কিংশুক প্রামাণিক: পশ্চিম এশিয়া, ওয়াশিংটনের দোলাচলে একদিকে পেন্টাগন (Pentagon) চায় ইজরায়েল একেবারে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করুক যাতে ভবিষ্যতে লেবাননের হিজবুল্লার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইজরায়েল তো বটেই, ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধেও প্যালেস্তাইনের এই জঙ্গি গোষ্ঠী মাথা না-তুলতে পারে। গাজা যুদ্ধের শুরুতেই তাই হোয়াইট হাউস (White House) ইজরায়েলকে কার্যত ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দিয়ে বলেছিল, আত্মরক্ষার জন্য ইহুদি রাষ্ট্র যে পদক্ষেপই নিক না, তাতে ওয়াশিংটনের সম্মতি আছে। আর, তাতে সিলমোহর দিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তেল আভিভ ঘুরেও গেলেন। মার্কিন বিদেশমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন তেল আভিভকে কার্যত নিজের অফিস বানিয়েই পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঝটিকা সফর করে বেড়াচ্ছেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজা যুদ্ধ শুরুর দশ দিন পর থেকেই ওয়াশিংটন তার সুর বদলাতে শুরুও করেছে। তারা এ-ও বলছে ইজরায়েল ফের গাজা দখল করলে সেটা হবে ‘মহা ভুল’। মধ্য গাজার অল-আহলি আরব হাসপাতালে বোমা বর্ষণের দায় অবশ্য হামাস আর ইজরায়েল একে অন্যের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এক্ষেত্রে যদিও বাইডেন (Joe Biden) রয়েছেন নেতানিয়াহুর পাশেই।
[আরও পড়ুন: ‘টাকার জন্য বিবেক বেচে দিয়েছেন’, ‘ভুয়ো ডিগ্রিধারী’ কটাক্ষ শুনতেই মহুয়াকে পালটা নিশিকান্ত দুবের]
নিন্দুকে বলছে, এই সুর বদলের অন্য কারণও রয়েছে। গাজা যুদ্ধের দাবানল দীর্ঘায়িত হলে মূল বিপদ কিন্তু হোয়াইট হাউসেরই। তখন হয়তো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে পেন্টাগন। ইরাক-আফগানিস্তান পরবর্তী সময়ে পেন্টাগন যা কখনই চায় না। ইতিমধ্যেই ভূমধ্যসাগরে দুই মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইয়েমেন থেকে ইজরায়েল-কে লক্ষ্য করে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র রুখেছে। ইজরায়েল-ও চাপে পড়ে রাফা ক্রশিং খোলায় মিশর থেকে গাজায় ২০ ট্রাক খাবার, জল আর ওষুধ ঢুকতে দিয়েছে। ওদিকে, কায়রো সম্মেলনে আরব বিশ্ব চাপ দিচ্ছে অবিলম্বে গাজায় হামলা করার জন্য।
ওয়াশিংটনের সুরবদল?
আদতে পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক চিত্র দ্রুত পাল্টাচ্ছে। যে সৌদি আরবের সঙ্গে ইজরায়েলের শান্তি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, তা এখন মোটামুটি বিশ বাঁও জলে। রিয়াধ এখনও তেল আভিভের সরাসরি নিন্দা করেনি বটে, কিন্তু গাজায় আক্রমণ বন্ধ করতে বলছে। উপরন্তু গাজা যুদ্ধ উপলক্ষে উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য রিয়াধে ইসলামি দেশগুলোর সংগঠন ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন’ (OIC)-এর জরুরি বৈঠক ডেকেছে। অর্থাৎ, ঘটনার রাশ আর ওয়াশিংটনের হাতে না-ও থাকতে পারে। কারণ আরব দুনিয়ার সঙ্গে তেলের কারণেই মস্কো আর বেজিংয়ের সখ্য বাড়ছে (উল্লেখ্য ভারতের স্বার্থও জড়িয়ে গিয়েছে এই সৌদি-ইজরায়েল সমঝোতার সঙ্গে। চিনের সিল্ক রুটের সঙ্গে পাল্লা দিতে যে অর্থনৈতিক করিডর ভারত থেকে পশ্চিম এশিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়ার কথা, তার বাস্তব রূপায়ণ বহুলাংশে নির্ভর করছে পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর। অথচ গাজা যুদ্ধের জন্য পুরো ভূখণ্ড এখন পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগ্নেয়গিরির উপর এসে দাঁড়িয়েছে)।
[আরও পড়ুন: ‘দৃশ্যম’ ছবিই অনুপ্রেরণা! অনলাইনে বিষ নিয়ে সার্চ করে দুই বোনকে খুন, স্বীকারোক্তি দাদার]
পশ্চিম এশিয়ায় ওয়াশিংটনের অন্য দুই বহু দিনের মিত্র জর্ডন আর মিশরের গলাতেও ভিন্ন সুর। তাদের পরিষ্কার বক্তব্য, আত্মরক্ষাকে ঢাল বানিয়ে গাজাতে ২৪ লক্ষ মানুষের জল, বিদ্যুৎ, ওষুধ, খাবার সরবরাহ বন্ধ করতে পারে না ইজরায়েল। বিশেষজ্ঞরাও একে ‘ওয়ার ক্রাইম’ বা সমরকালীন অপরাধ বলেই গণ্য করছেন। জর্ডনের রাজা হুসেন আর মিশরের প্রেসিডেন্ট অল সিসি চান অবিলম্বে গাজায় ইজরায়েলি বোমাবর্ষণ বন্ধ হোক।
এ তো গেল মিত্রদের উলটোসুরের কথা! অন্যদিকে ওয়াশিংটনের ঘোষিত দুশমন ইরানও চুপ করে বসে নেই। সে দেশের বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমির-আবদোল্লাহিয়ান তো সরাসরি হুমকিই দিয়েছেন। দিয়ে বলেছেন, ইজরায়েল গাজার উপর বোমাবর্ষণ বন্ধ না করলে তার ফল ভয়ংকর হবে। পুরো আরবজগৎ ট্রিগারে হাত দিয়ে রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেহরানের মদতপুষ্ঠ সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী হিজবুল্লা তো ইতিমধ্যেই লেবানন থেকে উত্তর সীমান্তে হামলা করেছে। আর এই হামলার গুরুত্ব বুঝে লেবানন সীমান্ত বরাবর ইজরায়েল তার বাসিন্দাদের সরিয়েও নিয়েছে। পেন্টাগনের আশঙ্কা রয়েছে সিরিয়ার দিক থেকেও। তাদের হিসাবে, আসাদ বাহিনীর পিছনে কলকাঠি নাড়বে মস্কো। ঠিক যেমন তেহরানকে পিছন থেকে মদত দেবে বেজিং। অর্থ্যাৎ, গাজা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পশ্চিম এশিয়ার ঘোলা জলে মস্কো আর বেজিংয়ের নেমে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা।
ওয়াশিংটনের সমস্যা কিন্তু শুধু পশ্চিম এশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। উত্তর-পূর্ব এশিয়াতে তাইওয়ানকে গ্রাস করার জন্য যেমন সেখানে ক্রমশ যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে, দক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপিন্সের সঙ্গে চিনের ছোটখাট সংঘর্ষ প্রায়ই হচ্ছে। এই দুই জায়গাতেই চিনকে ঠেকাতে মার্কিন নৌবহরের উপর পেন্টাগন নির্ভরশীল। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমরাস্ত্র সবচেয়ে বেশি সরবরাহ করতে হচ্ছে কিয়েভকে। এখনও পর্যন্ত ৭,৫০০ কোটি ডলারের আর্থিক ও সামরিক সাহায্য ইউক্রেনকে দিয়েছে ওয়াশিংটন। কিন্তু যেখানে খোদ মার্কিন অর্থনীতির হালই নড়বড়ে, সেখানে আর কত দিন এই ধরনের সাহায্য হোয়াইট হাউস দিয়ে যেতে পারবে তার উপর বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। ইতিমধ্যেই ইউক্রেনকে দেওয়ার জন্য চিহ্নিত সমরাস্ত্রের অল্প কিছু অংশ ইজরায়েলকে দিতেও হয়েছে। তাই গাজা যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে তত দু’দিকে সমানতালে মদত দেওয়া পেন্টাগনের পক্ষে মুশকিল হবে। ইতিমধ্যে লেবাননের হিজবুল্লাকে সামলানোর জন্য ইজরায়েলি জলসীমানায় ভূমধ্যসাগরে দু’-দুটো বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করতে হয়েছে পেন্টাগনকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গাজা যুদ্ধ দীর্ঘয়িত হলে ইউক্রেন নিয়ে পেন্টাগন অন্য সমস্যায়ও পড়বে। ইজরায়েলি সেনাবাহিনী পশ্চিমী ধাঁচে গঠিত বলে তারা আকাশপথে বেশি হামলা করে। কিন্তু ইউক্রেনের সেনাবাহিনী মূলত সোভিয়েত আদলে তৈরি, যারা মূলত স্থলবাহিনী। ফলে ইজরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করা পেন্টাগনের পক্ষে তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু আড়াই বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ চলছেই ওয়াশিংটনের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সাহায্যের উপর ভর করে। এই ইউক্রেন যুদ্ধ ছেড়ে ওয়াশিংটনের বেরনোরও কোনও উপায় নেই। নয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর থেকে রাশিয়া বাদে পুরো ইউরোপের রাশই কার্যত ওয়াশিংটনের হাতে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ ফল শুধু যে ইউরোপে মার্কিন কর্তৃত্বই শেষ করবে তা-ই নয়, মার্কিন অর্থনীতির উপরও মারাত্মক আঘাত হানবে। এতেই শেষ নয়, ভ্লাদিমির পুতিনকে ঢাল করে ইউরোপের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে দাঁড়াবেন শি জিনপিং (Xi Jinping)।
এক কথায়, ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ ফল পরাশক্তি হিসাবে ওয়াশিংটনের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেবে। ইউক্রেন যুদ্ধ যে সহজে শেষ হবে না, তা ওয়াশিংটন ভালই জানে। তাই গাজা যুদ্ধও সে পথে হাঁটতে দিতে চায় না পেন্টাগন। গাজা যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হবে? গাজায় স্থল অভিযান হলেই যে হামাস (Hamas) পুরো সাফ হবে তারও কোনও গ্যারান্টি আছে কি? সারা গাজা নগর সুড়ঙ্গে ভরা। সেখানে লুকিয়ে থাকা হামাস জঙ্গিদের খোঁজা সহজ নয়। তাছাড়া, উগ্রপন্থীরা তো সহজেই জনগণের ভিড়ে মিশে পারে। তবে এই স্থল অভিযান হলে যে বিপুল প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা একমত। আর, এরই জেরে পশ্চিম এশিয়ায় ওয়াশিংটনের ভাবমূর্তি জোর ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিশেষজ্ঞদের মতে, হোয়াইট হাউস তাই আগে থেকেই অঙ্ক কষে সুর বদলাতে শুরু করেছে। যাতে দরকারে ক্যাম্প ডেভিডের আদলে কোনও শান্তি আলোচনারও পথ খোলা থাকে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
kingshukbanerjee@gmail.com