নতুন সংসদ ভবনের নির্মাণকে যদি সময়ের প্রয়োজনোচিত দাবি বলে ধরে নিই- তাহলেও সংসদ ভবনের কর্মীদের ইউনিফর্মে পদ্মফুলের সংযোজনকে রাজনৈতিক রণকৌশল ছাড়া অন্য কিছু বলে ভাবতে পারা যাচ্ছে না। দেশ গঠনের নামে প্রতি পদে কেন এত মেরুকরণের কাঁটা? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
বৈষ্ণব পদাবলি বলে- ‘নবরে নব নিতুই নব,/ যখনি হেরি তখনি নব।’ পুরাতনকে জীর্ণ ঘোষণা করে, নতুনকে যে স্বাগত জানায়, সে-ই তো আধুনিক। সে-ই তো সাবেক অতীতকে বৈপ্লবিকভাবে পরিবর্তনের পথে নিয়ে যায়। অতীতের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় নতুন বর্তমান। ভবিষ্যৎ আবার নজরদারি রাখে বর্তমানের উপর- ‘Future is stalking on us’.
এ-কথা যদি সত্য হয়, তবে নতুন সংসদ ভবনকে স্বাগত জানাতে অসুবিধা কোথায়? পুরনো সংসদকে তো কামান দেগে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না, যেভাবে একদিন পানিপথে বাবর ইব্রাহিম লোদির দুর্গকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। অতএব সমুখপানে চলার পথে এত দ্বিধা কেন! একদা সংসদের অ্যানেক্স অট্টালিকা তৈরি হয়েছিল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যখন স্পিকার হলেন, তখন তৈরি হল সংলগ্ন গ্রন্থাগার অট্টালিকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন বেড়েছে। সংসদে কর্মীসংখ্যাও বেড়েছে। কাজেই প্রয়োজনের দাবি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
মীরা কুমার যখন লোকসভার স্পিকার ছিলেন তখন নানা কমিটি, নানা উপদেষ্টা মণ্ডলী পরামর্শ দিয়েছিল যে, সংসদের নতুন ভবন প্রয়োজন। কিন্তু তখনকার কংগ্রেস সরকার ভবন নির্মাণের জন্য বিপুল অর্থ খরচকে অগ্রাধিকার দিতে রাজি হয়নি। পরে সুমিত্রা মহাজন যখন স্পিকার হলেন, তখন তিনিও সংসদের পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব দেন।
সুমিত্রা মহাজন আমাকে একবার বুঝিয়েছিলেন, কেন পুরনো সংসদ ভবন কার্যত অচল হয়ে যাচ্ছে। সংসদ ভবনের জলনিকাশি ব্যবস্থার অনেকটা আছে মাটির নিচে, মানে যাকে বলা হয়- ‘আন্ডারগ্রাউন্ড সুয়ারেজ সিস্টেম’। ভুললে চলবে না, সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে। আর সেখানকার জলনিকাশি ব্যবস্থা নির্মাণ ঘটে ১৯২৭ সালে। এখন এই জলনিকাশি ব্যবস্থা এতটাই বিপর্যস্ত যে, তা মেরামত করতে গেলে পুরনো বাড়ির অনেকটা ভাঙতে হবে, সময়ও লাগবে বিস্তর। বছরে তিন-চারবার সংসদের অধিবেশন চলে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা। অধিবেশন বন্ধ না-করে এই সংস্কার সম্ভব নয়। পুরনো সংসদ ভবনে বিদ্যুৎ-বণ্টন ব্যবস্থাটিও প্রাচীন। লালকৃষ্ণ আডবাণী উপ-প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও বলেছিলেন, এখন চারদিকে এমনিতেই এত খরচ। সংসদ ভবনের সংস্কার থাক, পরে হবে।
[আরও পড়ুন: দমনমূলক পদক্ষেপ নয়, সংবাদমাধ্যমের গতিপথ হোক উন্মুক্ত]
এই পর্যন্ত চিত্রনাট্য ঠিক-ই আছে। বাস্তবকে স্বীকার করে একটি নতুন সংসদ ভবন হয়েছে। আর, এই সংসদ ভবন ৫৪৩ জন লোকসভার সদস্য এবং ২৫০ জন রাজসভার সদস্য-প্রত্যেকের। সমস্যা অন্যত্র। চিত্রনাট্যে গলতি অন্যখানে। এবং সেই সমস্যা গভীর রাজনৈতিক সংকট-প্রসূত। যা ডেকে এনেছে গণতন্ত্রর বিপদ।
