বিশ্বদীপ দে: দেশভাগ এমন এক অধ্যায় যা আজও দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে গিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সেই ইতিহাস প্রবাহিত হয়ে চলেছে এক বিষাদঘন কাহিনির মতো। যে কাহিনি বলতে বসলে বহু দিক ফুটে উঠতে থাকে। আর সেই সময়ই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, কলকাতা হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়েই যেত! আজ ভাবলে অবাক লাগে। গোটা বাংলাই যদি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেত কী হত তাহলে? হয়তো কোনও লেখক অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি হিসেবে তা লিখেও ফেলতে পারেন। আমাদের এই লেখার বিষয় অবশ্য তা নয়। বরং একবার ফিরে দেখা, কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল? আর কী করেই বা কলকাতা শেষপর্যন্ত থেকে গেল ভারতেই?
১৯৪৬ সাল। একদিকে তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুসলিম লিগ (Muslim League) পাকিস্তানের (Pakistan) দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। নিজের দাবি পূরণ করতে মহম্মদ আলি জিন্না তখন যে কোনও পদক্ষেপে মরিয়া। ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছিল, বাংলা দুভাগে বিভক্ত হচ্ছেই। কেননা জনসংখ্যার হিসেবে পূর্ববঙ্গে মুসলিমরা সংখ্যাগুরু। ফলে তাদের পাকিস্তানের অন্তর্গত হওয়া নিশ্চিত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছিল কলকাতা নিয়ে। আসলে পূর্ববঙ্গে মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য যেমন ছিল, তেমনই ছিল কারখানার কাঁচা মালের বিপুল রসদ। অন্যদিকে অধিকাংশ কারখানা কলকাতায়। ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে ও কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গ ভারতে গেলে প্রচুর সম্পদ নষ্ট হওয়ার কথা।
[আরও পড়ুন: ১০ লাখ থেকে ৩ বছরে ১০ কোটি সম্পত্তি শিশিরের! ‘কোন জাদুতে’, প্রশ্ন কুণালের]
তাই পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করে তুলতে গেলে কলকাতার অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করা হচ্ছিল। সেই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সুরাবর্দি। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক অন্যতম সমর্থনকারী। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ পার্টির নেতা সুরাবর্দির পরিকল্পনাই ছিল কলকাতাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা। আর সেই পরিকল্পনাকে সত্যি করতে তিনি মতলব আঁটছিলেন। এর পরই আসে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট। ভারতের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। কেননা সেদিনই শুরু হয় ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’। চারদিন ধরে চলতে থাকা এই হানাহানিতে মৃতের সংখ্যা নাকি ছাড়িয়েছিল দশ হাজার! ইতিহাসবিদ সুরঞ্জন দাস একেই চিহ্নিত করেছেন ‘পার্টিশন রায়টস’ নামে।
আসলে ১৬ আগস্ট দিনটাকে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ হিসেবে পালন করবে বলে আগেই হুঙ্কার দিয়েছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ। পৃথক মুসলিম দেশের দাবিতে এই ডাক। আর নিজেদের লক্ষ্যপূরণে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়াও শুরু করে তারা। সুরাবর্দির প্ররোচনায় এই দিন গোটা বাংলা জুড়েই ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতি এমনিতেই গনগনে ছিল। ফলে শেষপর্যন্ত সেই কালো দিনটায় শুরু হয়ে যায় ভয়ংকর হানাহানি। ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের মুখে বহু মানুষ কলকাতা ছেড়ে পালাতে থাকেন। হাওড়া স্টেশনে কাতারে কাতারে মানুষ! সে এক ভয়ংকর সময়। যেন জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখছিলেন মানুষ। অকাতরে খুন, লুটপাট, ধর্ষণ… বহু দশক পেরিয়ে এসেও সেই সময়কাল যেন দগদগে। সুরাবর্দির মতলব ছিল যদি হিন্দুরা কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যান, তাহলে তা মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হয়ে উঠবে। ফলে অনায়াসে কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
[আরও পড়ুন: ‘পাশে আছে ভারত’, ‘প্রচণ্ড’ চিনপন্থী নেপালকে আশ্বাস মোদির]
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। রুখে দাঁড়াল গোপাল মুখোপাধ্যায় ও তাঁর ভারতীয় জাতীয় বাহিনী। এই গোপালকে সকলে চেনে ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে। মেডিক্যাল কলেজের পাশে ছোট্ট মাংসের দোকান চালাতেন। পাঁঠার মাংসের দোকান। আর তাই তাঁর এমন নাম। বলা হয় গোপালের প্রতিরোধে পরিস্থিতি বদলায়। শেষপর্যন্ত ২০ আগস্ট পরিষ্কার হয়ে যায় মুসলিম লিগের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। এর পরই পিছু হটতে শুরু করে মুসলিম লিগ। ফলে কলকাতার পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে যায়।
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে কয়েক দশক। আজও ওই অধ্যায় রয়ে গিয়েছে ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হিসেবে। আসলে কিছু কিছু ঘটনা সব কিছুকে চিরকালের জন্য বদলে দিয়েছিল। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তেমনই ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগের অধ্যায়। পাঞ্জাব ও এই বঙ্গদেশ টুকরো হওয়ার পর সবই বদলে যায়। সেই ইতিহাস, সেই অতীত বারবার তাই পুনরাবৃত্ত হয়। হতেই থাকে।