সদ্য ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক ইভান গের্শকোভিচকে সাইবেরিয়ার বন্দি শিবিরে নির্বাসিত করে পুতিনের রাশিয়া প্রমাণ করল– সব শাসকের এক রা! লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
রাশিয়ার জেলেবন্দি বিশ্বখ্যাত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিক ইভান গের্শকোভিচের শেষ পর্যন্ত ১৬ বছরের কারাদণ্ড হল। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাইবেরিয়ার কোনও বন্দি শিবিরে। রাশিয়ার এই বন্দি শিবিরগুলি স্তালিনের সময় থেকেই কুখ্যাত। সাইবেরিয়ার প্রবল শীতেও বরফ-ঠান্ডা জলে এখানে বন্দিদের স্নান করতে হয়। অসুস্থ হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি শিবিরেই প্রবল খাদ্যাভাব থাকে। কয়েক দিন আগে এই ধরনের একটি শিবিরেই রাশিয়ার বিরোধী দলনেতা আলেক্সি নাভালনির মৃত্যু ঘটেছে। জনপ্রিয় এই বিরোধী নেতাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাইবেরিয়ার বন্দিশিবিরে নির্বাসিত করেছিলেন। এই শিবিরে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য না-করতে পেরে বছর চল্লিশেকের নাভালনির মৃত্যু ঘটে। নাভালনির মৃত্যুর পর বিশ্বজুড়ে এসব বন্দিশিবিরে আটক করার মতো অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে হইচই পড়েছিল। কিন্তু তাতেও পুতিন অবিচল, তার প্রমাণ মিলল ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর তরুণ সাংবাদিককে ১৬ বছরের জন্য নির্বাসন দেওয়া থেকেই।
[আরও পড়ুন: ‘আপনার টাকা দরকার? আমি ব্যবস্থা করে দেব’, সায়ন্তিকাদের ‘জরিমানা হুমকি’তে বোসকে খোঁচা মমতার]
রুশ বংশোদ্ভূত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর এই তরুণ সাংবাদিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের খবর করতে গিয়ে গত বছরের মার্চে রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের গোয়েন্দাদের হাতে আটক হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-র হয়ে কাজ করার অভিযোগ তুলেছে পুতিন সরকার। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর দাবি, গের্শকোভিচ যে গুপ্তচর-বৃত্তিতে যুক্ত ছিলেন, এমন কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি পুতিনের সরকার। তরুণ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা বলেও একাধিকবার দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিম দুনিয়ার প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রের প্রবল চাপ সত্ত্বেও পুতিন তরুণ সাংবাদিকটিকে মস্কোর অদূরে একটি জেলে ৪৭৮ দিন আটকে রেখে বিচারের পর ১৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। রুশ আদালতে গের্শকোভিচের বিচারকে ভুয়া আখ্যা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেন যুদ্ধের খবর করতে রাশিয়ায় যাওয়া বিদেশি সাংবাদিকদের সন্ত্রস্ত করতেই পুতিনের এই শাস্তি বলে খুব স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে আমেরিকা। যুদ্ধের সময় মিথ্যা অভিযোগ এনে কোনও সাংবাদিককে ফাঁসিয়ে দেওয়া কোনও রাষ্ট্রের পক্ষেই কঠিন কাজ নয়। গের্শকোভিচের বাবা-মা ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করে আমেরিকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের সময় আমেরিকাতেই গের্শকোভিচের জন্ম। মার্কিন স্কুল-কলেজেই তাঁর শিক্ষা। কিন্তু রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির টানে ২০১৭ সালে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাতৃভূমি মস্কোয় গিয়ে গের্শকোভিচ বসবাস করা শুরু করেছিলেন। প্রথমে ‘দ্য মস্কো টাইম্স’, তারপর সংবাদ সংস্থা ‘এএফপি’-র হয়ে কাজ করতেন তিনি।
২০২২ সালে যোগ দিয়েছিলেন ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এ। তাঁর কাজ ছিল মূলত লন্ডন অফিসে। কিন্তু নিয়মিত মস্কো গিয়ে রাশিয়ার খবরই তিনি করতেন।
