shono
Advertisement

বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী ঐক্যে কাঁটা ‘সেটিং’ তত্ত্ব

কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘সেটিং’ হয়েছে।
Posted: 01:42 PM Oct 09, 2021Updated: 01:42 PM Oct 09, 2021

পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অভিযোগ করেছেন যে, বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘সেটিং’ হয়েছে। তাই তৃণমূল পৌঁছে যাচ্ছে আন্দোলনের ক্ষেত্রভূমিতে। কিন্তু কংগ্রেসকে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কংগ্রেসের চোখে তৃণমূল এখন বিজেপি-র ‘বি টিম’। হায়, এই করলে ঐক্য হবে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

 

উত্তরপ্রদেশে গাড়িচাপা দিয়ে কৃষকদের হত্যার পরেও মন্ত্রিপুত্র রয়েছেন বহাল তবিয়তে- এমন অভিযোগ করছে তামাম বিরোধী দল। বিস্মিত হয়ে আমি টেলিভিশনে দেখছিলাম, রাহুল গান্ধী বলছেন- লখিমপুরে যেতে আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস কীভাবে সেখানে গেল? কেজরিওয়ালের দল ‘আপ’, তারাই বা কী করে অনুমতি পাচ্ছে?

রাজনীতিতে কিছু ণত্ব-ষত্ব ব্যাকরণ থাকে। লড়াইটা যখন হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) সরকারের বিরুদ্ধে, যখন সমস্ত বিরোধী দলকে ঐক্যবদ্ধ করার তোড়জোড় চলছে, মানুষের অসন্তোষের পারদ চড়ছে, আর সবচেয়ে বড় কথা, কৃষকরা যেখানে লাঞ্ছিত, আক্রান্ত এবং সাংঘাতিকভাবে মোদি সরকারের বিষয়ে অসন্তুষ্ট- এমন এক পরিস্থিতিতে রাহুল গান্ধী বলছেন, বিজেপি- মমতা এবং কেজরিওয়াল সম্পর্কে নরম মনোভাব নিচ্ছে! কৃষকদের এই অসন্তোষ, যা শুরু হয়েছিল রাজধানীতে, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর ভারতের সামান্য কিছু অংশে- এখন তাই দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে একথা বলছেন রাহুল।

[আরও পড়ুন: অবসরের নির্দিষ্ট বয়স নেই, ক্ষমতা হস্তান্তরই বড় চ্যালেঞ্জ ভারতীয় রাজনীতিতে]

আর, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী? তিনি কী বললেন? তিনি অভিযোগ করলেন যে, অখিলেশ যাদবের দল এই কৃষক আন্দোলনে যথেষ্ট সাড়া দিচ্ছে না। যা আন্দোলন করার, তা কংগ্রেসই করছে। যখন আন্দোলনটা হচ্ছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে, আন্দোলনটা যখন হচ্ছে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের সরকারের বিরুদ্ধে, সেই সময় অখিলেশের বিরুদ্ধাচরণ করা কি প্রিয়াঙ্কার অগ্রাধিকার হতে পারে? এভাবে, অখিলেশের সঙ্গে সংঘাতের পথে গিয়ে কি উত্তরপ্রদেশের হারানো জমি কংগ্রেস ফিরে পেতে পারে?

আর বাবু যত বলে, পারিষদগণ তো তার চেয়ে বেশি বলবেই। সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ সবসময় বেশি হয়। এ তো প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম! সুতরাং, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী অভিযোগ করলেন যে, বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের ‘সেটিং’ হয়ে গিয়েছে। সে কারণে তৃণমূল পৌঁছে যাচ্ছে আন্দোলনের ক্ষেত্রভূমিতে। কিন্তু কংগ্রেসকে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। শুধু এক্ষেত্রে নয়, বেশ কিছুদিন থেকে অধীর চৌধুরী এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করছেন যে, বোঝাপড়া হয়েছে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যে। সুতরাং, কংগ্রেসই হল এখন একমাত্র আগমার্কা বিজেপি-বিরোধী শক্তি।

বিগত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও বিজেপি এবং তৃণমূলের বোঝাপড়ার তত্ত্ব সিপিএম এবং কংগ্রেস দিয়েছিল, যাকে বলা হয়েছিল ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব। সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, এই প্রচার তাঁদের রাজনৈতিক ভুল। এই প্রচারে বিজেপি দমে যায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুশোর উপর আসন পেয়েছেন। মাঝখান থেকে কংগ্রেস এবং সিপিএম বিধানসভা থেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। উলটে ‘ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট’-এর প্রার্থী নৌশাদ সিদ্দিকি বিধানসভায় একটা আসন পেয়ে গেলেন। এখন আবার সেই একই অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে, তৃণমূল বিজেপির ‘বি টিম’।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। যত ভোট এগিয়ে আসছে, আমার মনে হয়, ততই প্রয়োজন বিরোধী ঐক্যকে মজবুত করা। তার পরিবর্তে এখন যদি আঞ্চলিক দলগুলোকে বিজেপির ‘বি টিম’ বলে কংগ্রেস ঘোষণা করে, তাহলে তাতে কংগ্রেসেরই বা লাভ কী, অন্য বিরোধীদেরই বা লাভ কী? আখেরে তো তাতে বিজেপিরই লাভ! এটা কি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন না?

