সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ কালো-হলুদ অটো, তবে মহিলাদের জন্য পিঙ্ক৷ কেন, মহিলারা কি আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্তব্য হচ্ছেন না? যে সমাজে আলাদা করে পিঙ্ক অটো চালিয়ে প্রমাণ করতে হয় নারী স্বাধীনতা, যে সমাজে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ অস্তিত্ব সংকটে ভোগে আর তাই তৈরি হয় তাদের প্রতিরক্ষার তাগিদে গোলাপি অটো, সে সমাজে নারীত্বের বড়াই করা চলে না৷ লিখছেন শ্রেয়সী চৌধুরি
গোলাপি রঙের একটি বেলুন উড়ছে, বড় উঁচুতে, তবে কি আদতে ফাঁপা? কিন্তু উড়ছে তো৷ ‘গোলাপি’ শব্দটি বড়ই মোলায়েম, প্রায় রমণীয়৷ তাই নারীত্বের দাঁড়িপাল্লায় গোলাপি রঙের বিস্তর ওজন, দরও দস্তুরমতো৷ চকোলেট থেকে চপ্পল, চশমা থেকে চরিত্র– সবই প্রায় গোলাপি ঘেঁষা৷ অটোই বা বাদ যায় কেন, বিশেষত নারী স্বাধীনতার লক্ষ্যে দ্রুতগামী যে অটো, তা তো অটোমেটেড মোশনেই গোলাপি৷ মুম্বই-এর রাস্তায় চলছে গোলাপি রঙের অটো৷ বোঝাই যাচ্ছে, এই প্রয়াস মহিলাদের স্বার্থে এবং মহিলাদের দ্বারাই চালিত৷ এই অটোগুলোতে প্যাসেঞ্জার হিসেবেও প্রাধান্য পাবেন মহিলারা৷ সম্প্রতি ৫৪৮ জন মহিলা চালককে তিন-চাকার গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দিয়েছে মহারাষ্ট্র পরিবহণ দফতর৷ এঁদের মধ্যে ৪৬৫ জন মহিলা চালক চালাবেন মুম্বই শহরেই আর ৮৩ জনের লাইসেন্স পৌঁছে যাবে মুম্বই-এর পরিধি পেরিয়ে মহারাষ্ট্রের মফস্সলেও৷ সুসজ্জিত এই অটোগুলো মুম্বই-এর মহিলা চালকদের যেমন দেবে জীবিকার স্বাধীনতা, তেমনই মুম্বই-এর মহিলা অভিযাত্রীদের সুরক্ষার আশ্বাসও দেবে এই নতুন প্রকল্প৷ কাল থেকে যদি মহিলা ড্রাইভার রাখতে হয়, মনে রাখবেন সাদা পোশাকের জায়গায় গোলাপি রঙের স্কার্টের একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়৷ ব্যস, তার পরই ‘চল ধান্নো!’
মুম্বই-এর এই গোলাপি স্বাধীনতা অবশ্য মুম্বই-এর আগেও পরীক্ষিত হয়েছে ভারতের অন্য দু’টি প্রদেশে৷ দিল্লির মর্মান্তিক গণধর্ষণের ঘটনার পর রাঁচিতে প্রথম চালু হয় এই গোলাপি রঙের অটো৷ কারণ সেই একই, সাধারণ অটোয় মহিলাদের যাতায়াত আর তেমন সুরক্ষিত ঠেকছে না৷ তাই আলাদারকম বিশেষ অটো, মহিলাদের সুরক্ষার তাগিদে৷ সেই যেমন রাজতন্ত্রের আমলে পর্দানশীন থাকতেন মহিলারা, অনুষ্ঠানে৷ উদ্যাপনে আলাদা আসন পাতা হত তাঁদের জন্য, সবই সেই সুরক্ষারই খাতিরে৷ ঠিক যে রকম গার্লস স্কুলে পড়া মেয়েটি কো-এড