিয়ে অন্য বাদশাহকে বসানো- যদিও তারা বিলক্ষণ জানে, তাতে করে ফায়দা হবে না আদৌ, কুল্লে ‘পিদর সুখতেই’ (পিতৃদহনকারী, কুট্টি ভাষায় সব হা-ই) বরাবর, সোওয়াদ পাল্টাবার তরে একবার একটা ডাকুকে এস্তেমাল করে তজরুবাভী করেছে- এসব মুল্লুক-জোড়া প্যাসটাইমে ভদ্র আফগান মাত্রই মশগুল হয় বছর পাঁচেক অন্তর অন্তর।"
[আরও পড়ুন: শুধু তালিবান নয়, দূর করতে হবে তালিবানি মানসিকতাকেও]
ফরাসি তখন একগাল হেসে বলেছিল, ‘আমরা যেরকম ৩১শে ডিসেম্বরের দুপুর রাতে গির্জেয় গির্জেয় ঘণ্টা বাজিয়ে ফি বছর পুর্ণা সালটাকে ঝেঁটিয়ে খেদিয়ে দিয়ে নয়া একটা নিয়ে আসি।’ অর্থাৎ, তালিবানরাও সেরকম মাঝে মাঝে পুরনো সরকার পরিবর্তন করে নতুন সরকার নিয়ে আসে। কী সাংঘাতিক কাণ্ড!
কিন্তু আমি এই বইটি পড়তে পড়তে বারবার ভাবছি, সৈয়দ মুজতবা আলী কতদিন আগে আফগান রাজনীতি সম্পর্কে, কাবুলে রাজনৈতিক দলাদলি সম্পর্কে এই ‘সাংঘাতিক মোক্ষম ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন! কোনও কিছুই বদলায় না। আসলে সবসময় আমরা পুরনোকেই নতুন আখ্যা দিই। তাই পরিবর্তনে সবকিছু যেন অপরিবর্তনীয়। একটা জায়গায় নিক্সন আর কিসিঞ্জার-কে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী বলছেন, “বৈঠকখানায় নিকসনের পরিত্রাহি চীৎকার ‘অস্ত্র সম্বরণ করো, অস্ত্র সম্বরণ করো’।” অর্থাৎ আমেরিকা বলছে, অস্ত্র সংবরণ করতে হবে। তারপরেই সৈয়দ মুজতবা আলী লিখছেন, “ধন্য, সেই সিলেটী কবি, যিনি নিজের অমূল্য সুভাষিতটি রচেছিলেন। আমি শুধু ‘হতীন মা’-র (সৎ মা) বদলে ‘কিসিংগার’ শব্দটা ব্যবহার করেছি। এবার শুনুন কবিতাটি।
‘কিসিংগারের কথাগুলিন
মধু-রসর বাণী
তলা দিয়া গুড়ি কাটইন
উপরে ঢালইন পানী।।”
তার মানে, তলা দিয়ে গুঁড়ি কাটছে, উপরে জল ঢালছে। কী মধুর রসের বাণী। এই সিলেটি কবি লিখেছিলেন ‘সৎ মা’ সম্পর্কে, কিন্তু আলী লিখলেন ‘আমেরিকা’ সম্পর্কে।
এই বইটিতে সৈয়দ মুজতবা আলী আরও লিখছেন, আফগানিস্তানে ‘লাঠি যার দেশ তার’। কাবুলের সিংহাসনে বসার হক শেষটায় বংশানুক্রমে গিয়ে দাঁড়ায় মূলত কান্দাহারের আবদুর রহমান, হবিবউল্লা, আমানউল্লাহর গোষ্ঠীতে। ওই গোষ্ঠীর ‘যার লাঠি তার মোষ’। আমানউল্লাহ, নাদির, জহির এবং জেনারেল মহম্মদ দাউদ খান- যে কেউ গায়ের জোরে একবার কাবুলের তখ্তে বসে যেতে পারলে, ক্রমে ক্রমে জালালাবাদ, গজনি, কান্দাহার শায়েস্তা করে তাঁবেতে আনতে পারলে তাবৎ আফগানিস্তান আলা-হজরত বাদশাহ বলে মেনে নেয়।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলছেন, “কার্ল মার্কস বলেছিলেন, অর্থনৈতিক কারণ ভিন্ন ইহ-সংসারে কোনও বিরাট পরিবর্তন হয় না। ইংরেজ এই নীতি অবলম্বন করে তার ন্যাশনাল প্যাস্টাইম- ‘জাতীয় চিত্তবিনোদন’ প্রতিষ্ঠান, ফুটবল-ক্রিকেটকে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড-কেমব্রিজে সমাসন স্থলবিশেষে উচ্চাসন দিয়ে যে অত্যদ্ভুত সমন্বয় সাধন করলো... স্থাপন করলো বিশ্ব জোড়া রাশি রাশি উপনিবেশ।... তাই ইংরেজ গলফ্ খেলার সময়ই হোক আর রিলেটিভিটি কপচাবার ওক্তেই হোক, সবকিছু মা-লক্ষ্মীর আঁচলে বেঁধে দেয়। পাঠানের বর্ণচোরা সংস্করণের নাম তাহলে ইংরেজ? পাঠানও তার ন্যাশনাল প্যাসটাইম- দু’দশ বছর পর পর কাবুলের তখ্ৎ থেকে পুরনো বাদশাকে সরিয়ে নয়া বাদশা বসানোর জাতীয় চিত্তবিনোদনের সময় মার্কস-নির্দিষ্ট নীতি, ইংরেজ কর্তৃক হাতে-কলমে তার ফলপ্রাপ্তি, কোনটাই কিন্তু ভোলে না।” কাজেই একটা ‘দোনালা বন্দুক’ চিরকাল আফগানিস্তানের মাটিতে থেকে গিয়েছে।