সম্প্রতি গুজরাটের গান্ধীনগরে নগর নিগমের ভোট হয়ে গেল। অর্থাৎ, সে রাজ্যের সর্বোচ্চ পুরসভার ভোট। এই ভোটের প্রচারের সময় রাহুল গান্ধীকে সক্রিয় দেখা যায়নি। হয়তো ‘পুরনির্বাচন’ বলে এই ভোটটাকে অবজ্ঞা করা হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ কিন্তু কোনও পুরনির্বাচনকে ছোট করে দেখেন না। কারণ, সেই নির্বাচনগুলোতেও কিন্তু ভোট দেয় মানুষই। পুরনির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির মা ভোট দিতে এলেন, সেটারও ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হল।

বিগত গান্ধীনগর পুরনির্বাচনে বহু আসনে কেজরিওয়াল প্রার্থী দিয়েছিলেন। এবং ‘আপ’ অনেক আসন পেয়েছিল। তাতে গুজরাটে আপের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কেজরিওয়ালের আশা জেগেছিল। পুরনির্বাচনে প্রায় সব আসনে কেজরিওয়াল এবার প্রার্থী দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, বিগত পুরনির্বাচনের তুলনায় ভোটে আপের ফলাফল খারাপ হল। তারা পেল মাত্র একটা আসন। কেজরিওয়ালের ‘আপ’ নামক দলটির দাপটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল কংগ্রেস। কংগ্রেস সেখানে মুছে গেল। এবং বিজেপি দাপটের সঙ্গে ফিরে এল গুজরাট পুরসভার ভোটে। গুজরাটের পুরসভার ভোট যেহেতু তৃণমূল স্তরের ভোট, সেজন্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব এই ভোটকে গুরুত্ব দিয়েছিল। বিজেপি হায়দরাবাদের পুর নির্বাচনকে অমিত শাহ সাংঘাতিকভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

এখন কংগ্রেস যদি মনে করে যে, কেজরিওয়াল প্রার্থী দিয়েছিলেন বলে কংগ্রেস মুছে গেল- তাহলে তা ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ হয়ে দাঁড়াবে। সেই তত্ত্বমাফিক বলা যায়, কেজরিওয়াল বিজেপির ‘বি টিম’। তবে আমার কিন্তু মনে হয়, বিষয়টার অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। কেজরিওয়ালের বিরোধিতা কেন করছেন? কেজরিওয়ালকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি-বিরোধিতা করা যায় না? আর যদি দিল্লির নির্বাচনের কথা ভেবে কংগ্রেস আপের বিরোধিতা করে, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, দিল্লিতেই বা কেজরিওয়াল-বিরোধী কংগ্রেসের শক্তি কোথায়, কতটুকু? সেখানেও কিন্তু লড়াই মূলত কেজরিওয়াল বনাম বিজেপি।

মূল কথাটা বলে দিয়েছেন এনসিপি নেতা শরদ পাওয়ার। তিনি বলেছেন, কংগ্রেসকে এই জমিদারি মনোভাব ছাড়তে হবে। এই সাবেকি জমিদারি মনোভাব থাকার জন্যই আঞ্চলিক দলগুলোর অস্তিত্ব তারা এখনও স্বীকার করতে রাজি নয়। তারা বুঝতে পারছে না যে, তাদের অবস্থা ‘জলসাঘর’-এর ছবি বিশ্বাস অভিনীত বিশ্বম্ভর রায়ের মতো। একটা-একটা করে মোহর সব শেষ হয়ে গিয়েছে। হয়তো হাতেগোনা একটা কি দুটো মোহর পড়ে আছে। কিন্তু সেই সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি দাপট দেখাতে গিয়ে আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থানকে অবজ্ঞা করলে, তাতে কিন্তু কংগ্রেসেরই ক্ষতি। সুতরাং, শরদ পাওয়ারের প্রস্তাব, আঞ্চলিক দলের নেতৃত্বকে যেন কংগ্রেস মেনে নেয়। তাতে কিন্তু ২০২৪-এ কংগ্রেসেরই আখেরে লাভ হতে পারে।