কলেজে পড়তে গেলে মা-বাবা আলাদা করে সাবধান করে দেন৷ বেপাড়ার ছেলেরা আওয়াজ দিলে গৌণ হয়ে যায় পড়াশোনার প্রয়োজন, প্রায় একইরকম৷ সাধারণ মানুষের জন্য সাধারণ কালো-হলুদ অটো, তবে মহিলাদের জন্য পিঙ্ক৷ কেন, মহিলারা কি আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্তব্য হচ্ছেন না? দেখাই যাচ্ছে তা অবান্তর, সাধারণ মানুষ আর তাঁদের দলে নিচ্ছেন না৷ ফলত সাবধানের মার নেই৷
এই সাবধানবাণী মাথায় রেখে কেরলেও শুরু হয়েছিল চব্বিশ-ঘণ্টার ‘শি-ট্যাক্সি’, ভারতের প্রথম মহিলাচালিত ট্যাক্সি৷ যার বিপুল সাফল্যে কেরল সরকার এখন ভাবছেন ‘শি-বাসের’ নতুন প্রকল্পের কথা৷ মহিলা-পরিচালিত ‘শি-বাসগুলো’ মহিলামহলকে নিয়ে যাক নতুন সাফল্যের চূড়ায়৷ গোলাপি রঙের বেলুন তো উড়ছে, নেহাত একটু পিন বাঁচিয়ে এই যা৷
রক্তের রং লাল, স্বাধীনতার গেরুয়া-সবুজ ৭০ বছরের মাথায় নারীর রং ধরা পড়ল৷ সে রং গোলাপি৷ চলচ্চিত্রে হোর্ডিং-এ, সিরিয়ালে, সংক্রমণে রইরই হল খুব, সোচ্চার হল প্রতিবাদ, গোলাপি রঙের পতাকা উজিয়ে বিশ্ব-বিতর্কিত মহিলারা বলে উঠলেন, এই আমাদের চিৎকার, এই আমাদের চৈত্র সেল৷ ‘বেটি বাঁচাও’, ‘বেটি পড়াও’, অথবা ‘কন্যাশ্রী’, দিকে-দিকে রাজনীতিকরণ ঘটল৷ নারীবাদ কী ও কেমন, কতটা ও কখন, সব হিসেব দিতে জড়ো হল জমায়েত, ‘ও মা দেখেছ, পুরুষের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মহিলারাও কেমন এগিয়ে চলেছে এখন, তারাও কেমন কাজ করে অফিসে, বাজারে, লিভ অ্যাপ্লিকেশন দেয়, ইলেক্ট্রিসিটি বিলও দেয়, এটিএমের লাইনে দাঁড়ায়, মেট্রো রেলের টিকিট কাউন্টারেও, বাসের কন্ডাক্টারি করে, মেটার্নিটি লিভ নেয়, কিটি পার্টিতে যায়, জেন্ডার ইকুয়ালিটি সেমিনারেও যায়৷’ ‘এখন তো তারা সবই পারে দাদা৷ এর আগে অবশ্য কিচেন কিং বাদ দিয়ে তেমন…’৷ এতই যদি সমান সমান, এতই যদি স্বাধীন তবে ট্রেনের কামরায় ওঠার আগে ‘মহিলা’ কামরা বেছে নেওয়া কেন? ওই যে বললাম, সুরক্ষা, সাবধানবাণী, নারীত্বের বিড়ম্বনা, গোলাপির কাঁটা৷
নারীবাদী স্লোগান দিচ্ছে, ‘নো শেভ নভেম্বর’ বুলি আওড়ানো দিকপাল৷ কারণ ‘মর্দ কো দর্দ নহি হোতা’, তাই মহিলাদের দুঃখে ফাউ একটু কেঁদে নিগে যাই৷ যাই গে চাড্ডি দেশোদ্ধার করে আসি৷ ‘মর্দ’ শব্দটা আজকাল টীকা সহযোগে না এলে ঠিক বোঝা যায় না৷ তাই সাম্প্রতিক এক সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ দেখি পূর্বাপর ব্যাখ্যা সমেত তর্জমা করেছে– মেন এগেনস্ট রেপ অ্যান্ড