বিদেশি সাংবাদিক হিসাবে মস্কোয় তাঁর প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি রাশিয়ায় ঘুরে ঘুরে ওই যুদ্ধের খবর পাঠাচ্ছিলেন। এই সময়ই মস্কো থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরে ইয়েক্যাটারিনবার্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এফএসবি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, রুশ সেনাবাহিনীর ঠিকাদারের কাছ থেকে পাওয়া গোপন তথ্য সিআইএ-কে পাচার করার। গের্শকোভিচকে মুক্ত করার জন্য আমেরিকা সর্বশক্তি দিয়ে নামলেও পুতিন তাঁকে জেলে আটক করে রেখে গোপনে বিচার শুরু করেন। সেই বিচারের রায় দু’-দিন আগে বেরিয়েছে। গুপ্তচর-বৃত্তির মতো সন্দেহজনক অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বের প্রথম সারির দৈনিকের সাংবাদিককে ১৬ বছরের জন্য কারাদণ্ড আলোড়িত করে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে।
[আরও পড়ুন: শরিকদের দাবিপূরণ থেকে বেকারত্ব দূরীকরণ-একনজরে নির্মলার সেরা ১২ ঘোষণা]
গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা কখনওই নতুন নয়। স্মরণাতীত কাল থেকেই এই ঘটনা ঘটে আসছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা থেকেই জানা যায়, এই মুহূর্তে গোটা বিশ্বে বিভিন্ন ৩০০-র উপর সাংবাদিক পেশাগত কারণে অর্থাৎ খবর করার কাজ করতে গিয়েই শাসকের রোষে জেলবন্দি রয়েছেন। গের্শকোভিচের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনার সঙ্গে খুবই মিল পাওয়া যায় আমাদের দেশের কিছু দিন আগে উত্তরপ্রদেশের হাথরসে দলিত মহিলার গণধর্ষণের হত্যার ঘটনার খবর করতে যাওয়া কেরলের সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের গ্রেপ্তারের ঘটনার। রাজনীতিতে তোলপাড় ফেলে দেওয়া হাথরসের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েই কাপ্পান যোগী আদিত্যনাথের সরকারের রোষে পড়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যোগী সরকার সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সাহায্য করার অভিযোগ তোলে। জেলে আটক কাপ্পানের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা করে যোগীর সরকার।
২৮ মাস বন্দি থাকার পর কাপ্পান জামিন পান। কাপ্পানের সঙ্গে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়া’-র যোগাযোগ ছিল কি না, তা প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু খবর করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় কোনও মিথ্যা নেই। গের্শকোভিচ একইভাবে খবর করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। ভারতে এই মুহূর্তে যে ৭-৮ জন সাংবাদিক পেশাগত কারণে গ্রেপ্তার হয়ে রয়েছেন, তাঁদের অন্তত পাঁচজনের বিরুদ্ধেই কঠোর ‘ইউএপিএ’ ধারায় মামলা রয়েছে। এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁদের সকলেরই গের্শকোভিচের মতো দীর্ঘ দিনের জেল হতে পারে। কিছু দিন আগে দিল্লিতে খবরের পোর্টাল ‘নিউজক্লিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রবীর পুরকায়স্থের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা সকলের স্মৃতিতেই জীবন্ত রয়েছে। প্রবীর পুরকায়স্থকেও কঠোর ‘ইউএপিএ’ ধারা দিয়ে জেলে বন্দি রাখা হয়েছিল, সম্প্রতি তাঁকে জামিন দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ওই গ্রেপ্তারিকে অবৈধ বলেছিল।
[আরও পড়ুন: ডাকাতির ছক বানচাল! কল্যাণীতে পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার ২, উদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্র ও কার্তুজ]
সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য যুগ-যুগ ধরে রাষ্ট্রশক্তি গ্রেপ্তারির হাতিয়ার প্রয়োগ করে আসছে। ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর সাংবাদিককে গ্রেফতারের পর আরও অভিযোগ উঠেছে যে, এই সাংবাদিককে বন্দি করে তাঁর বিনিময়ে পুতিন বিভিন্ন অপরাধের কারণে আমেরিকার জেলে বন্দি রুশ নাগরিকদের মুক্ত করতে চান। গের্শকোভিচের গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে যখন বিশ্ব সোচ্চার হয়েছিল, তখনই পুতিনের তরফে এই প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। পুতিন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আমেরিকা তাঁদের কিছু বন্দিকে ছেড়ে দিলে তিনি তরুণ সাংবাদিককে মুক্তি দিতে পারেন। বিশ্বের একজন প্রথম সারির সাংবাদিককে এভাবে বন্দি করে রেখে দর কষাকষি করা এক বেনজির ঘটনা। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন-সহ সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংস্থা এসব নিয়ে যতই সরব হোক না কেন, পুতিনের মতো স্বৈরাচারী শাসকের যে এতে কোনও হেলদোলই দেখা যায় না, তা আরও একবার প্রমাণিত হচ্ছে।