আজ বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস৷ কবির বাংলাদেশে থাকাকালীন যে জীবন এবং শেষ সময়ের একাকীত্ব, সেই সবকিছুর স্মৃতিচারণায় কবিকন্যা কল্যাণী কাজী৷
কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম পশ্চিমবাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর একটা সম্পর্ক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অতীতে গড়ে উঠেছিল৷ নজরুল তখন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, একটার পর একটা কবিতা, গান, নাটক এবং অন্যান্য রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে তিনি সেই সময় মুগ্ধ, বিস্মিত, অনুপ্রাণিত করে চলেছেন৷ তখনও ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি–কিন্তু এই ভূখণ্ড বিরাজমান ছিল এবং নজরুল তাঁর সুস্থ, সবল, যৌবনদীপ্তকালে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন৷ ওই সময় এখানকার বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে৷ বাংলাদেশের নদ-নদী, গাছপালা, সমুদ্রবিধৌত অঞ্চল এককথায় তাঁর নিসর্গ যেমন তাঁকে মুগ্ধ করেছিল, তেমনি এখানে পরিচিত হওয়া একাধিক নারী তাঁকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল৷ তাঁকে তাঁর সৃজনশীলতায় উজ্জীবিত করেছিল৷ আর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ১৯৩৯-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বেতারকেন্দ্র চালু হয়৷ ১৯৪০-এর ১২ ডিসেম্বর কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকা বেতার কেন্দ্রের একটি চমৎকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন৷ সেদিন তাঁর পরিচালনায় তাঁর লেখা সংগীত বিচিত্রা ‘পূর্বালী’ প্রচারিত হয়৷ ‘পূর্বালী’-তে যে ক’টি নজরুলগীতি ব্যবহূত হয় তার মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত গান হল ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’৷
বহু বছর পর নজরুল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যান৷ কিন্তু তখন তিনি বাকশক্তিরহিত, চিন্তাশক্তিহীন জীবন্মৃত একটা মানুষ৷ নজরুল অসুস্থ হন ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি৷ প্রায় দশ বছর তাঁর সঠিক চিকিৎসা হয়নি৷ পরে অবশ্য দেশে-বিদেশে তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ কিন্তু ততদিনে তাঁর ব্যাধি আরোগ্যাতীত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল৷
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মানচিত্রে অভ্যুদয় হল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের৷ গণতান্ত্রিক বিশ্বের ক্রমাগত চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে এবং মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন৷ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে তখন পাহাড়প্রমাণ সমস্যা৷ বঙ্গবন্ধুর সরকার সাফল্যের সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করল৷ বঙ্গবন্ধু স্বয়ং উদ্যোগ গ্রহণ করায় মন্ত্রিসভায় বৈঠকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে ঘোষণা করা ছাড়াও কবি-রচিত ঐতিহাসিক গান ‘চল্ চল্ চল’!/ উর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’ গানটিকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ‘মার্চিং সং’ হিসাবে মর্যাদা দান করা হল৷ আওয়ামি লিগ সরকার আরও ঠিক করল, কবিকে বাংলাদেশে এনে তাঁর চিকিৎসা এবং শুশ্রূষার দায়ভার বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করবে৷ ওই সময় কবিকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিক্ষোভ হয়৷ অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইন্দিরা গান্ধী শ্রদ্ধাশীল থাকায় বিরোধিতা সত্ত্বেও কবিকে ভারত সরকার বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল৷ শর্ত ছিল, অসুস্থ কবির দায়দায়িত্ব নিতে হবে এবং কবিকে ভারতের মাটিতে আবার ফিরিয়ে দিতে হবে৷ কিন্তু কবিকে ভারতের মাটিতে ফিরিয়ে আনা যায়নি৷ সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷
১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ বিমানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হল তাঁর ৭৩তম জন্মদিন স্বাধীন বাংলাদেশে উদ্যাপন করার জন্য৷ আমরা অর্থাত্ পরিবারের সদস্যরাও তাঁর সঙ্গে ঢাকায় গেলাম৷ প্রায় আধঘণ্টার মধ্যে কবিকে নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করল বিমানটি৷ জগাঁও বিমানবন্দরে এক বিশাল জনতা ফুলের মালা হাতে বাংলাদেশের জাতীয় কবিকে স্বাগত জানানোর জন্য উন্মুখ৷ তাদের মধ্যে কবিকে কে আগে ফুলের মালা পরাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল৷ বিমান অবতরণের পর সিঁড়ি লাগানো সম্ভবপর হচ্ছিল না৷ এদিকে কবি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন৷ তখন বিমানের পিছনের দরজা দিয়ে কোলে করে অ্যাম্বুল্যান্সে উঠিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে বিমানবন্দরের উত্তর ফ্লাইং ক্লাবের রাস্তা ধরে শহরে নিয়ে আসা হল৷ অসুস্থ কবির বসবাসের জন্য নিরিবিলি পরিবেশে চমৎকার ঘাসের আঙিনা-সহ সরকারি মালিকানাধীন বাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ বঙ্গবন্ধু নিজে এই বাড়িটা পছন্দ করেছিলেন এবং নামকরণ করেছিলেন ‘কবিভবন’৷ বাড়িটা সবকিছু দিয়ে সাজানো ছিল৷ কবিকে রোজ বিকেলে খোলা মাঠে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি ও ড্রাইভার ছিল৷ ২৪ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে এলেন৷ জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেদিন থেকেই কবিভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করা হল৷ কবির নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গঠিত হল মেডিক্যাল বোর্ড৷
১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় মহাসমারোহে উদযাপিত হল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী৷ রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের ব্যক্তি-সহ বিভিন্ন্ স্তরের লোকজন এসেছিল কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে ফুলের মালা হাতে৷ অনেক কণ্ঠসংগীত শিল্পী কবিকে গান শোনান৷ সেদিন তাঁকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল৷ শুধু জন্মদিনেই নয়, প্রতিদিন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায় বহু ভক্তের সমাগম হতে থাকল৷ ‘কবিভবন’ হয়ে উঠল ‘কবি তীর্থ’৷ সব্যসাচীর স্ত্রী উমা কাজী কবির সঙ্গে ঢাকায় থেকে গেলেন৷ ঢাকায় গিয়ে বাবা ভাল আছেন–শরীরের উন্নতি হচ্ছে, এই কারণ দেখিয়ে কবিকে আর ভারতে ফেরত পাঠানো হল না৷
আনন্দ-বেদনার মাঝে কবির প্রায় তিন বছর ঢাকায় কেটে গেল৷ কবির কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধর ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রূয়ারি অকালপ্রয়াণ ঘটল৷ আগে আমরা প্রায়ই ঢাকায় বাবাকে দেখতে যেতাম৷ এরপর স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত বাবাকে দেখতে ঢাকায় যেতে পারতাম না৷ তবে নিয়মিত খবর রাখতাম৷ পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেল কবির আত্মীয়স্বজন, যাঁদের উপর কবির পরিচর্যার ভার ছিল তাঁরা দূরে সরে গিয়েছেন৷ সব্যসাচীর স্ত্রীও বাবাকে ছেড়ে অন্যত্র নতুন করে সংসার পেতেছিলেন৷ ফলে কবির যতটুকু মনোযোগের দরকার ছিল তা থেকে তিনি বঞ্চিত হচ্ছিলেন৷ কবির সুস্থ অবস্থার খাস পরিচারক কিশোর সাউ, যুদ্ধের সময় যাঁর মাথার গন্ডগোল দেখা দিয়েছিল, কবির একান্ত নিজের লোক হিসাবে কবির দেখাশোনা করত এবং তাঁর কাছে শেষদিন পর্যন্ত ছিল৷
কবিকে যে ডাক্তার দেখতেন তিনি বঙ্গবন্ধুকে কবির পরিস্থিতির কথা জানালেন৷ তখন বঙ্গবন্ধু কবিকে পিজি হাসপাতালে রাখার বিধান দিলেন, যেখানে কবির সেবা ও চিকিত্সার খামতি হবে না৷ কবিভবন থেকে কবিকে স্থানান্তরিত করা হল পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে৷ পরিবর্তিত পরিবেশে কবির স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়৷ খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনও অনীহা ছিল না, বরং শান্তভাবে তৃপ্তির সঙ্গে তিনি খাওয়া-দাওয়া করতেন৷ লোকজনের ভিড় এখানেও কম ছিল না৷ তবে হাসপাতালের বিধান অনুযায়ী সেটা ছিল সুশৃঙ্খল৷ কোনও কোনও শিল্পী এখানে এসে তাঁকে গান শোনাতেন৷ কবি খুশি হতেন, মাঝে মাঝে কেবিনের ভিতর, আবার কখনও কেবিনের বারান্দায় পায়চারি করতেন তিনি৷ আবার কখনও উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতেন দূর আকাশের নীলিমায়৷ ২৭ আগস্ট শুক্রবার বিকেল ৪টার সময় কবি সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হন৷ জ্বর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে৷ শনিবার সকাল ১০/১১টা নাগাদ জানা গেল কবির ব্রঙ্কো নিউমোনিয়া হয়েছে৷ তাঁকে ওষুধ দেওয়া হল৷ পথ্য হিসাবে দেওয়া হল দুধ ও পাউরুটি৷ জ্বর ক্রমশই বাড়তে থাকে৷ কবি তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন৷ তাঁকে অক্সিজেন দেওয়া হল৷ বুকে কফ জমে গলায় একধরনের শব্দ হচ্ছিল৷ এগুলি বের করার জন্য সাকশান মেশিন লাগানো হল৷ অবশেষে চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০মিনিটে আমাদের ছেড়ে মহাপ্রয়াণের পথে যাত্রা করলেন কবি৷ তখন তাঁর পাশে কোনও স্বজন উপস্থিত ছিল না৷ খবর পেয়ে সব্যসাচী এবং আমি বাবাকে শেষ দেখা দেখতে ঢাকায় গেলাম৷ পৌঁছতে দেরি হওয়ায় তখন সামরিক মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কবির ইচ্ছামতো মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়৷ তাই বাবাকে অন্তিম সময়ে দেখতে পাইনি৷ তাঁর কবরের মাটি এনে চুরুলিয়ায় মা’র কবরের পাশে রেখে বেদি তৈরি করা হয়েছে৷
একবছর এক মাস আট দিন ১১৭ নং কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবা৷ তাঁর আর কবিভবনে ফেরা হয়নি৷ নজরুল বলেছেন, ‘যদি কোনওদিন আপনাদের প্রবল প্রেমের টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরমশূন্য থেকে অসময়েই নামতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল৷ সে নজরুল অনেক দিন আগে, মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে৷ মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধারায় এসেছিল–অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল৷’
The post তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা appeared first on Sangbad Pratidin.