কে প্রধানমন্ত্রী হবেন আর কে হবেন না- সেটা তো পরের কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলছেন না যে, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। কিন্তু কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী দলের আন্দোলন গড়ার আগাম ব্লু প্রিন্ট তৈরি করা এখন কোনও কাজের কথা হতে পারে না। যে যেখানে আছে, যার যা শক্তি আছে- সেই নিয়ে লড়াই করুক। আঞ্চলিক নেতৃত্ব যদি এগিয়ে আসে, কংগ্রেস তাকে সমর্থন করুক।

কংগ্রেসের ঘরেই এখন গভীর সংকট! পাঞ্জাবে সরকার থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস যেভাবে সেখানে রাজনৈতিক হারাকিরি করল, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে সরিয়ে দিয়ে নতুন মুখ্যমন্ত্রী করল, তাতেই সেই সংকটের ছবি স্পষ্ট হয়। তিনি দলিত মুখ্যমন্ত্রী, অন্যদিকে নভজ্যোত সিং সিধু মুখ্যমন্ত্রী না হতে পারায় রাগে ফুঁসছেন, তাঁকে শান্ত করা যাচ্ছে না। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কলহ এমন জায়গায় চলে গিয়েছে যে, এখন যেখানে পাঞ্জাবের অকালি দলের প্রতি মানুষের আস্থা কার্যত নেই বললেই চলে। সেখানেও কিন্তু কংগ্রেসের ক্ষমতায় আসা নিয়ে ধন্দ দেখা দিয়েছে।

রাজস্থানে অশোক গেহলট মুখ্যমন্ত্রী এবং তিনি মোদি সরকারের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে একটা সাংবিধানিক বোঝাপড়া করে চলেন। কিন্তু কংগ্রেসের ভিতরে সংকট তীব্র। এখনও শচীন পাইলট এবং অশোক গেহলটের বিবাদ মেটেনি। উলটে উপনির্বাচনগুলোতেও যথেষ্ট কলহ প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রীকে রাখা হবে কি হবে না- তাই নিয়ে তুলকালাম। রাহুল গান্ধী সেখানে খুব স্পষ্ট কোনও নির্দেশ দিতে পারেননি। তিনি ‘ইহাও হয়, উহাও হয়’ পথে চলতে গিয়ে আরও ঘোর অনিশ্চয়তা ডেকে এনেছেন।

অসমে কংগ্রেস ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। সেখানে কংগ্রেস যে ফিরে আসবে এমন কোনও আশার আলোও দেখা যাচ্ছে না। রাহুল গান্ধীকে রাজ্যে রাজ্যে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যাচ্ছে না। সবাই অপেক্ষা করছেন যে, একটা সুনির্দিষ্ট দিনে ফিতে কাটার মতো বিরোধী রাজনীতি শুরু হবে। কংগ্রেস দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী থাকবেন কি থাকবেন না- স্পষ্ট করছেন না তাও। অথচ তিনি কিন্তু সভাপতির মতোই কংগ্রেস দলটিকে চালাচ্ছেন।

দায়িত্ব না নিয়ে দলের কান্ডারি থাকা আর আঞ্চলিক দলগুলোকে বিজেপির ‘বি টিম’ বলা- এটা মনে হয় বিজেপিরই হাত শক্ত করছে। রাহুল গান্ধী যদি এই ভুলগুলো না শোধরান, তাহলে কিন্তু শতবর্ষপ্রাচীন জাতীয় কংগ্রেসের শতচ্ছিন্ন চেহারা দেখে বলতে হবে, এই মুহূর্তে বিজেপির সবথেকে বড় ‘বি টিম’ হচ্ছে কংগ্রেস। রাহুল গান্ধী হলেন নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বড় সেফটি ভাল্‌ভ। রাহুল গান্ধী যদি ঠিক এভাবে চালিয়ে যান, তাহলে বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ হবে। এবং নরেন্দ্র মোদির ২০২৪-এ ড্যাং ড্যাং করে ক্ষমতায় আসা আবারও সুনিশ্চিত। আর যদি কংগ্রেসের শুভবুদ্ধির উদয় হয়, ইউপিএ-র পুনর্গঠনের পথে যান সোনিয়া গান্ধী, তাহলে পরিণতি অন্যরকম হলেও হতে পারে। এবং তাঁকে ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন রাখতে চাইছেন শরদ পাওয়ার, মমতা-সহ সকলেই। কিন্তু ইউপিএ-র কনভেনরের পদটি দেওয়া উচিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তার ভিত্তিতে নতুন প্রাণ আসবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এবং মমতার নেতৃত্বে বিরোধী দলের ঐক্য দুর্বার গতিতে এগনোর সুযোগ পেতে পারে।

[আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ছাড়া গতি নেই ভোজনবিলাসীদের! কোথায় হারাল গঙ্গার ইলিশ?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement