shono
Advertisement
Jyoti Bose

'ঐতিহাসিক ভুল'! কেন জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি বামপন্থীরা?

একবার নয়, তিনবার এসেছিল সুযোগ।
Posted: 06:34 PM Apr 13, 2024Updated: 06:37 PM Apr 13, 2024

লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে নানা কিসসা-কাহিনি পর্বে পর্বে সংবাদ প্রতিদিন ডট ইনে। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘মৃত্যুরহস্য’ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর ‘জেলযাত্রা’, জ্যোতি বসুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ থেকে মোদির ‘রাজধর্ম পালন’- ফিরে দেখা হারানো সময়। লিখছেন বিশ্বদীপ দে

Advertisement

বাঙালি প্রধানমন্ত্রী। আগের পর্বেই আমরা আলোচনা করেছি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে। তাঁর কুরসিতে বসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল দুবার। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা হয়নি। একবার রাজীব গান্ধী, অন্যবার মনমোহন সিং বসেছিলেন মসনদে। কংগ্রেসের শক্তিশালী নেতা প্রণব যা হতে পারেননি, তা পারতেন এক বামপন্থী বঙ্গসন্তান। এটুকু বললেই সম্ভবত সকলে সঙ্গে সঙ্গে বুঝে যাবেন, কার কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা কীভাবে নাকচ করে দিয়েছিল সিপিএমের (CPM) কেন্দ্রীয় কমিটি, সেকথা আজও বাংলার রাজনীতির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এক 'জনপ্রিয়' কিসসা। দল 'ঐতিহাসিক ভুল' করেছে বলে মনে করতেন জ্যোতি বসু। তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। আজও এই শব্দবন্ধটি ফিরে ফিরে আসে। আর কাটাছেঁড়া চলতে থাকে। সত্য়িই কি ঐতিহাসিক ভুল? ঠিক কী হয়েছিল? কেন বামপন্থীরাই চাননি জ্যোতিবাবু দেশের প্রধানমন্ত্রীর কুরসিতে বসুন!

১৯৯৬ সাল। ততদিনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন জ্যোতি বসু (Jyoti Basu)। সেবার লোকসভা নির্বাচনে ফলাফল ছিল ত্রিশঙ্কু। অটলবিহারী বাজপেয়ীর বিজেপি সবচেয়ে বেশি আসনে জিতেছিল। ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ১৬১ আসন পেয়েছিল তারা। কিন্তু তারা সরকার গড়লেও তা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ১৩ দিন! যাই হোক, কংগ্রেসের (Congress) প্রাপ্ত আসন ছিল ১৩৬। কিন্তু তারা সরকার গড়তে আগ্রহী ছিল না। তবে গেরুয়া শিবিরকে রুখতে কেউ সরকার গড়লে বাইরে থেকে সমর্থনে রাজি ছিল হাত শিবির। এহেন পরিস্থিতিতে জনতা দলের সঙ্গে হাত মেলাল বামেরা। এছাড়া সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, এজিপি, তামিল মানিলা কংগ্রেস, তেলুগু দেশম পার্টির মতো ছোট ছোট পার্টিও যোগ দিল ইউনাইটেড ফ্রন্টে। লালুপ্রসাদ, মুলায়ম সিং যাদব, ভি পি সিং, করুণানিধিরা সকলে একমত হলেন, প্রধানমন্ত্রী হোন জ্যোতি বসুই। এমনকী খোদ ভি পি সিং, যিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রিত্বের অন্যতম সম্ভাব্য মুখ, তিনিও পর্যন্ত বললেন কুরসিতে তাঁর বসার ইচ্ছে নেই। বরং বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকেই বসানো হোক। সিপিআইও প্রস্তাবটি সমর্থন করল।

[আরও পড়ুন: সৌদির জেলে ১৮ বছর বন্দি, মৃত্যুদণ্ড এড়াতে প্রয়োজন ৩৪ কোটি! জোগাড় করল কেরলবাসী]

এই অবস্থায় বিষয়টা গেল পলিট ব্যুরোয়। কিন্তু সেখানে বিষয়টার নিষ্পত্তি না হওয়ায় বৈঠকে বসল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি। ১৪ মে-র সেই বৈঠকে ভোটাভুটি হয়। আর সেখানেই স্থির হয়ে যায় জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হোন, দল চাইছে না। কেননা সংখ্যাগুরু ভোট 'না'-এর দিকে। অথচ সেই সময় দলের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিৎ ছিলেন জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে। কিন্তু ভি এস অচ্যুতানন্দন, প্রকাশ কারাত, সীতারাম ইয়েচুরির মতো নেতারা ছিলেন বিপক্ষে। শোনা যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, শ্যামল চক্রবর্তীর মতো বঙ্গের বাম নেতারা কিন্তু চেয়েছিলেন জ্যোতিবাবু মসনদে বসুন। কিন্তু সেটাই বাংলার বাম নেতাদের সকলের মত ছিল তা নয়। কেরল, তামিলনাড়ুর বাম নেতাদের পাশাপাশি বাংলার বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাই ভোট দেন বিপক্ষে।

