সুমন করাতি, হুগলি: উল্কার গতিতে একদিন উত্থান হয়েছিল। তবে শেষটা ছিল বেশ করুণ। তাঁর পোশাকি নামের জনপ্রিয়তায় হারিয়ে গিয়েছিল আসল পরিচয়। তিনি হুগলির শ্যামল দাস। এই নামে তাঁকে চিনতে অনেকেরই অসুবিধা হবে। কিন্তু যদি বলা হয় হুব্বা শ্যামল, তাহলে একবাক্যে তাঁকে সবাই চিনতে পারবেন। শুক্রবার রিলিজ হচ্ছে সেই ত্রাসের জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমা ‘হুব্বা’। সেই সিনেমা নিয়ে কতটা আগ্রহী হুগলির বাসিন্দারা? এখনও কি তাঁদের স্মৃতিতে রয়েছে সেই সন্ত্রাসের পরিমণ্ডল? সেই রক্তঝরা দিনের ছবি? একদিকে আতঙ্কের মুখ হলেও আরেক দিকে ছিলেন ‘মসিহা’। প্রকাশ্যে না এসেও আড়াল থেকে সাহায্য করে গিয়েছেন বহু মানুষকে। একই মানুষের দুই সত্ত্বা।
হুগলিবাসী ভুলতে পারেননি তাঁর সময়ের সন্ত্রাসের আবহাওয়া। ভুলতে পারেননি তাঁর মানবিক মুখের ছবিও। লোকমুখে প্রচলিত হুব্বা শ্যামল কোথাও যেন এক বিন্দুতে এসে মিলছেন কলম্বিয়ার সেই কুখ্যাত গ্যাংস্টার পাবলো এসকোবারকে। পাবলো যেমন পড়শিদের সাহায্য করতেন। একটা রবিনহুড ইমেজ ছিল তাঁর। হুগলির হুব্বা শ্যামলও ছিলেন সেরকমই। গরিবের মসিহা, রবিনহুড।
হুব্বাকে নিয়ে সিনেমা তৈরি হলেও তেমন প্রভাব নেই এলাকায়। এলাকাবাসী বলছে, এখন মানুষ শান্তি চায়। তৃণমূল জমানা অশান্তি থেমেছে। শান্তি ফিরেছে। তাই আগের সেই কালো স্মৃতি না ফেরাই ভালো! সেটা সিনেমা হলেও নয়। তবে হুব্বা মানেই শুধু সন্ত্রাস নয়, আড়ালে লুকিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোও।
হুগলির কোন্নগরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ধর্মডাঙা এলাকায় থাকতেন শ্যামল। ওই এলাকাতেই ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। হুব্বা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সেই সময় ওই এলাকার এক পুলিশ কর্তা বলছেন, ‘আমরা জানতাম, পড়াশোনা সেভাবে কোনওদিনই শেখেননি শ্যামল। বাবা একটি কারখানায় কাজ করতেন। সেসময় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।” আটের দশকে অপরাধে হাতেখড়ি হয় শ্যামলের। প্রথমে ছিঁচকে চুরি, ছিনতাই. তার পরে ডাকাতি। নয়ের দশকে শ্যামল হয়ে উঠলেন ‘হুব্বা শ্যামল’। প্রধান কাজ, শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন বন্ধ কারখানা থেকে মাল লুঠ করা। তৈরি করেন নিজের দল। এরপর ধীরে ধীরে প্রোমোটারি এবং জমির দালালিতে নামেন তিনি।
[আরও পড়ুন: জন্মের প্রমাণপত্র হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয় আধার! বড় সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের]
রিষড়া, কোন্নগরের এলাকায় প্রথম ‘অপারেশন’ শুরু। তাঁর ‘মস্তানি’ হুগলির ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে হাওড়া এবং দুই ২৪ পরগনাতেও ছড়িয়েছিল। কয়েকশো যুবক ছিলেন তাঁর দলে। তাঁদের মাস মাইনে ছাড়াও ছিল নানা রকম সুযোগ সুবিধা। ফলে দলে নাম লেখাতে চাইত অনেকেই।