সৈয়দ মুজতবা আলী আরও লিখছেন, ‘পাঠান-হৃদয়ে আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রতি কোনেও প্রকারের খাস, দিল-তোড়্ মহব্বতের কোনো নিশান আমি দেখিনি। যে অঞ্চলে সে বাস করে অর্থাৎ কওমী এলাকার প্রতি তার টান থাকা অসম্ভব নয়- পাখিটাও তার নীড়ের শাখাটির মঙ্গল কামনা করে- কিন্তু দেশপ্রেম! অতএব দেশ-প্রেমী দাউদ দেশের দোহাই দিয়েছেন দোনালা বন্দুকের মতো। কাবুল ও কাবুলাঞ্চলের সরকারী ফৌজ যেন তাঁর কাছ থেকে বড্ড বেশী টাকা-কড়ি না চায়।’ টাকার বিষয়টাও সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন।
আফগানিস্তান তাই এখনও রহস্যে মোড়া দেশ। এই আফগানিস্তানের মাটি থেকেই কত সুফি কবির জন্ম হয়েছে! মৌলানা জালালউদ্দিন রুমি বালখী, তিনি তো উঠে এসেছেন এই প্রান্ত থেকেই। রুমির কবিতা পড়ে আজও আমরা কত শিহরিত হই! তাছাড়া হাকিম সানাই, হাকিম জামি এবং শেখ মহম্মদ রোহানি– এঁরা সবাই মিস্টিক কবি এবং সুফির দর্শন ভালবাসার দর্শন, মানবতাবাদী দর্শন। অথচ এই আফগানিস্তান থেকেই গজনির মহম্মদ গিয়ে সোমনাথের মন্দির ধ্বংস করেছেন। এই আফগানিস্তানেই বামিয়ান বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করে দিয়েছে তালিবানরা। রেনল্ড নিকোলসন, যিনি একজন রুমি-স্কলার এবং অনুবাদক হিসাবে খুবই পরিচিত, তিনি আফগানিস্তান সম্পর্কে বলেছেন একটা কথা, ‘The land of interesting and paradoxical juxtaposition.’ মানে, এই দেশটা খুব চিত্তাকর্ষক কিন্তু ভীষণভাবে বৈপরীত্যেরও দেশ বটে, একটা ‘প্যারাডক্স’। এখানে ভক্তি-রস পাওয়া যায়। ইসলামের যে ‘সাবমিশন’ বা সমর্পণ, যে বিশ্বাস, শান্তির বাণী, যা যা মানবতাবাদী, যেগুলোকে বলা হয় ‘হাদিদ’- সেগুলো এ প্রান্ত থেকেই জন্মাচ্ছে। কেনেথ পি. লিজিও (Kenneth P. Lizzio), ‘Embattled Saints: My year with the Sufis of Afghanistan’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, একটা সাংঘাতিক মিস্টিক স্পিরিচুয়ালিজম, যা সুফি ইসলামের সঙ্গে যুক্ত, তা কিন্তু আফগানিস্তানের মাটির পরতে পরতে রয়েছে।
তাই ঘুরে-ফিরে সৈয়দ মুজতবা আলীর কথায় আসি যে, আফগানিস্তান দেশটা সত্যিই রহস্যে ভরা। হিটলারি পন্থা, দোনলা বন্দুকের মাধ্যমে পট-পরিবর্তন, যে দাউদের সময় আলী দেখেছেন, সেই সময় কাবুলের রাজনৈতিক দলাদলি, রাজগোষ্ঠীর মারামারি, দাউদ যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁকে মারার চক্রান্ত, দলের মধ্যে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র- সেই ঐতিহ্য আজও চলেছে।
আফগানিস্তান সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘অনেক সময় আফগানিস্তানের কথা বলতে গিয়ে একটু আবেগতাড়িত হয়ে যাই। তাতে অনেক সময় সত্যের অপলাপ হয়।’ অস্কার ওয়াইল্ডের একটি কথা সৈয়দ মুজতবা আলী উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেরই বেশ কিছু বেকার বাজে জিনিস আছে যেগুলো আমরা স্বচ্ছন্দে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিতে পারি। কিন্তু ভয়, পাছে কেউ কুড়িয়ে নেয়!’ তারপরেই বলছেন, ‘আফগান দেশে মাইলের পর মাইল শুধু পাথর আর পাথর, কিংবা সিন্ধু দেশে বালি আর বালি; কিন্তু হলে কি হবে?’ আলী আসলে বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ওই ভূখণ্ডটা কাউকে নিতে দেবে না। তাঁর মতে, কাবুলে এমনও আশঙ্কা যে, ‘ইন্ডিয়া-ই বা কোন তক্কে-তক্কে আছে কে জানে? এই হল বিশ্ব ভুবনের শঙ্কা, বিভীষিকা!’ এই আশঙ্কা একটা সামান্য ভূখণ্ড নিয়ে। এখনও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এর থেকে মুক্তির পথ কী? মুক্তির পথ সন্ত্রাস না শান্তির আলোচনা? কৌশল না আবেগ? এ এখন মস্ত বড় একটা জিজ্ঞাসা-চিহ্ন।