সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ইতিহাস পুরনো হয়, ফুরিয়ে যায় না। মনমোহন সিংয়ের প্রয়াণ নতুন করে আলোচনায় ফিরিয়েছে গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার সেই সময়কাল। প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও এবং তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উদ্যোগে আমদানি শুল্ক হ্রাস, কম কর, বেশি বেশি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে উদার অর্থনীতির সূচনা হয়েছিল দেশে। গত শতাব্দীর শেষে যার ফল মিলেছে, দেশের বৃদ্ধি হয়েছে রকেটের গতিতে। অথচ রাওয়ের সঙ্গে গান্ধী পরিবারের সংঘাত সর্বজনবিদিত। যার মূলে ছিল দেশের শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্যে 'লাইসেন্স-রাজে'র সমাপ্তি। যাকে আমরা ‘উদারীকরণ নীতি’ নামে চিনি।
এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বারবার কংগ্রেসকে খোঁচা দিয়েছে বিজেপি। তাদের দাবি, নরসিমা ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের বরাবরই অবহেলা করেছে হাত শিবির। অন্যদিকে বহু কংগ্রেস নেতারই দাবি, রাজনৈতিক ভাবে গান্ধী পরিবারকে অবদমন করতে চেয়েছিলেন নরসিমা। ভারতীয় রাজনৈতিক মহল মনে করে, এই কারণেই উদার অর্থনীতিকরণের সব কৃতিত্বই মনমোহনকে দিতে চায় কংগ্রেস। যদিও এই সিদ্ধান্ত মনমোহন কার্যকরই করতে পারতেন না, যদি রাওয়ের রাজনৈতিক শক্তি সেটার নেপথ্যে না থাকত।
একথা সকলেরই জানা তথাকথিত লাইসেন্স-রাজ বরাবরই 'বম্বে ক্লাব'কে সুবিধা দিয়েছে। অর্থাৎ মুম্বইয়ের (তৎকালীন বম্বে) শিল্পপতিরা এর সুবিধা পেতেন একতরফা ভাবে। আর তার পিছনে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সখ্যের দাবি বিরোধীরা করে এসেছে চিরকাল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পরিস্থিতি একই ছিল। ফলে যখন নরসিমা মনমোহনের হাত ধরে বিশ্বের সামনে ভারতের বাজারের দরজা খুলে দিতে চান তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের তা পছন্দ হয়নি। ফলে সেই প্রভাবশালীরাও চাপ বাড়িয়েছিলেন হাত শিবিরের উপরে। এমনটাই শোনা গিয়েছিল তখন। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতি তখন রীতিমতো ধুঁকছে। জিডিপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডারে ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের মতো। এই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে উদারনীতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাতারাতি লাইসেন্স-রাজের সমাপ্তি ঘটে যায়। আর ওই এক পদক্ষেপেই বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতি হয়ে উঠেছিল ভারত।
নরসিমার প্রতি কংগ্রেসের, বলতে গেলে গান্ধী পরিবারের মনোভাব কখনও আর ভালো হয়নি। মনমোহনকেও কিন্তু সেই অর্থে প্রাপ্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। একথা ঠিকই তিনি দশ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সরিয়ে রাখার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে মনে করা হয়। অথচ একসময় রাহুল গান্ধী নিজের সরকারের অর্ডিন্যান্সেই ভেটো পেশ করেছিলেন। এই 'অপমান' নীরবেই সয়েছিলেন মনমোহন। তিনি ইস্তফা দিতে পারেন, এমন গুঞ্জনও ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মনমোহন সেদিন কেবল বলেছিলেন, ''আমি সহজে হতাশ হই না। ইস্তফা দেওয়ার প্রশ্নই নেই।'' রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন তখন মাসছয়েক দূরে। এই পরিস্থিতিতে মনমোহনকে যেনতেনপ্রকারেণ সরাতে চাইছিল কংগ্রেস। এবং ইউপিএ-২ সরকারের 'ব্যর্থতা'র দায় চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। মনমোহনের মৃত্যুতে গান্ধী পরিবারের তরফে শোকবার্তা পেশ করা হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে ইতিহাসের পাতা উলটে গিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সেই সব অধ্যায় যা রাহুলরা ভুলে যেতেই চাইবেন।