দ্যুতি মুখোপাধ্যায়: এই একটা বিষয়ে সংসদে কোনও মার মার কাট কাট হবে না, কোনও রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করবে না, আর সাধারণ মানুষ তো খুশি হবেই৷
প্রস্তাব অতি সাধু৷ গোটা দেশে সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটির পরিমাণ ২৬ সপ্তাহ, অর্থাত্ সাড়ে ছ’মাস করছে সরকার৷ সরকারি চাকরিতে অনেক দিনই ছ’মাস ছুটি প্রাপ্য ছিল৷ কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক ছুটির পরিমাণ ১২ সপ্তাহ, অর্থাত্ ৩ মাস৷ এ দিকে ইণ্টারন্যাশনাল লেবার স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী এই ছুটির পরিমাণ হওয়া উচিত অন্তত ১৪ সপ্তাহ৷ সেই গোলযোগটিই শোধরানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ এবং জায়গা করে নিয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা মাতৃত্বকালীন ছুটি প্রদানকারী দেশগুলোর তালিকায়৷ এমন প্রগতিশীল পদক্ষেপ নিয়ে কার প্রশ্ন থাকতে পারে?
প্রশ্ন কিন্তু আছে৷ তার কারণ রণিতা৷
রণিতা আমার স্কুলের বন্ধু৷ সে গৃহবধূ, সম্প্রতি মা হয়েছে৷ মায়ের কাছ থেকে সদ্য ফিরেছে স্বামীর কর্মক্ষেত্র মুম্বইতে৷ এখন ভোর পাঁচটায় শুরু হয় তার দিন৷ স্বামীর টিফিন, ব্রেকফাস্ট বানায়৷ ভোরের ঘুমটা কাটিয়েই ফেলে রণিতা৷ এর মধ্যেই ছেলে উঠে পড়লে তার খাবার বানাও, কিংবা বুকের দুধ খাওয়াও, সে ওই টিফিন বানানোর ফাঁকেই৷ স্বামী বেরিয়ে গেলেই দুপুরের রান্না চাপাও৷ তার মধ্যে সোনাবাবুর চান, খাওয়া, কয়েক প্রস্থ খেলাধুলো, ঘর ঝাড়পোঁছ৷ কোনও কোনও দিন ১১ টার মধ্যে খেয়ে নিতে হবে, কোনও দিন তিনটের আগে দাঁতে কুটোটি কাটার সময় হবে না, সবই সোনাবাবুর যেমন মর্জি৷ দুপুরের পর ঘুমিয়ে পড়লে সোয়াস্তি, না হলে আবারও তার পিছন পিছন দৌড়ও৷ এই করতে করতেই সন্ধে আর সন্ধে হলেই সারা দিনের অফিস শেষে ক্লান্ত স্বামী ঘরমুখো৷ তার জলখাবার৷ খেয়ে দেয়ে স্বামী সোনাবাবুর সঙ্গে খেলে খানিক, সেইটুকুই রণিতার অবসর৷ তারপরেই রাতের রান্না৷ সবাই শান্তিমতো ঘুমিয়ে পড়লে অ্যালার্ম দিয়ে শোও৷ আবার পরের দিন পাঁচটা৷ রান্নার লোক? নাঃ, বাইরের রান্না স্বামীর মুখে রোচে না! আর মুম্বইয়ে আয়াদের খাঁই বড় বেশি৷
রণিতা চাকরি করে না৷ কিন্তু তারও কি একটা ছুটি দরকার ছিল না? ছিল৷ ছুটিটার নাম পিতৃত্বকালীন ছুটি৷ রণিতার স্বামী যদি অন্তত প্রথম কয়েকটা মাস সন্তানকে সামলানোয় কিছুটা সময় দিতে পারত, তাহলেই তো রণিতার ভারটা অনেক লাঘব হত, তাই না? তার অবসাদের দিনগুলোয়, তার রান্নাবান্নার সময়টা, তার নিতান্ত জরুরি বিশ্রামের সময়টা যদি কেউ ছেলেকে দেখার থাকত?
মাতৃত্বকালীন ছুটির দৈর্ঘ্যে যে ১৬ টি দেশের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ভারত তাদের দিকে একবার চোখ ফেরাই৷ ব্রিটেন, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ড–এই প্রত্যেকটি দেশে রয়েছে এক থেকে ছ’মাস পর্যন্ত সবেতন পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা৷ আর ভারত? সন্তান জন্মানোর পর ১৫ দিন ছুটির ব্যবস্থা আছে সরকারি ক্ষেত্রে৷ আগে থেকে দুই বা তার বেশি সন্তান থাকলে ছুটি নেওয়াই যাবে না৷ ডেলিভারি ডেট থেকে ছ’মাসের মধ্যে এই ছুটি নিয়ে নিতে হবে৷ বেসরকারি ক্ষেত্রের জন্য কোনও নিয়ম নেই৷ সংস্থার মর্জিমতো দেওয়া হয়৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় না, যেমন রণিতার স্বামীর ক্ষেত্রে ঘটেছে৷
রণিতাকে এসব বলতে গেলে সে হেসেই উড়িয়ে দেবে৷ আমাদের সরকারও হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন৷ শ্রমমন্ত্রী বন্দারু দত্তাত্রেয় পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘এটা তো মা আর শিশুর ব্যাপার৷ ছেলেদের ব্যাপার নয়’৷ আরও পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, শিশু জন্মের পর প্রথম ছ’মাস মায়ের বুকের দুধ খাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷ সে কথা মাথায় রেখেই এই ছুটির ব্যবস্থা৷ সঙ্গে ফাউ হিসেবে বছর-বছর দেশের শ্রমসম্পদ থেকে স্ত্রীলিঙ্গের ভাগ কমে যাওয়ায় রাশ টানা যাবে৷ মুখরক্ষা হবে আন্তর্জাতিক মহলে৷ বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছিল কি না, গত দশ বছরে দেশে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা পুরো দশ শতাংশ কমে গিয়েছে যে, দুনিয়ার আর কোনও দেশে এ নজির নেই৷
এটা কেউ ভাববেন না, সন্তানের প্রতি, সংসারের প্রতি যে দায়িত্ব একটি মেয়ে পালন করে সেটাও কাজই? একুশ শতকে এসে নেহাত্ মেয়েদের পর্দানশীন হতে বলাটা বাড়াবাড়ি৷ বাইরের পৃথিবীর কাছে তাই তাঁরা আর অদৃশ্য নন, তাঁদেরও কাজও নয়৷ কিন্তু ঘরের ভিতর তাঁদের যে কাজ? সে তো অদৃশ্যই থেকে গিয়েছে, যাচ্ছে৷ অথচ সমস্যা যে আছে তা তো স্পষ্ট৷ না হলে আর রোজ হাজারো পত্রপত্রিকা ঘরে বাইরে তাল মিলিয়ে চলার, দশভুজা হওয়ার উপদেশ ছুড়ে দিত না৷ তার নিশানা কিন্তু মেয়েরাই, পুরুষরা নয়৷ ধনতান্ত্রিক নারীবাদের এক সময়ের ধুয়ো ছিল, ‘উইমেন ক্যান হ্যাভ ইট অল’৷ পেপসিকোর সিইও ইন্দ্রা নুয়ি ক’দিন আগেই সেই মৌচাকে এক ঢিল মেরেছেন, বলেছেন, সন্তানদের পাশে সবসময় না থাকতে পেরে অপরাধবোধে ভোগেন তিনি৷ সেটা যে তাঁর সহজাত দায়িত্ব ছিল৷ ‘নো, উইমেন কাণ্ট হ্যাভ ইট অল৷
কথা হচ্ছে, ‘হ্যাভ ইট অল’-এর প্রশ্নটাই ওঠে কেন? মায়ের একার চেষ্টা বা ইচ্ছেয় তো আর সন্তান জন্মায় না৷ তা হলে জন্মের পর সন্তান পালনের দায়িত্বটাই বা একা মায়ের ঘাড়ে থাকবে কেন? কেন পিতৃত্বকালীন ছুটি একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হবে না?
