ভোটের প্রচারে প্রধানমন্ত্রীর আক্রমণে উঠে এল পাকিস্তান। তাঁর অভিযোগ, পাকিস্তান চাইছে রাহুল গান্ধী এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হোক। কংগ্রেস এর পালটা দিয়ে বলেছে, নওয়াজ শরিফ চান মোদি সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক। ন্যারেটিভের এই লম্ফঝম্ফে ভোটের প্রধান প্রধান ইস্যু– বেকারত্ব, অসাম্য, মূল্যবৃদ্ধি থেকে যাচ্ছে আড়ালে। লিখলেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
পাকিস্তানকে ভোটের প্রচারে এনেই ফেললেন নরেন্দ্র মোদি (PM Modi)! লাগাতার প্রতিটি সভায় তিনি বলে চলেছেন, পাকিস্তান কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চাইছে। মোদি কীসের ভিত্তিতে এই কথা বলছেন তার কোনও সুস্পষ্ট জবাব নেই। তবে ইমরান খানের আমলের পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী চৌধুরী ফাওয়াদ হুসেনের ‘এক্স’ হ্যান্ডলে করা ‘পোস্ট’ মাথায় রেখে মোদি এই কথা বলছেন বলে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের এই প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী রোজ-ই নানারকম পোস্ট করে থাকেন। সেসব পোস্টে মোদি বা বিজেপির সমালোচনাও থাকে। সেরকম কিছু পোস্টকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তানকে ভোটের প্রচারে টেনে আনা এক অভিনব ঘটনা।
প্রাক্তন পাক-প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত কয়েক মাস ধরে জেলে বন্দি। অতএব তঁার তথ্যমন্ত্রীর করা পোস্টকে কোনওভাবেই পাকিস্তানের চাওয়া-পাওয়া বলা যায় না। মোদির পাক-আক্রমণের কড়া জবাব দিচ্ছে কংগ্রেসও। কংগ্রেসের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে প্রশ্ন তুলেছেন, পাক-প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সখ্য কার? নওয়াজের মেয়ের বিয়েতে বিনা নিমন্ত্রণেই যে মোদি আচমকা হাজির হয়েছিলেন, সে-কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। কংগ্রেসের তরফে এ-ও বলা হচ্ছে যে, দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে মনমোহন সিং একবারের জন্যও পাকিস্তান যাননি। অথচ, মোদি চেয়ারে বসার পরই নওয়াজ শরিফের বাড়িতে অাচমকা হাজির হয়েছিলেন। বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসাবে নওয়াজ শরিফ-ই যে মোদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে ফের বসাতে উদে্যাগী হয়েছেন, সে-কথা দাবি করেছেন খাড়গে। সে-কারণে মোদির সুবিধা করে দিতেই শরিফ সরকার ফাওয়াদকে দিয়ে পোস্ট করাচ্ছে বলে তঁার দাবি। ফাওয়াদের পোস্টকে সামনে রেখে মোদি সুযোগ পাচ্ছেন পাকিস্তানকে ভারতের ভোটের প্রচারে টেনে আনতে।
[আরও পড়ুন: পাণ্ডুয়া বিস্ফোরণের নেপথ্যে পরকীয়া? জখম কিশোরের মায়ের গ্রেপ্তারিতে ঘনাল রহস্য]
ভোটের প্রচারে পেশিবহুল জাতীয়তাবাদ উসকে দিতে এবং মেরুকরণ তীব্র করতে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির সবসময় প্রয়োজন হয় পাকিস্তানকে (Pakistan)। ২০১৯-এর ভোটের ক্ষেত্রে পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলা ও তারপরে পাকিস্তানের বালাকোটে সার্জিকাল স্ট্রাইক বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সহায়ক ছিল। এবারও মনে করা হচ্ছিল– ভোটের আগে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে অভিযানের মতো কোনও ঘটনা ঘটিয়ে মোদি সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রচারে সামনে আনবে। রামমন্দির উদ্বোধনের বিষয়টিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় সম্ভবত সেই পথে হঁাটেনি মোদি সরকার। কিন্তু রামমন্দির আবেগ কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় দানা বঁাধায় সেই পাকিস্তানের ইসু্যতেই মোদিকে ফিরে যেতে হচ্ছে বলে রাজনৈতিক মহলের অভিমত।
রামমন্দির ভাবাবেগ বিশেষ কাজ করবে না, এই কথা আগেভাগে অনুমান করলে কি মোদি পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে অভিযানের পথেই হঁাটতেন? এই প্রশ্ন নিয়ে এখন জোর চর্চা চলছে রাজনৈতিক মহলে। পাকিস্তান বিগত কয়েক বছর ধরে নিজেদের আর্থিক সংকটে এতটাই জর্জরিত যে, ভারতকে পাল্টা কোনও হুমকি শোনানোর জায়গাতেই তারা নেই। ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করার পরেও কাশ্মীরে জঙ্গিদের উসকানি দিয়ে ছায়াযুদ্ধ তীব্র করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সেভাবে সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। যদিও ভারতের তরফে সেরকম অাশঙ্কা ছিল। যে-কারণে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীরে প্রায় তিনমাস লকডাউন করে রাখা হয়েছিল। দুর্বল হয়ে যাওয়া এই প্রতিবেশী ভারতে জাতীয়তাবাদের জিগির তোলার বিষয়ে আদৌ কার্যকর কি না, সেই প্রশ্ন তাই বিভিন্ন মহলে চর্চায় রয়েছে। তবুও মোদি ভোটের প্রচারে পাকিস্তানকেই টেনে আনার কৌশল গ্রহণ করেছেন। কংগ্রেসের দাবি অনুযায়ী এ ব্যাপারে মোদি পাক-প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সাহায্য পাচ্ছেন কি না– তা অবশ্য অনুসন্ধান করে দেখার বিষয়।
দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ‘জনসংঘ পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জনসংঘ-ই বিজেপির পূর্বসূরি। ১৯৫১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জনসংঘ পার্টির প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে শ্যামাপ্রসাদ যে মঞ্চের পরিকল্পনা করেছিলেন, সেখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি অঁাকা হয়েছিল। ওই মঞ্চ পরিকল্পনা নিয়ে সে-সময় দেশের রাজনীতিতে বিস্তর অালোচনা হয়। জনসংঘের প্রতীক ও মঞ্চের চিত্রকল্প থেকে কী বার্তা দেশবাসীকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, তা রাজনৈতিক ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। জনসংঘের ওই সভা থেকে পাকিস্তানকে অন্তর্গত করে নিয়ে ভারতকে ফের এক করার দাবি তোলা হয়েছিল।
মূলত সেই ভোটে ওটাই ছিল জনসংঘের ইস্যু। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সংখ্যালঘু তোষণের। অর্থাৎ প্রথম ভোট থেকেই জনসংঘ পাকিস্তান-বিরোধিতা ও সংখ্যালঘু তোষণকে প্রচারের হাতিয়ার করে িহন্দুদের এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে ভোটব্যাঙ্ক গড়তে সচেষ্ট হয়েছিল। ৭২ বছর বাদে অষ্টাদশ লোকসভা ভোটেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এখনও ভারতবাসীর কাছে ভোটে পাকিস্তান-বিরোধিতা একটি অন্যতম প্রধান ইস্যু। প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জওহরলাল নেহরু সাম্প্রদায়িকতাকেই নিশানা করে প্রচার চালিয়েছিলেন। এখনও ভোটে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রচারকেই হাতিয়ার করতে হয় নেহরুর প্রপৌত্র-প্রপৌত্রীকে।
বেকারত্ব, অসাম্য, মূল্যবৃদ্ধি: শুধু এই ইসু্যগুলি ভোটের ক্ষেত্রে কবে নির্ণায়ক হবে, সে-প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। ১৮টি লোকসভা ভোটের মধে্য কখনও যে অর্থনৈতিক ইসু্যগুলি প্রাধান্য পায়নি, তা নয়। কিন্তু শাসক দল কখনওই এগুলির উপর পুরোপুরি ভরসা রাখতে পারে না। ঘুরেফিরে পাকিস্তান, হিন্দুত্ব, সংখ্যালঘু তোষণ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সামনে চলে আসে। সেটা কংগ্রেসের আমলেও হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ভারতের মতো পরিণত গণতন্ত্রে এটি দুর্ভাগে্যর। ভোটের আরও প্রায় একমাস বাকি। এখন দেখার, সামনের দিনগুলিতে অর্থনৈতিক ইসু্যগুলি প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে, না কি মোদির পাকিস্তান তির শক্তিশালী হয়?