অর্ণব আইচ: ওএমআর শিটের ফাঁকা গোল অংশ ভরানোর জন্য রীতিমতো লোক নিয়োগ করেন অয়ন শীল। রাজ্যের ৬০টি পুরসভার ওএমআর শিট তৈরির বরাত পাওয়ার সূত্রেই অয়নের পক্ষে নিয়োগ দুর্নীতির কাজ সহজ হয়ে যায় বলে দাবি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের।
এদিকে, মঙ্গলবার ব্যাঙ্কশালের বিশেষ ইডি আদালতে ইডির পক্ষে দাবি করা হয়েছে যে, সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতর কুন্তল ঘোষকে জেরা করে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। ২০১২ ও ২০১৪ সালের অযোগ্য টেট পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে একশো কোটি টাকা তুলেছেন অয়ন শীল। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যর সহযোগিতায় ওই টাকা তোলেন অয়ন। ওই টাকা অয়ন ও মানিক ভট্টাচার্যের কাছে গিয়েছিল বলে অভিযোগ। আবার ওই টাকার অংশ কুন্তলের মাধ্যমে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গিয়েছে বলেও অভিযোগ ইডি আধিকারিকদের।
[আরও পড়ুন: সিভিক ভলান্টিয়ারদের কাজ কী? রাজ্যকে গাইডলাইনস তৈরির নির্দেশ হাই কোর্টের]
আদালতে ইডি মানিক ভট্টাচার্যর জামিনের বিরোধিতা করেও অয়ন শীলের প্রসঙ্গ তুলে জানায়, সম্প্রতি অয়নকে গ্রেপ্তার করে ২০১৪ সালের টেট ছাড়াও ২০১২ সালের টেট দুর্নীতি সামনে এসেছে। যেহেতু অয়নের সঙ্গে মানিকের যোগাযোগ ছিল ও ইডির হেফাজতে থাকাকালীন অয়নকে জেরা করা হচ্ছে, তাই মানিক ভট্টাচার্যকে এখন জামিন দেওয়া যাবে না। এদিন মানিক ভট্টাচার্যকে ১৮ মে পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।
ইডির আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি আদালতে জানান, এসএসসি ছাড়াও মোটা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পুরসভার ওএমআর শিট কারচুপি করে খালাসি, চালক, সাফাইকর্মীও নিয়োগ করা হয়েছে। পিএমএলএ আইন অনুযায়ী, এই বিষয়টি ইডির পক্ষ থেকে সিবিআইকে তদন্ত করে দেখার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এই ব্যাপারে আরও বিস্তারিত তথ্য পেতে শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অয়ন শীলকে মুখোমুখি জেরা করছে ইডি। টেট সংক্রান্ত তথ্য পেতে ইডির দপ্তরে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সেক্রেটারিকে তলব করা হয়েছে। শান্তনু ও অয়নের মোট ন’টি জায়গায় তল্লাশি হয়েছে বলে দাবি ইডির।
ইডির সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন পুরসভার নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ওএমআর শিট তৈরির বরাত পেয়েছিল হুগলির অয়ন শীলের সংস্থা। পুরসভাগুলির চেয়ারম্যানদের সঙ্গেও অয়নের যোগাযোগ ছিল বলে দাবি ইডির। ফলে নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন অয়ন। ওএমআর শিট পূরণ করতে অনেকেই ভুল করেন। যাতে ওএমআর শিটের ফাঁকা গোল অংশ ভাল করে পূরণ করা যায়, তার জন্য মাইনে দিয়ে রীতিমতো লোক রাখেন অয়ন। তাঁদের বলে দেওয়া হত, কোন চাকরিপ্রার্থীর শিট কীভাবে পূর্ণ করলে তিনি কত নম্বর পেতে পারেন। সেইমতো একেকজন ৭০ শতাংশ বা তার বেশিও নম্বর পেয়েছেন। সেই নম্বর কম্পিউটারেও উঠেছে। এভাবে অযোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ।
[আরও পড়ুন: এবার রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটককে ডাকল ইডি, আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে হাজিরার নির্দেশ]
অয়নের সল্টলেকের অফিস থেকে পুরসভায় বেআইনি নিয়োগ সংক্রান্ত বহু নথি উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন পুরসভার ‘পিওন’, ‘হেল্পার’, ‘মজদুর’ পদে নিয়োগের আসল ওএমআর শিট। ওএমআর শিট যে আসল, তার প্রমাণ তাতে পরীক্ষার্থীদের সই। গত ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ ও কলকাতা প্রাইমারি স্কুল কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে একটি আদালতের নির্দেশ উল্লেখ করে চিঠিও উদ্ধার হয়েছে। ৫২ জন প্রশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীর নাম, রোল নম্বর, ববার নাম, ঠিকানা সহ বিস্তারিত তথ্য ও তার সঙ্গে যত টাকা তাঁরা দিয়েছেন, তার তালিকাও রয়েছে। পানিহাটি সহ বিভিন্ন পুরসভার বহু চাকরিপ্রার্থীর নাম, পদ, রোল নম্বরের তথ্য উদ্ধার করেছে ইডি। উদ্ধার হয়েছে টাকি পুরসভার একটি ‘দ্বিতীয় তালিকা’য় ৪২ জন চাকরিপ্রার্থীর নাম, বাবার নাম, জন্মতারিখ, যার শংসাপত্র দিয়েছেন এক কর্তা। চাকরিপ্রার্থীদের যোগদান সংক্রান্ত বিষয়ে দক্ষিণ দমদমের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে লেখা একটি চিঠি। কলকাতা পুরসভার কর্তাদের উদ্দেশ্য করে প্রণব মণ্ডল নামে এক ব্যক্তির চিঠিও ইডি উদ্ধার করেছে। ২৪ জনের নামের তালিকা ও তাঁরা কত টাকা দিয়েছেন, আপার প্রাইমারি, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শিক্ষক প্রার্থীদের নাম, মোবাইল নম্বর উদ্ধার হয়েছে। প্রাথমিকের চাকরি নিয়ে স্কুল দফতরের কমিশনারকে লেখা চিঠি পাওয়া গিয়েছে। ওই উদ্ধার হওয়া দুর্নীতির নথিগুলি পরপর খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেগুলি সামনে রেখে অয়ন শীলের জেরা চলছে বলে জানিয়েছে ইডি।