লোকসভা ভোটে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রার্থী নন। কিন্তু ৪২টি আসনে তৃণমূলের মুখ। তাঁর নামে ভোট হয়, তাঁর সমর্থন পার্থক্য গড়ে দেয়। ৩১ মার্চ থেকে তিনি পথে। জলপাইগুড়ির ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়ে দ্রুত কলকাতা থেকে বাগডোগরা এসে মাঝরাতে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান। নির্বাচনী কর্মসূচিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কখনও কলকাতায় বসে রাজনীতি করেননি মমতা। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
পথে পথে কেটে গেল একমাস। প্রখর গ্রীষ্মকে সঙ্গী করে ছুটছিলাম। একপশলা বৃষ্টির যে কী প্রয়োজন, তা অনুভব করছিলাম শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া নদীনালা দেখে। কলকাতা থেকে বৃষ্টির আশায় আর্তনাদ রোজই শুনতে পাই। তাদের বোঝাতে পারি না আমি নিজেই ৪০-৪৪ ডিগ্রি টেম্পারেচারে দঁাড়িয়ে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে!
প্রতিদিন ভরদুপুরে জনসভা। বঁাকুড়ার রাইপুর হোক, বর্ধমানের রায়না, মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম হোক, খড়গপুর– সর্বত্র জয়সলমিরের উষ্ণায়ন। এত গরম আগে ছিল না। গ্রামের লোকজনের অবশ্য গরম নিয়ে হাহুতাশ নেই। তারা মাঠে কাজ করে অভ্যস্ত। দুপুর রোদে জনসভা শুনতে কাতারে কাতারে আসছে। ফলে নিজেকে একা মনে হয় না। ওরা মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে ভোটদানের সিদ্ধান্ত নেবে, আর আমি সেই গ্রামকথা সংবাদপত্রে লিখব। এই কাজের জন্যই পথের হোটেলে খেয়ে অচেনা বিছানায় শুয়ে রাত কাটানো। এসব একদিন-দু’দিন-তিনদিন ভালো লাগে। কিন্তু একমাস কী করে পেরিয়ে যায়!
আসলে সাংবাদিকতা একটা প্যাশন। একদিকে সৃষ্টিসুখ, অন্যদিকে ১০০ দিনের কাজের শ্রমিকের মতো সংগ্রাম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নতুনকে দেখা, নতুন খবর মেলে ধরা। এক আশ্চর্য অনুভূতি। ঠান্ডাঘরে বসে আর যা-ই হোক, ‘জনগর্জন’ শোনা যায় না। মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী সভাগুলির ফঁাকে ভোটের ঘ্রাণ টের পাই প্রতিদিন মাইলের-পর-মাইল ট্রাভেল করার সুযোগে। এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম, এক জেলা থেকে আরেক জেলা। কোচবিহার থেকে কুলটি, বঁাকুড়া থেকে তেহট্ট– আমাদের বাংলা কত সুন্দর, কত বিচিত্র, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তাই তো কবি লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। অথবা ‘কোন্ দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল?’
পথ চলতে চলতে দেখছি মুখ্যমন্ত্রীর ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প কীভাবে হাসি ফুটিয়েছে বাঙালির হেঁশেলে। গ্রামীণ মহিলারা রান্নাবাড়ি ফেলে দিদিকে ধন্যবাদ জানাতে কাঠফাটা রোদে হেলিপ্যাডে দঁাড়িয়ে। আবার দেখছি, মেরুকরণের রাজনীতিকে পাথেয় করে ভেদাভেদের আপ্রাণ চেষ্টা। ধর্ম দেখে ভোট কেন হবে? কর্ম দেখে রায় হোক। সেটাই হবে আসল গ্যারান্টি। ১৯৯৬ সাল থেকে লোকসভা ও বিধানসভা (সেবার একসঙ্গে হয়েছিল) নির্বাচন খুব কাছ থেকে দেখছি। আগে এমনই ভোট-সফরে দেখতাম গ্রামগঞ্জের পথঘাট, গাছ, মাটির দেওয়াল লাল পতাকায় মুড়ে আছে। মাত্র ১৩ বছর আগে ২৩৫ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। আজ গ্রামের পর গ্রামে তারা কই! শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস তো তাদের ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাড়ানোর মাশুল