শুভময় মণ্ডল: ‘৭৫-এ যখন ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, তখন হাতে গোনা কয়েকজন মুখ্যমন্ত্রীই তাঁর বিরোধিতা করেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুথুভেল করুণানিধি। সেদিন গণতন্ত্রের হয়েই সওয়াল করেছিলেন কলাইনর। যার মাশুল তাঁকে দিতে হয়েছিল পরে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তামিলনাড়ু সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সপরিবার ও সপার্ষদ ভারতের লৌহমানবীর রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল করুণানিধিকে।
ঘটনার ১৩ বছর পরে ক্ষমতায় ফেরেন করুণা। তবে অন্তর্বর্তী সময়ে নিজেকে আরও সাহসী, আরও দৃঢ়চেতা রাজনীতিক হিসাবে গড়ে তোলেন করুণা। যা তাঁকে আমৃত্যু দ্রাবিড়ভূমে পিতৃসম আসনে বসিয়ে রেখেছিল। মঙ্গলবার যখন তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভল, তখনও কিন্তু সেই সাহসী কলাইনরের স্মৃতিতে বুঁদ তামিলরা। ৫ বার মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেন করুণা। দক্ষিণী রাজনীতির ইতিহাসে যা সত্যিই বিরল ঘটনা। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত বছর দলীয় বৈঠকে ছেলে স্টালিনের হাতে ডিএমকে-এর দায়িত্বভার তুলে রাজনৈতিক সন্ন্যাসের পথ ধরলেন, তখনই মন খারাপ হয়ে যায় অনুগামীদের। তাঁর মৃত্যুতে দ্রাবিড় রাজনীতিতে একটা যুগের অবসান হল। অন্যতম এক সাহসী নেতাকে হারাল দেশ।
[প্রয়াত করুণানিধি, ৯৪ বছরে থামল দক্ষিণী রাজনীতির ‘তালাইভা’র জীবন]
জাতিপ্রথার কালো ছায়া থেকে বরাবর বেরতে চাইতেন। বংশ পরম্পরায় সংগীতকে জীবনের পাথেয় না করে অন্য কিছু করার তাগিদ ছিল তাঁর মধ্যে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আলাগিরিস্বামীর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতির পথ ধরে কিশোর করুণা। পেরিয়ারের স্বাভিমান আন্দোলনের অংশ হয়ে উত্তর ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে শামিল হয় করুণা। ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৩৭ সালে দ্রাবিড় আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ওঠেন। পেরিয়ার ও তাঁর সঙ্গী সিএন আন্নাদুরাইয়ের নজরে আসতেই পাকাপাকিভাবে রাজনীতিতে হাতেখড়ি সম্ভব হয় তাঁর। বক্তৃতায় মুগ্ধ করেন দ্রাবিড় আন্দোলনের স্রষ্টাদের। পরে দ্রাবিড় কাঝাগম পার্টির দলীয় ম্যাগাজিনের সম্পাদক পদ পান করুণা। দ্রাবিড় আন্দোলনের মুখ হিসাবেই পাঁচ ও ছয়ের দশকে রাজনীতির ময়দান দাপিয়েছেন। ১৯৫৭ সালে কুলিথালাই আসন থেকে প্রথম ডিএমকে-এর টিকিটে বিধানসভা নির্বাচনে জয়। কয়েক বছর পরে বিধানসভায় ডেপুটি বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হন।
১৯৬৯ সালে আন্নাদুরাইয়ের মৃত্যুর পর একদা বন্ধু এমজিআরের সাহায্যে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন করুণা। কিন্তু বছরদুয়েক বাদেই মন্ত্রিসভার পদ নিয়ে বিবাদে ডিএমকে ছেড়ে নতুন দল গড়েন রামচন্দ্রণ। সেই থেকে তামিল রাজনীতির দুই প্রবাদপুরুষের ঠান্ডা লড়াই শুরু। ১৯৭৬ সালে জরুরি অবস্থার সময় তামিলনাড়ুর সরকার ভেঙে দেন ইন্দিরা গান্ধী। পরের বছর বিধানসভা ভোটে এমজিআরের এআইএডিএমকে করুণানিধির দলকে হারিয়ে তামিলনাড়ুর ক্ষমতায় আসে। মুখ্যমন্ত্রী হন এমজিআর। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এরপর ১৩ বছর বাদে ফের মসনদে বসেন কলাইনর। মাঝে কাবেরী দিয়ে প্রচুর জল বয়ে গিয়েছে। এমজিআরের পর তাঁর একনিষ্ঠ জয়ললিতার সঙ্গে করুণার চিরকালীন বিবাদ ছিলই। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে আম্মার দলের কাছে বিরাট পরাজয় হয় করুণার। যার অন্যতম কারণ, ২০০৮ সালে টু-জি কেলেঙ্কারিতে দলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ রাজা ও কন্যা কানিমোঝির অভিযুক্ত হওয়া। পরে অবশ্য সিবিআই দুজনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেশ করতে না পারায় রাজা ও কানিমোঝি বেকসুর খালাস হন। কিন্তু কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোয় তামিলনাড়ুর কুরসিও হারাতে হয় করুণাকে।
রাজনীতি ছাড়াও রুপোলি জগতে অবদান ছিল করুণার। দ্রাবিড় আন্দোলনের চরম সময়ে নিজের লেখনী ক্ষমতা দিয়ে ছাপ রেখেছিলেন তামিল চলচ্চিত্র জগতেও। ইতিহাস নির্ভর কাহিনি লেখার জন্য বেশ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন করুণা। ১৯৪৭ সালে রাজকুমারি ছবির চিত্রনাট্য লেখা দিয়ে শুরু। সেই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন এমজিআর। এরপর এমজিআরের বহু ছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন তিনি। এহেন ব্যক্তিত্বর মৃত্যুতে শুধু তামিল রাজনীতিই নয়, পিতৃহারা হল দ্রাবিড়ভূমিও।
The post জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করে গদি হারিয়েছিলেন করুণানিধি appeared first on Sangbad Pratidin.