গৌতম ব্রহ্ম: এক ঝটকায় প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। আবার সঞ্জীবনী-স্পর্শে প্রাণ দিতেও তার জুড়ি মেলা ভার। এ হেন এক প্রাণঘাতী সাপের বিষ (Snake Venom) থেকে তৈরি হচ্ছে নিমেষে রক্তপাত ঠেকানোর মহাষৌধ। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলা হচ্ছে ‘সুপার গ্লু’ (Super Glue)। আর এতেই অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি কমিয়ে অপারেশন থিয়েটারে বিপ্লব আনা সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
দক্ষিণ আমেরিকার ল্যান্সহেড স্নেক (Lancehead Snake), বৈজ্ঞানিক নাম বোথ্রপস এট্রকস। এক ছোবলে মৃত্যু প্রায় অবশ্যম্ভাবী। অথচ এই ভয়ংকর সরীসৃপের বিষকে ব্যবহার করেই তৈরি করা হয়েছে এক জৈব আঠা, ক্ষতস্থান জুড়ে রক্তপাত বন্ধ করতে যা সময় নেয় নামমাত্র। স্রেফ ৩৪ সেকেন্ডে তা ইঁদুরের কাটা লেজ জুড়ে দিয়েছে। লিভারের দু’টো অংশ জুড়তে সময় নিয়েছে সাকুল্যে ৪৫ সেকেন্ড, মানে এক মিনিটেরও কম। তবে শুধু ক্ষতস্থানে বা কেটে যাওয়া অংশে আঠা দিলেই হবে না, ক্ষতস্থানে জোরাল আলোও ফেলতে হবে। আলোর সঙ্গে মিশে কাজ করবে এই ‘সুপার গ্লু’। মশারির মতো জালিকা বানিয়ে রক্তপাতও বন্ধ করবে। বর্তমানে অস্ত্রোপচারের সময় সার্জনরা যে আঠা ব্যবহার করেন, তা রক্তপাত ঠেকাতে পাঁচ থেকে ছ’মিনিট সময় নেয়। ‘সুপার গ্লু’ সে কাজই করবে মাত্র ৩৪ থেকে ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে। এহেন মহৌষধের সন্ধান পেয়ে চিকিৎসকমহল স্বাভাবিকভাবেই আশাবাদী।
[আরও পড়ুন: কলকাতা হাই কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির এজলাস বয়কটের সিদ্ধান্ত প্রবীণ আইনজীবীদের]
বর্তমানে চালু বিভিন্ন ‘গ্লু’ নিয়ে অন্য সমস্যাও রয়েছে। এগুলি মূলত পলিইথিলিন গ্লাইকল এবং সায়ানো এক্রিলেটসের মতো কৃত্রিম রাসায়নিক দিয়ে তৈরি। শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক, তাই বেশি প্রয়োগের উপায় নেই। অনেক সময় প্রয়োগস্থানে প্রবল জ্বালা-যন্ত্রণাও হয়। আবার প্রাকৃতিক অন্যান্য আঠার কার্যকারিতা নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন রয়েছে। বেশি রক্তপাত ঠেকানোর ক্ষমতা সেগুলির নেই। এমতাবস্থায় নিরাপদ ও কার্যকরী একটি জৈব আঠার সন্ধানে ল্যাবরেটরিতে দিন-রাত এক করছিলেন কানাডা ও চিনের একদল বিজ্ঞানী। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল মিলেছে, ল্যান্সহেড সাপের বিষের মধ্যে হদিশ মিলেছে ব্যাকট্রোসোবিন বা রেপটিলেজ এনজাইমের, যে উৎসেচকটি রক্ত জমাট বাঁধার আসল কারিগর। ল্যান্সহেডের কামড়ের পর নির্গত বিষ রক্তনালির ভিতরকার রক্ত জমাট বাধিয়ে দেয়।
বিশ্ববন্দিত সায়েন্স গোষ্ঠীর ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ল্যান্সহেড সাপের বিষে রয়েছে রেপটিলেজ নামক উৎসেচক বা এনজাইম। এটি সহজেই রক্তের ফাইব্রিনোজেন প্রোটিনকে ভেঙে সুতোর আকারে ফাইব্রিন প্রোটিন তৈরি করে, যা জালকের মতো কাজ করে রক্তকণিকাদের আটকে দেয় ও রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ায় ইন্ধন জোগায়। এই স্বাভাবিক অথচ ভয়ংকর প্রাকৃতিক ঘটনাকে ভিত্তি করে একদল গবেষকদল এমন একটি জৈব আঠা তৈরিতে উৎসাহিত হয়েছিলেন, যা রক্তক্ষরণ রুখে দিতে সক্ষম। প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন কোলাজেন সংগ্রহ করে প্রথমে তা থেকে জিলাটিন প্রোটিন তৈরি করা হয়। রাসায়নিকের সাহায্যে তাকে সামান্য পরিবর্ধন করে পাওয়া যায় মিথাইল অ্যাক্রিলেট জিলাটিন।
আপাত নিরীহ এই তরল বস্তুটি আলোর সংস্পর্শে এলে একটা ‘ক্রশ লিংকড প্রোডাক্ট’ পাওয়া যায়, যা আদতে মজবুত বুননের একটি মশারির জালির মতো। একে কাজে লাগিয়েই গবেষকদল এই জৈব আঠা তৈরি করেছেন। যাতে রয়েছে রেপটিলেজ ও মিথাইল অ্যাক্রিলেট জিলাটিন। তা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে টর্চের আলো ফেললে ক্ষত জায়গায় জিটালিন ক্রস লিংকিংয়ের জন্য চাদর তৈরি হবে এবং রেপটিলেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ফ্রাইব্রিন তৈরি হয়ে রক্তকণিকার চারপাশটা বেঁধে ফেলবে। গবেষণাপত্র উদ্ধৃত করে এমনটাই জানিয়েছেন অধ্যাপক ডাঃ সিদ্ধার্থ জোয়ারদার।
এই সুপার গ্লু প্রাথমিক চিকিৎসাতেও গেম চেঞ্জার হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। তাঁদের অনুমান, পথদুর্ঘটনায় জখম ব্যক্তির রক্তপাত ঠেকাতেও এই আঠা বড় ভূমিকা নিতে পারে। পিজি হসপিটালের সার্জারির অধ্যাপক ডাঃ দীপ্তেন্দ্র সরকারের প্রতিক্রিয়া, “সার্জারির ক্ষেত্রে রক্তপাত বন্ধ করাটা খুব বড় চ্যালেঞ্জ। এই ‘সুপার গ্লু’ সে ক্ষেত্রে আমাদের কাজ অনেক সহজ করে দিতে পারে। তবে দীর্ঘ হিউম্যান ট্রায়াল প্রয়োজন। প্রার্থনা করি, রোজকার জীবনে এই সর্পবিষের আঠা যেন আশীর্বাদ হয়ে ওঠে।”