মোদির এক সিদ্ধান্তে গোটা দেশে এখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি৷ পুরনো পাঁচশো, হাজার টাকার নোট নিয়ে চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া ভুলেছেন দেশবাসী৷তাই কষ্ট হলেও যেন তেন প্রকারেণ ব্যাঙ্ক-এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নতির স্বার্থে এককাট্টা হয়েছে মানুষ৷ কিন্তু যাহা খালি চোখে দেখা যায়, তাহাই চরম সত্য নহে৷ মানে, জাল নোট ও কালো টাকা উদ্ধার ছাড়া আরও কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে এই নোট বদলের সিদ্ধান্তের নেপথ্যে৷ তা এখন প্রচ্ছন্ন হলেও আর ক’দিন বাদে প্রকট হয়ে উঠবে৷ তেমনই কিছু তথ্যের ঝুলি উল্টে-পাল্টে দেখলেন শুভময় মণ্ডল
নোট-এ গাছটি কি সত্যি মুড়লো! গত চারদিন চতুর্দিকে শুধু নোট আর নোটের গল্প৷ টাকার চিন্তায় মানুষ নাওয়া-খাওয়া ভুলে ঘুম থেকে উঠেই সকাল সকাল এটিএম-ব্যাঙ্কের সামনে লাইন লাগিয়েছে৷ হচ্ছে একটু হয়রানি, তবুও মুখে মোদি-স্তুতি করতে কসুর নেই জনতার৷ না, এই সিদ্ধান্তর সুদূরপ্রসারী ফলাফল একদিন দেশবাসী ভোগ করবে৷ তাই যাঁরা কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে দেশোদ্ধারের যজ্ঞে মেতেছেন তাঁরা কিন্তু বাহ্যিক জিনিসটাই জানেন৷ মানে, যাহা খালি চোখে দেখা যায়, তাহাই চরম সত্য নহে৷ এমনকি ১৯৭৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের হাজার, পাঁচ হাজার এবং দশ হাজারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের এক বছর আগেই প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ এমন আশঙ্কার কথা বলেছিলেন৷ ‘এক যে ছিল দেশ’ ছবিতে পাইকারী মুদি কারবারি ও তাঁর হিসেবনিকেশে কাঁচা ছেলের কথোপকথনে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সরকার যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও টাকার নোট বাতিল করে দিতে পারে৷ তাই সবসময় আলাদা আলাদা মূল্যর নোট একসঙ্গে রাখা মিলিয়ে রাখা বোকামির কাজ হতে পারে৷ সরকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলেই সেই নোট অন্য টাকার নোটের সঙ্গে মিশে থাকায় হিসাবের আওতার বাইরে চলে যেতে পারে৷
কিন্তু সেই পুরনো কথায় এখন চিড়ে ভিজবে কেন? মোদির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ তো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আচমকা আঘাত হেনেছে কালো ধনের সওদাগরদের উপর৷ কিন্তু উলু-খাগড়ার মতো আম আদমির প্রাণ যাবে কেন বলে যে সব রাজনৈতিক দলগুলি চিল চিৎকার জুড়েছে, এখন তাদের কপালে দেশদ্রোহী তকমা ছাড়া কিছুই জুটছে না৷ তাই তো আর পাঁচটা রবিবারের মতো এই রবিবার দুপুরের ভাতঘুম ভুলে ছুটির দিনেও ব্যাঙ্ক-এটিএমের সামনে লম্বা লাইন লাগিয়েছে জনতা জনার্দন৷ কিন্তু ভাবার বিষয় হল, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষের লাভের পাশেও আরও কিছু মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে৷ খালি চোখে যা প্রচ্ছন্ন মনে হলেও আদতে তা কয়েকদিন পরই প্রকট হয়ে যাবে৷
এক এক করে তাহলে সেই আলোচনায় আসা যাক-
- কারও কি জানা আছে, এই মুহূর্তে গোটা দেশে বাজারে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের পরিশোধযোগ্য ঋণের পরিমাণ প্রায় ৬,০০,০০০ কোটি টাকা৷
- এই মুহূর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক ভাঁড়ারের হাল খুই শোচনীয়৷ তাই ধুঁকতে থাকা ব্যাঙ্কগুলিকে ফের চাঙ্গা করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন বিপুল অর্থের জোগান৷ তাও কি জানা আছে?
- কয়েক সপ্তাহ আগেই ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ‘মুডি’স-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির ১.২৫ লক্ষ কোটি টাকার অর্থের জোগান প্রয়োজন৷
- এও কি জানা আছে কারও, যে চলতি বছর জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে ২৩ হাজার কোটি টাকা আর্থিক সাহায্য করেছে৷
- কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর গত বছর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মহাশয় ঘোষণা করেছিলেন, আগামী চার বছরে ধুঁকতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ প্রদান করবে৷
সত্যি কথা বলতে কি, এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তর আরও একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই ধুঁকতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে চাঙ্গা করা৷ দেশ-বিদেশের কালো টাকা যে গতিতে সাদা হবে তাতে তো রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি মারফত সরকারের ভাঁড়ারেই সুফল পৌঁছাবে৷ মোদির অন্যতম একটি লক্ষ্য হল, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে অর্থনৈতিক দিক থেকে দেশকে চাঙ্গা করা৷ যাতে এশিয়ায় চিনের অর্থনীতিকে টেক্কা দেওয়া যায়৷ চিনের সর্বগ্রাসী পদক্ষেপকে পাল্টা দিতেই অনেক ভেবে চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ সীমান্ত পেরিয়ে জাল নোটের নেটওয়ার্ক গুড়িয়ে দেওয়া, কালো টাকা উদ্ধার করা ছাড়াও দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে চাঙ্গা করা এবং বিশেষ কিছু ধনকুবেরদের সুবিধে করে দেওয়ায় এই দ্বিতীয় সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য৷ তাই দেশের তথাকথিত উন্নতির স্বার্থে লাইনে দাঁড়িয়ে আম আদমি কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকেও পরোক্ষে সাহায্যই করছেন৷ তাদের চাঙ্গা করার জন্য৷ লাইনে দাঁড়াবেন মানুষ, ঘুরে দাঁড়াবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক৷
The post লাইনে দাঁড়াবেন মানুষ, ঘুরে দাঁড়াবে ব্যাঙ্ক appeared first on Sangbad Pratidin.