পুলিশ সূত্রে খবর, ৩০-৪০টির মতো মামলা ছিল শ্যামলের বিরুদ্ধে। ২০০৮ সালে প্রথম তাঁকে জেলে যেতে হয় একটি মামলায়। পরে অবশ্য জামিন পেয়ে গিয়েছিলেন। ২০১০ সালে শ্যামল সরাসরি রাজনীতির ময়দানেও নামেন। পুরভোটে রিষড়া পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন জমা দেন। অন্তত ৫০-৬০টি গাড়ি এবং শতাধিক বাইকের মিছিল নিয়ে সে শ্রীরামপুর মহকুমা শাসকের ভবনে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়েছিলেন। শক্তি প্রদর্শনই ছিল মূল লক্ষ্য। এ নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়। চাপ আসে নানা দিক থেকে। শেষে শ্যামল মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন। ২০১১ সালে ফের তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আবার জামিন পান তিনি।
স্ত্রী, দুই মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার ছিল শ্যামল দাসের। স্থানীয়দের দাবি, পরিবারের প্রতি বিশেষ যত্নবান ছিলেন তিনি। সঙ্গে কিছু মানুষের কাছে মসিহাও ছিলেন। কিন্তু সেই ‘মসিহা’রও খুন করার অভিনব পদ্ধতি ছিল। সেই সমস্ত পদ্ধতিরও নানান নাম ছিল। সেইসব কিন্তু গুজব নয়, একদম সত্যি বলছেন পুলিশ কর্তারা।
[আরও পড়ুন: সমরশক্তিতে শীর্ষে আমেরিকা, তালিকায় কত নম্বরে ভারত ও চিন?]
তার পর? ২০১১ সালে চারদিন ধরে ‘নিখোঁজ’ থাকার পর তাঁর পচাগলা দেহ মেলে বৈদ্যবাটি খালে। সে সময় তাঁর বয়স ছিল প্রায় ৪৫। গলার নলিকাটা ছিল বলেই জানা যায়। তৎকালীন পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী সাংবাদিকদের এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “পুলিশের খাতায় শ্যামল দাস এক জন দাগি দুষ্কৃতী। তাঁর নামে খুন, জখম, তোলাবাজি-সহ নানা অভিযোগ রয়েছে। পুরো ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ শ্যামল খুনের পিছনে আরও এক নামকরা দুষ্কৃতীর কাজ ছিল বলেই মনে করা হয়।
সেই কাজ করেছিল ওই মাথার ডান হাত নেপুর, অন্তত অভিযোগ ছিল তেমনটাই। হুব্বা শ্যামলের হাত ধরেই হয় নেপুর উত্থান। পরে সে অপরাধ জগতের আর এক মাথার ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। শ্যামলকে সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ নেপুর বিরুদ্ধে ওঠে সে সময়। হুব্বার দলের বাপ্পা, শঙ্কু, পোলট্রি বুড়ো, সত্য, আফজলরা ধীরে ধীরে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়। হুব্বা সাম্রাজ্যের পতন হয়, অন্য আরেক জনের সাম্রাজ্যের শুরু হয়।
এই হুব্বাকে নিয়ে বাংলায় ছবি তৈরি করেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ব্রাত্য বসু। হুব্বার চরিত্রে দেখা যাচ্ছে, মোশারফ করিমকে। হুব্বার চরিত্র নিয়ে সিনেমা হওয়া খুব একটা অবাক করেনি পুলিশ কর্তাদেরই।
তবে এলাকার ত্রাসকে নিয়ে সিনেমা নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই এলাকার মানুষের। এলাকার মানুষের একটাই কথা, সিনেমায় ফিরছে ফিরুক কিন্তু কোন্নগর, রিষরা, কানাইপুর এলাকার আগের সন্ত্রাসের দিন যেন আর না ফেরে।
দেখুন ভিডিও: