জিগনেশ মেওয়ানির মামলা হোক, বা আইনি স্থগিতাদেশ অমান্য করে বুলডোজার দিয়ে ঘর-বাড়ি ধসিয়ে দেওয়া, বা যখন-তখন বিরোধী পক্ষের কাউকে দেশদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করা হোক বা রাজবন্দি করা- ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিহিংসার ধারা অব্যাহত। সংবিধানের প্রতি যেরকম দায়িত্বহীন মনোভাব ঝলসে ওঠে, তাতে আশঙ্কা হয়, সংবিধানের শক্তি কি গতায়ু? কলমে রাজদীপ সরদেশাই
‘তিল তিল সাধনায় অর্জিত আমাদের এই গণতন্ত্র পুলিশি রাজ্যে রূপান্তর করার কথা কল্পনাও করা যায় না। আর যদি অসমের পুলিশ সেটাই করবে ভেবে থাকে, তবে এটা নিঃসন্দেহে এক বিকৃত চিন্তা।’ গুজরাটের বিধায়ক জিগনেশ মেওয়ানিকে জামিন দেওয়ার সময় বাড়পেটা-র দায়রা আদালতের বিচারক অপরেশ চক্রবর্তী এই কথাটি স্পষ্ট করে বলে দেন এবং রাজ্য পুলিশের সমালোচনা করেন ‘মিথ্যা এফআইআর’ দায়ের করা-সহ ‘আদালত ও আইনের অপব্যবহার’-এর জন্য।
একটা ছোট শহরের এক সাহসী বিচারক পুলিশকে তাদের প্রধান সাংবিধানিক দায়িত্ব মনে করিয়ে দিলেন। মজার ব্যাপার হল, এমন দৃষ্টান্তমূলক রায়ের ঠিক একদিন পরেই, ভারতের ক্ষমতাশালী অভিজাতরা, রাজধানীর বিজ্ঞান ভবনে ছ’বছর পর অনুষ্ঠিত প্রধান বিচারপতি এবং মুখ্যমন্ত্রীদের বৈঠকে একত্র হয়েছিলেন। বিচার বিভাগীয় বিলম্ব এবং বহুসংখ্যক বিচারাধীন কেস নিয়ে ভারতের প্রধান বিচারপতি এন. ভি. রমনা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং নির্বাহী ক্ষমতা নিয়ে ভালই অপ্রস্তুতে ফেলার মতো প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু মূল সমস্যার জায়গাটি তাঁর প্রশ্নের বিপাক থেকে অধরাই থেকে গেল। আর তা হল: কেন্দ্র ও রাজ্য- উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বশ্রেণির ক্ষেত্রে আইনের শাসন এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার প্রতি চরম অবজ্ঞা।
[আরও পড়ুন: ভারতে আর্থিক মন্দার মার, এবার কি কঠোর হবে কোষাগার নীতি?]
ভুলে যাবেন না, সেই বৈঠকে প্রথম সারিতে ছিলেন হেমন্ত বিশ্বশর্মা, অসমের দণ্ডমুণ্ড মুখ্যমন্ত্রী, যিনি আবার রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বটে। জিগনেশ মেওয়ানির মতো বিরোধী বিধায়ককে হঠাৎ মধ্যরাত্রে অসম পুলিশ গুজরাট থেকে তুলে নিয়ে সুদূর কোকরাঝারে নিয়ে এল, আর সে ব্যাপারে দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কিছু জানেন না, এমনকী, গুজরাটের পুলিশও জানল না- এ-ও কি সম্ভব? বিজেপিশাসিত দু’টি রাজ্য একসঙ্গে মিলিঝুলি ষড় করছে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে টুইট করা একজন বিধায়ককে ‘উচিত শিক্ষা’ দেবে বলে। রাজনৈতিক হিসাবনিকেশ বুঝে নিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের এর চেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ আর কিছু কি হতে পারে?
হেমন্ত বিশ্বশর্মা মোটেই একা নন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সঙ্গে এসেছিলেন পাঞ্জাব আপ-এর সহকর্মী ও সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী ভগবন্ত মান। পাঞ্জাবে ক্ষমতায় আসতে না আসতেই, পাঞ্জাব পুলিশ একের পর এক এফআইআর দায়ের করেছে ‘আপ’-এর সমালোচনাকারী জনতার বিরুদ্ধে। তাঁদের মধ্যে কেজরিওয়ালের এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বর্তমানে শত্রু, কুমার বিশ্বাসও রয়েছেন। গ্রেপ্তারি রুখতে এমনকী, বিচারিক সুরক্ষার প্রার্থনা অবধি করতে হয়েছে তাঁকে। মিটিংয়ে উপবিষ্ট ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যাঁর সরকার সমালোচনামূলক সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ-সহ একাধিক ফৌজদারি মামলা করেছে, করে চলেছে নিয়মিতভাবে। মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না বটে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, তাঁর সরকারও প্রতিবাদীদের ভয় দেখাতে পুলিশি ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত। এমন কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি আদৌ আছেন, যিনি সত্যনিষ্ঠভাবে দাবি করতে পারেন যে ‘প্রতিশোধ’-এর রাজনীতি অনুশীলন করার জন্য নির্বাহী কর্তৃত্বের অপব্যবহার কখনও করেননি?
মঞ্চে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তিনি দেশের প্রভাবশালী জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে উপস্থিত ব্যক্তিদের বক্তব্যের সুর স্থির করবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ফৌজদারি সংস্থাগুলিকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী পক্ষের নেতাদের ক্রমাগত বিপাকে ফেলার অভিযোগ থেকে দূরে সরে এই বিষয়ে মন্তব্য করার অবস্থানে কেন্দ্র বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি আদৌ আছেন? বিরোধী নেতাদের একরোখা টার্গেট করা, আবার যারা কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদের ছাড় দেওয়ার ঘটা- মোদি সরকারকে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির মঞ্চ তৈরি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করার সমূহ পরিসর রয়েছে।
এমন নয় যে, ২০১৪ সালের পর থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে প্রতিহিংসাপরায়ণতার ধারা, বা নেতা ও পুলিশের একে-অপরকে তেল দেওয়ার সুদীর্ঘ জালটি তৈরি হয়েছে। আমরা যদি কোনও টাইম মেশিনে চড়ে ইন্দিরা গান্ধী এবং ‘জরুরি অবস্থা’-র সময়ে পৌঁছে যাই, দেখতে পাব একই ইতিহাস সেখানে লুকোচুরি খেলছে। এমনকী, এরপরের যে কোনও শাসনকালেই দেখতে পাব পুলিশের সুস্পষ্ট পক্ষপাতিত্বের ঘটনা, যার নেপথ্যে রয়েছে নির্বাহী কর্তৃত্ব। আমরা দেখতে পাই, এই নকশায় আইনি শাসন উপহাসে পরিণত। মনে করে দেখুন, ২০০১ সালে তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা-করুণানিধির ‘যুদ্ধ’। যেখানে ডিএমকে-র শীর্ষনেতাকে মাঝরাত ২টোর সময় তাঁর বিছানা থেকে টেনে তুলে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নেয় তামিলনাড়ু পুলিশ, ঠিক একজন দোষী অপরাধীর মতো। তামিলনাড়ুতে তীব্র ব্যক্তিগত বিদ্বেষ সেই রাজে্যর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নির্লজ্জ প্রতিশোধের কেন্দ্র করে তুলেছে।
পার্থক্য এটাই যে, এক সময় যা ব্যতিক্রম হিসাবে দেখা যেত, সেটাই এখন ভারতে যেন বা নিয়ম। কোনও রাজনৈতিক দলই নৈতিক উচ্চস্থান দাবি করার মতো জায়গায় নেই। এমন কোনও সপ্তাহ অতিবাহিত হয় না যেখানে দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে মামলা দায়ের হয়নি মাত্রাছাড়া পুলিশের দাদাগিরির বিরুদ্ধে। কোথাও কোথাও তো আবার আইন প্রয়োগকারী বাহিনী তথা পুলিশ এক্তিয়ার ছাড়িয়ে পুলিশগিরি ফলিয়েছে এতটাই যে, তা আসলে রীতিমতো আইনবিরুদ্ধ। জিগনেশ মেওয়ানির মামলাটি সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। মুম্বইয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে ‘হনুমান চালিশা’ পাঠ করার হুমকি দেওয়ার জন্য বিধায়ক-সাংসদ জুটি রানা দম্পতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করাও কি যুক্তিযুক্ত?
আরও একটা পার্থক্য হল, আদালত কখনও বা গড়িমসি নিয়ে গয়ংগচ্ছভাবে কাজ করে। কখনও দেখা যায়, রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়ায় উৎসাহ। ৩৭০ ধারা বাতিলের পর জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনীতিবিদদের গণবন্দিত্বের বিরুদ্ধে হিবিয়াস কর্পাস পিটিশনগুলি নিয়ে কাজ করতে আদালতগুলি বিলম্ব করেনি কি? ছাত্র এবং সমাজকর্মী উমর খালিদের বিরুদ্ধে ‘জুমলা’-র মতো শব্দ ব্যবহারের জন্য যে-অভিযোগ, সেখানে দিল্লির উচ্চ আদালত কেন তাঁর জামিনের আবেদনকে ক্রমাগত খারিজ করার উপদেশ দিচ্ছে? তারকা-সঞ্চালক অর্ণব গোস্বামীকে জামিন দেওয়ার জন্য যে অসাধারণ তত্পরতা সুপ্রিম কোর্ট দেখিয়েছিল, তুলনায় কম-পরিচিত সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে সেটুকু দিতেও সুপ্রিম কোর্টের যে আলস্য, সেটাও কি এই তালিকায় যোগ করার দরকার নেই? উত্তরপ্রদেশ পুলিশ যদি ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর মতো গুরুতর অভিযোগে ২০ মাসেরও বেশি সময় ধরে কাপ্পানকে আটকে রাখার অনুমতি পায়, তবে জীবনধারণের স্বাধীনতার জন্য বলা সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির অবিচুয়ারি লিখে ফেলাই ভাল, কারণ তা ‘গত হইয়াছে’!
আর সবচেয়ে বড় ফারাক- রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির যে বিদ্বেষমূলক ও অসাধু কর্মকাণ্ড, তার বিরুদ্ধে সমগ্র নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের অনুপস্থিতি। দিল্লি এবং দেশের অন্যান্য অংশে কর্তৃপক্ষ যেভাবে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত এলাকায় বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য বুলডোজার ব্যবহার করেছে, তা নিয়ে ব্যাপকভাবে কোনও ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে না কেন? পরিবর্তে দেখছি অতিদলীয় কিছু চিয়ারলিডারকে, যারা স্বার্থ চরিতার্থের জন্য ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক কুসংস্কারগুলিকে ভাল রায় হিসাবে উপস্থাপিত করছে নাগরিক সমাজের কাছে। খাকি পোশাক-পরা পুরুষদের ক্রমাগত মনে করাতেই হবে যে, তাদের আনুগত্য রাজনৈতিক প্রভুদের প্রতি নয়, শুধু এবং শুধুমাত্র সংবিধানের প্রতি।
পুনশ্চ মেওয়ানি মামলায় বাড়পেটা-র বিচারক অপরেশ চক্রবর্তীর এই কঠোর মন্তবে্যর এক সপ্তাহের মধ্যে অসমের উচ্চ আদালত বিরূপ মন্তব্যে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। যা কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে। এমন হাই প্রোফাইল মামলায় দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার জন্য কি বিচারকদের বদলি করা হবে? যেসব পুলিশকর্তা মিথ্যা অভিযোগ গঠনে সহযোগী ছিলেন, তাঁদের কি শাস্তি দেওয়া হবে? না কি পদোন্নতি আসন্ন?