কিন্তু কেন? জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কী যুক্তি ছিল? আসলে তাঁদের দাবি ছিল, বামেদের প্রাপ্ত আসন মাত্র ৩২। ফলে সরকার গড়লেও বাধ্য হয়ে এমন অনেক কিছুই লাগু করতে হবে, এর আগে যার বিরোধিতাই করেছেন বামেরা। ফলে সব মিলিয়ে দলের বিশ্বস্ততাই ক্ষুণ্ণ হবে। সুতরাং জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী না হওয়ায়ই বাঞ্ছনীয়।
আগেই বলা হয়েছে 'ঐতিহাসিক ভুল'-এর কথা। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে। কেন্দ্রে তখন ইউনাইটেড ফ্রন্টের সরকার, প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া। সেই সময়ই এক সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের বিরোধিতা করে দল যে ভুল করল তা 'ঐতিহাসিক'। সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর হইহই পড়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, এও কি শৃঙ্খলাভঙ্গ নয়? যদিও এও ঠিক, জ্যোতি বসু কিন্তু সেদিন দলের বিরোধিতা করেননি। কেবল নীতির বিরোধিতার কথা জানিয়েছিলেন। হরকিষেণ সিং সুরজিৎকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও কথা বলেননি। নীরব ছিলেন। যার অনেক মানেই হতে পারে। তবে যেহেতু তিনি জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষেই ছিলেন, তাই শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হলেও ভিতরে ভিতরে যে আহত হয়েছিলেন তা বলাই যায়।

[আরও পড়ুন: ‘খবরদার!’, ইজরায়েলের বুকে হামলার আশঙ্কা নিয়ে ইরানকে কড়া হুঁশিয়ারি বাইডেনের]

এখানে একটা কথা বলা দরকার। জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা যে সেই প্রথম হল তা নয়। এর আগে রাজীব গান্ধী তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন। এবং সেটাও দুবার। প্রথমবার চন্দ্রশেখরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়। সেবার কিন্তু রাজীবের প্রথম পছন্দ ছিলেন জ্যোতিবাবুই। দেবীলাল ছিলেন দ্বিতীয়। চন্দ্রশেখরই ছিলেন সব শেষে। যদিও সেবারও বামেরা রাজি না হওয়ায় তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি। এর পর চন্দ্রশেখর সরকারের পতনের সময়ও একই প্রস্তাব আসে। কিন্তু সেবারই দল না চাওয়ায় জ্যোতিবাবুর মসনদে বসা হয়নি। কিন্তু সেই দুবার 'ঐতিহাসিক ভুল' জাতীয় কোনও কথা বলতে শোনা যায়নি তাঁকে। যেটা হল ১৯৯৬ সালে। তাই সেই ঘটনাই সব সময় আলোচনায় উঠে আসতে থাকে।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকলেও শেষপর্যন্ত অন্য নাম এসে ঢেকে দিয়েছিল সেটা। কিন্তু জ্যোতিবাবুর ক্ষেত্রে কার্যতই এর পর উঠে আসে দেবেগৌড়ার নাম। প্রায় অপ্রত্যাশিত ভাবেই। প্রণববাবুর ক্ষেত্রে উঠে আসা রাজীব গান্ধী কিংবা মনমোহন সিংয়ের মতো ভারী নাম তিনি ছিলেন না। ফলে সুযোগ জ্যোতিবাবুর ক্ষেত্রে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত নিজেরই দলের কাছে বাধা পেয়ে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনাও সেখানেই শেষ হয়ে যায়। ফলে বাঙালি প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার যে স্বপ্ন তা অস্তমিত হয়। থেকে যায় আপসোস। এবং চায়ের টেবিলে শোরগোল ফেলা আলোচনা। এবারও নির্বাচনের মুখে ফিরে আসছে গত সহস্রাব্দের সেই মুহূর্ত। জ্যোতি বসু ও ইউনাইটেড ফ্রন্টের নানা কাহিনি। যা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক কিংবদন্তিতে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা কীভাবে নাকচ করে দিয়েছিল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি, সেকথা আজও বাংলার রাজনীতির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা এক 'জনপ্রিয়' কিসসা।
  • দল 'ঐতিহাসিক ভুল' করেছে বলে মনে করতেন জ্যোতি বসু। তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল।
  • আজও এই শব্দবন্ধটি ফিরে ফিরে আসে। আর কাটাছেঁড়া চলতে থাকে।
Advertisement