আজও দিচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী হেলিকপ্টারে সফর করছেন। তঁাকে এটা করতেই হবে। ৪২টি লোকসভা। তিনি মুখ। দ্রুত পৌঁছতেই হবে। কোথাও তঁাকে চারটি মিটিং করতে হচ্ছে। কোথাও দু’টি। আবার কখনও জনসংযোগ পদযাত্রা। দুপুর রৌদ্রে বকবক করতে হয় প্রতিদিন। একই কথা বারবার বলতে হয়। তা-ও তিনি নতুন কিছু না কিছু বলেন। আক্রমণে বৈচিত্র আনেন। এখনও কত জীবনীশক্তি। কত মনের জোর। পরিশ্রম করার তীব্র ক্ষমতা। সীমাহীন রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে একা এত বড় একটি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিপদে টেনে তুলছেন।
আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক প্রতিদিন তঁার সফরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জনসভা ‘কভার’ করছি। চেষ্টা করছি দিনের দু’টি সভার প্রথমটিতে যেতে। কারণ, দিনের ইস্যুগুলি উনি প্রথম সভাতেই বলে দেন। দ্বিতীয় সভায় সেই একই কথাগুলো ঘুরে-ফিরে আসে। এখন তঁার সব কর্মসূচি ফেসবুক লাইভ হয়। এতে চ্যানেলগুলির খুব সুবিধা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন স্পর্শকাতর ব্যক্তিত্ব যে, তঁাকে অনুসরণ করতে হয়। ফলে, তঁার প্রতিটি সভায় মেনস্ট্রিম মিডিয়ার প্রতিনিধিরা ভিড় করে থাকে। তাদের জন্য আলাদা জোন করতে হয়। কলকাতা থেকে আসা প্রতিনিধিরা যথাসম্ভব তঁার পিছু-পিছু দৌড়য়। কারণ, মমতাকে উপেক্ষা করা যায় না।
২ এপ্রিল উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম। সেই থেকে টানা সফর চলছে। মাঝে দু’-তিনদিন বাদ দিলে পরিবারের মুখ দেখা হয়নি। তারা কী চায় বোঝার সময় মেলেনি। বড় পরিবারে কারও অসুস্থতা– এমনকী, কাকিমার মৃত্যুর সংবাদও পেয়েছি। ফিরতে পারিনি। ভোট এক যুদ্ধক্ষেত্র। ভোট দেখা একটা দায়িত্ব, নেশা। পয়লা বৈশাখ এই প্রথম বাড়ি ফেরা হল না। অগত্যা, ধূলিধূসরিত জামা, রুমাল, মোজাগুলো কেচে নিয়ে পরের সভার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছি। তীব্র গরমে সুস্থ আছি না অসুস্থ, ভেবে দেখিনি।
লোকসভা ভোটে সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রার্থী নন। কিন্তু ৪২টি আসনে তৃণমূলের মুখ। তঁার নামে ভোট হয়, তঁার সমর্থন পার্থক্য গড়ে দেয়। ৩১ মার্চ থেকে তিনি পথে। জলপাইগুড়ির ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের খবর পেয়ে দ্রুত কলকাতা থেকে বাগডোগরা এসে মাঝরাতে দুর্গতদের পাশে দঁাড়ান। নির্বাচনী কর্মসূচিতে ঝঁাপিয়ে পড়েন। কখনও কলকাতায় বসে রাজনীতি করেননি মমতা। আজীবন স্পটে পৌঁছে গিয়েছেন সবার আগে। বহুকাল আগে এক অগ্রজ সাংবাদিক আমায় শিখিয়েছিলেন, ‘মমতাকে দেখো। ধৈর্যর মূর্ত প্রতীক। সাংবাদিকতাও ওয়ান ডে ম্যাচ নয়। টেস্ট ম্যাচে মতো ক্রিজে থেকে লড়াই করতে হয়। ধৈর্য এবং একাগ্রতা এই পেশার শেষ কথা। ভাল লিখতে হবে। স্পটে পৌঁছে জনতার ভিড়ে মিশে যাও। রান তুললেই সেঞ্চুরি হয়। অন্যের দিকে তাকালেই রানআউট।’
এবার ভোটের খবরের বাইরে যাত্রাপথের কিছু কথা ‘শেয়ার’ করি। সফরের শুরুতে মৃন্ময়ের সঙ্গে দেখা। চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে কোচবিহার গেলে পথের ধারে এসে যাবে কঁাটাতারের বেড়া। একটা আকাশ, একটাই চা-বাগান। তবু ওদিকে বাংলাদেশ, এপারে বাংলা। এই প্রহসনের নাম ‘দেশভাগ’! খানিক এগলে জামালদহ। ওখানেই মৃন্ময়ের দোকান। বড় কড়াইয়ে রাশি-রাশি মিষ্টি, সুস্বাদু আমদই থেকে লুচি-শিঙাড়া মৃন্ময়ের পরিচয় নয়। ওঁর দোকানে পোস্টারে লেখা, ‘ক্যানসার রোগীদের মিষ্টির দাম দিতে হয় না’। তা-ও মৃন্ময়ের পরিচয় নয়! শুনলে অবাক হবেন, এই ছেলেটি মিষ্টির দোকান চালিয়ে ৭৯ জন দুঃস্থ ছাত্রকে ডাক্তারি পড়াচ্ছেন। ইতিপূর্ব ১৫ জনের অধিক ডাক্তারি পাস করে গিয়েছেন। নিজে এলএলবি, সময় কাটাতে এমএলটাও পড়ে নিচ্ছেন বাড়ি থেকে। যখন চারজনকে ডাক্তারি পড়াচ্ছেন, তখন আচমকা ওঁকে আবিষ্কার করি।
জলপাইগুড়িতে দেখা হল তিস্তার সঙ্গে। উত্তরবঙ্গের প্রাণধারা। কিন্তু জল কই? কী করে আমরা জল দেব বাংলাদেশকে? আলিপুরদুয়ারের চা-বাগান– আমার মন ভোলায় রে। চা শ্রমিকদের পৃথিবী চা-বাগানেই। শান্ত, স্নিগ্ধ জীবনে অভাব আর মিটল না। এমনিতেই উত্তরবঙ্গের মানুষ খুব সরল। ধর্মতলা থেকে কলেজ স্ট্রিট যেতে চাইলে বেকবাগানের বাস দেখিয়ে দেওয়া দুষ্টু লোকেরা এখানে নেই বললেই চলে। রাজবংশী আদিবাসী গোর্খা কামতাপুর মতুয়া-সহ বহু প্রান্তিক জাতির মানুষ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেঁচে থাকে। ওদের সরল মনে রাজ্যভাগের বিষ হয়তো সাময়িক প্রভাব ফেলে। কিন্তু দিনের শেষে সবুজ চা-বাগান আর জঙ্গলেই শান্তি খুঁজে নেয়। এবার পাহাড় যাওয়া হল না। মুখ্যমন্ত্রী স্ট্র্যাটেজিগতভাবে পাহাড়কে এড়িয়ে গেলেন। দেখা যাক তঁার কৌশল কতটা সফল হয়। দুই দিনাজপুর হয়ে এলাম গৌড়বঙ্গে। বুনিয়াদপুরে শুকিয়ে যাওয়া টাঙন নদীগর্ভে আবিষ্কার করলাম একটি স্তূপ। ছড়িয়ে কালো কালো পাথর। কোনওটির গায়ে কারুকাজ। বালুরঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর সভা ছেড়ে ফেরার পথে এক স্থানীয় ব্যক্তি নিয়ে গেলেন স্তূপটি দেখাতে। বললেন, হাজার বছর আগে এখানে বড় মন্দির ছিল। এলাকার অনেক বাড়িতে পাথরের উপর খোদাই করা দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। ওগুলো মন্দিরের গায়ের কাজ। কিন্তু মন্দিরটা নদীগর্ভে নির্মাণ হল কেন? নাকি নদীটাই সেকালে ছিল না!
ইংলিশবাজার এলেই আমার মন চলে যায় এক নম্বর কলোনিতে। সেই ফুল-ফলে সাজানো মামার বাড়িটা আর নেই। সাততলা বাড়ির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। ছেলেবেলার বারান্দাটা আজ কঁাদায়। যেখানে দঁাড়িয়ে ট্রেনের হুইসল শুনলে চিৎকার করে বাজি ধরতাম, আপ না ডাউন! মালদহ ও মুর্শিদাবাদের ঘূর্ণি পিচে রাজনীতির বলটা কতটা সুইং করবে তা সময় বলবে। তার চেয়ে বরং একটি দুঃসংবাদ আগেই দিয়ে রাখি। এবার কিন্তু দুই জেলার গাছে আম নেই। বহু বাগান শূন্য। এখনও পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেললাম উত্তরবঙ্গ ছাড়াও বীরভূম, বর্ধমান, নদিয়া, বঁাকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের মাটি। খড়গ্রাম যাওয়ার পথে দেখলাম রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ শুয়ে আছে ভগ্নস্তূপ নিয়ে। হাজার হাজার বছর আগে কী পরাক্রম। সেই ভূমিতে দঁাড়িয়ে ভাবি, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’
রূপসী বাংলায় পলাশ ফুল শুকিয়ে গিয়েছে। তবে পথের ধারের দোকানে মুড়ি-ঘুগনির স্বাদ অমলিন। এই সফরে আমাকে অবাক করলেন পুরুলিয়ার এক গণ্ডগ্রামের বৃদ্ধ। তঁার উপলব্ধিতেই হয়তো নির্ধারিত বঙ্গ ভোটের ফল। যাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তৃণমূল কিছু আপনাকে দেয়?’
বৃদ্ধ বলেন, ‘না গো, কিছু দেয় না।’ বললাম, ‘সে কী! এই যে এত প্রকল্প, আপনার বার্ধক্যভাতা, বউমার লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, নাতনির কন্যাশ্রী? তারপরও বলছেন, দেয় না!’
বৃদ্ধ থামলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সবই তো পাই। কিন্তু তৃণমূল দেয় না। ওগুলো তো দিদি আমাদের দেয়!’