স্বাধীনতার ৭৬ বছর পেরিয়েও দেশে এখন এই ‘ধারণা’ বলবান ও ক্রমবর্ধমান যে, সর্বত্র অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা শুধু রাষ্ট্র বা সরকারি ব্যবস্থায় নয়, তা জাঁকিয়ে বসছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা যত বাড়ছে- তত বাড়ছে রাজনৈতিক হিংসা, জাতপাতের সংঘাত। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার এই সংকট-বোধের ‘ডেটারেন্স’ বা প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ তো হচ্ছেই না, উল্টে একদেশদর্শী ও একমাত্রিক ভারত গঠনের আখ্যানের অনুঘটক হয়ে উঠছে।
এই হালহকিকত দেখে মনে হয়, শারীরিক সৌন্দর্য ও সৌষ্ঠব-বৃদ্ধি ভাল। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন শরীরের ভিতরের অসুখ ঠিক করা। রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। ভাল ব্র্যান্ডের জামা পরলাম, চুলে কলপ দিলাম, বৃদ্ধ হাতে নিল শৌখিন হাতির দাঁতের লাঠি বা গায়ে জড়াল কাশ্মীরি শাল- আপাতভাবে মন্দ নয়, যদিও সর্বাগ্রে দেখা দরকার- অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কি আরও মজবুত করতে পারলাম! সেটি না করে যদি শুধু বাইরের চাকচিক্য নিয়ে মাথা ঘামানো হয়, তা হাস্যকর প্রয়াস হতে বাধ্য। যেমনটি ঘটছে নতুন সংসদ ভবনের বেলায়।
নতুন ভবন নির্মাণের পর, সেখানকার কর্মীদের নতুন পোশাক দেওয়া হয়েছে। ভাল। একঘেয়েমি কাটল। আরও রঙিন, আরও আধুনিক হল ইউনিফর্ম। কিন্তু সেই জামায় পদ্মফুলের ছবি লাগিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি কি আদৌ আজ আমাদের অগ্রাধিকার? সরকার পক্ষ বলছে, পদ্ম তো জাতীয় ফুল! ইন্দিরা গান্ধী তো ‘কমনওয়েলথ’ বা ‘ন্যাম’ শীর্ষক সম্মেলনেও পদ্মর ‘প্রতীক’ বা ‘লোগো’ ব্যবহার করেছেন। স্বর্ণকমল, রজতকমল এসব পুরস্কার তো বিজেপি চালু করেনি, তাহলে কি এবার এসব পুরস্কারের নামও বদলে দিতে হবে? ওদিকে, কংগ্রেস যে জাতীয় পতাকার আদল ‘কপি’ করে দলীয় পতাকা তৈরি করেছে!
অর্থাৎ, সংসদের কর্মীদের ইউনিফর্মে পদ্মের সংযোজন ঘটানো বিজেপির রাজনৈতিক দুষ্টুমি। তারা খুব ভাল করে জানে, পদ্মের এহেন প্রতীক ব্যবহার নিয়ে শোরগোল হবে। আর, সম্ভবত সেই বিতর্কটা শাসক দল চাইছে। এইভাবে নানা ছোট-ছোট বিষয় উত্থাপনের মাধ্যমে অতীতের নেহরুবাদী কংগ্রেস জমানার ন্যারেটিভের সঙ্গে সংঘাত বা অ্যান্টি-থিসিস তৈরি করে হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে। যার ফলে তৈরি হচ্ছে একপ্রকার পরাবাস্তবীয় ধঁাধা। ২০১৪ সালে ঠিক এই মর্মে গণ-হিস্টিরিয়া আমরা দেখেছিলাম। ২০১৯ সালেও মিডিয়া-বিরচিত অনুরূপ পারসেপশনের জাদুটোনা দেখেছি। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের জন্য মোদি-কেন্দ্রিক নতুন ভারতের স্বপ্নের আধিপত্য রচনার সেট-নির্মাণ প্রস্তুত করা হচ্ছে। পার্লামেন্টের নতুন ভবনের নির্মাণ সেই আলেখ্যর অঙ্গ। এদিকে নীরবে, নিভৃতে কাঁদছে গণতন্ত্র। কাশ্মীর থেকে মণিপুর।
(মতামত নিজস্ব)