শ্রমের সমবণ্টনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সওয়ালটা ওঠে৷ আরেকটা প্রশ্ন ওঠে সন্তান পালনে মেয়ে-পুরুষের ভূমিকাকে যে ভাবে দেখা হচ্ছে তা নিয়েই৷ কত বাবা তো আছেন যাঁরা কাজটা ভাগ করে নিতে চান? চান নিজের সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়টা কাছে থাকতে? এগুলো ‘ছেলেদের ব্যাপার’ নয়, এটা আজ অনেক ছেলেই মনে করেন না৷ ধরা যাক আদিত্য তিওয়ারির কথা৷ বহু আইনি লড়াই পেরিয়ে এ বছরের গোড়ায় বিন্নি নামে এক ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুকে দত্তক নিয়েছেন অবিবাহিত আদিত্য৷ তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নন৷ একা-মায়ের মতো একা-বাবার সংখ্যাও এ দেশে কম নয়৷ প্রথমে আদিত্য এবং সম্প্রতি অভিনেতা তুষার কাপুরের দত্তক নিয়ে একা-বাবা হওয়ার সিদ্ধান্ত এই নতুন বাস্তবকে সবার সামনে তুলে আনছে ধীরে ধীরে৷ এই বাবাদের ছুটির দরকার নেই?
আসলে আমরা তো জেনে বসে আছি যে সন্তানপালন মায়ের দায়িত্ব, বাবার দায়িত্ব অর্থ জোগান দেওয়া৷ পিতৃত্বকালীন ছুটির দাবি তাই কাজ ফাঁকি দেওয়ার ফিকির বলেই গণ্য হয়ে থাকে৷ যেমন চন্দ্রমোহন জৈন৷ ২০০৯ সালে শিশু জন্মের পর ছুটি নেওয়ায় মাইনে কেটে নেওয়া হয়েছিল এই বেসরকারি স্কুল শিক্ষকের৷ দিল্লি হাইকোর্ট অত্যন্ত সদর্থক পদক্ষেপে তাঁর মাইনে ফেরত দেওয়ার রায় দেয়৷ কিন্তু সেটি, দুর্ভাগ্যবশত, বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ বাবারা সন্তানপালনে ভূমিকা নিতে চান কি না, সেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজনই দেখে না আমাদের দেশ৷ অথচ শিশুর পুরোপুরি বিকাশের জন্য বাবা-মা দু’জনের সাহচর্যই সমান জরুরি, এই কথাটা বিশেষজ্ঞরা সেই কবে থেকে বলে আসছেন৷ তথাকথিত নারীবাদী আলোচনাতেও মায়ের দাবিটাই বড় হয়ে উঠেছে বারবার৷ বাবার ভূমিকাটাও যে পিতৃতন্ত্র নির্ধারিত এবং তার ফলে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার, এই কথাটা কমই উঠে আসে৷
রণিতা সারা দিন যে কাজগুলো করে সেগুলো তার ‘স্বাভাবিক প্রবৃত্তি’ বলেই সমাজ, সরকার এমনকী সে নিজেও ধরে নিয়েছে৷ সন্তানপালনে অংশগ্রহণ করতে চাওয়া রণিতার স্বামীর ‘স্বাভাবিক প্রবৃত্তি’ হতে পারে না, এটাও আমরা ধরেই নিয়েছি৷ এই দু’টো ধারণা থেকে বেরনোই সমান গুরুত্বপূর্ণ, রণিতা, তার স্বামী এবং সন্তানের স্বার্থে৷
মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো সময়োপযোগী এবং বাস্তববাদী পদক্ষেপ৷ কিন্তু ভারতের প্রেক্ষিতে তা প্রগতিশীল নয়৷ ‘উইমেন-ফ্রেন্ডলি’ও নয়৷ কারণ এই বাস্তব আংশিক বাস্তব৷ বাকিটুকুকে স্বীকৃতি না দিলে ভাবের ঘরে খানিক বাটপাড়িই করা হয়ে যাচ্ছে যে৷
The post জুকারবার্গ পায়, আমরা পাই না appeared first on Sangbad Pratidin.