ডিস্ক্রিমিনেশান৷ আসলে তর্জমা না করে দিলে ‘মর্দ’ শব্দটি যদি অযথা কেঁচিয়ে তোলে বিষয় গাম্ভীর্য! বলতে নেই, দিকে-দিকে রেপ-ভিডিওর পপুলারিটি যা বাড়ছে, সামান্য ১০০-৫০ টাকায় পাবেন ফুল স্যাটিসফ্যাকশন৷ ওদিকে আবার ‘ফেমিনাজি’-দের বিড়ম্বনায় সিনেমা থেকে সবলা সকলেই কেঁপে উঠছে৷ তাই তো অবতারণা এই অকাট্য পিঙ্কের৷ পিঙ্কই পাওয়ার, পিঙ্কই পদ্ম, পিঙ্কই বক্সঅফিস, ‘পিঙ্কি প্রমিস’৷
এই পিঙ্কের আড়ালে জনসংখ্যার অবদমিত অর্ধেক গর্জে উঠল৷ না, শুধু লিঙ্গহীনতা নয়, তাদের সম্বল তার চেয়েও বড়৷ তাদের সম্বল বঞ্চনা৷ প্রজন্মব্যাপী পরাধীনতার বঞ্চনা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, বিশ্বাসহীনতা, রক্তে রক্তে বহন করা অপমান৷ এই পিঙ্কের আড়ালে কেবল নারী নয়, লিঙ্গবৈষম্যের শিকার প্রতিটি মানুষ আত্মরক্ষা করলেন৷ আর এই আত্মরক্ষা ঠিক মেট্রোয়-বাসে-ট্রামে, ইন্ডিয়ান রেলওয়ে-তে লেডিস কম্পার্টমেন্টে আশ্রয় নেওয়ার মতো নয়৷ এ আরও গভীর গোপন এক সন্ত্রাস৷ এই সন্ত্রাস জন্মের পর থেকেই বহন করে ‘লেডিসপানা’ ছেলেটি, অথবা ‘টমবয়’ মেয়েটি, এই সন্ত্রাস মর্দ হতে না পারার সন্ত্রাস৷ তাই ‘মর্দ’ শব্দটি বলতে গেলে ইদানীং একটু হোঁচট খেতে হয়৷ যেন পৌরুষ আদতে গা-জোয়ারি ছাড়া বিশেষ কিছু শেখায় না৷ যেন পিঙ্ক আদতে সেই পৌরুষেরই মুখে এঁটে দেওয়া গোলাপি কন্ডোম৷
তবে কি না, যে সমাজে আলাদা করে পিঙ্ক অটো চালিয়ে প্রমাণ করতে হয় নারী স্বাধীনতা, যে সমাজে জনগোষ্ঠীর অর্ধেক মানুষ অস্তিত্ব সংকটে ভোগে আর তাই তৈরি হয় তাদের প্রতিরক্ষার তাগিদে গোলাপি অটো, সে সমাজে নারীত্বের বড়াই করা চলে না৷
যে পৃথিবীতে নারীকে নারীত্ব প্রমাণ করতে হয় সামান্য যতটুকু-যা বেঁচে থাকার সম্মানের পরিবর্তে, সে পৃথিবীতে ‘মানুষ’ শব্দটি উভলিঙ্গ নয়৷ সে দেশে লিঙ্গ কেবল অঙ্গে, লিঙ্গের ধারণা পৌঁছয় না মননে৷ লিঙ্গের ধারণা যে আদতে ক্ষমতার ধারণা, এ তাদের বোধগম্য হওয়ার কথাও নয়৷ তাই তো ক্লাস সেভেন পেরোতে না পেরোতেই ক’গাছি দাড়ি গজাল, তাই নিয়ে গজগজ শুনতে শুনতেই ব্লেড চালাতে শেখে মাকুন্দ বেহায়া৷ তার পৌরুষ যে কোথায় লুটিয়ে পড়ল সেই নিয়ে চিন্তায় বাপ-মায়ের টাক পড়তে বসেছে৷ বাবার টাক তো তাও না হয় মেনে নেওয়া যায়, মায়ের জন্য পরচুলোটা জোগাড় করতে হবে তো না কি!
গোলাপি রঙের ব্যাকক্লিপ এঁটে টাকে ফিক্স করে দিলেই হল, ব্যস!
The post নারী স্বাধীনতার নতুন খোলস- গোলাপি! appeared first on Sangbad Pratidin.