shono
Advertisement
Mohun Bagan

বাঙালির মোক্ষপ্রাপ্তির অনন্য রূপকথা

১৯১১-য় মোহনবাগানের শিল্ড-জয় আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার চরম নিদর্শন।
Published By: Kishore GhoshPosted: 08:03 PM Jul 29, 2024Updated: 08:03 PM Jul 29, 2024

মধ্যবিত্ত বাঙালিদের ‘মেয়েলি’ ভাবত ব্রিটিশ শাসকরা। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ প্রশাসনিক মহলের এই শ্লেষের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি মধ্যবিত্ত আত্মশক্তি অর্জনে তৎপর হয়। ১৯১১-য় মোহনবাগানের শিল্ড-জয় আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার চরম নিদর্শন। আজ, মোহনবাগান দিবসে, বিশেষ নিবন্ধ। লিখছেন শুভ্রাংশু রায় 

Advertisement

‘ইউ টার্ন’। ১৮৫৭-র বিদ্রোহের পরে, ব্রিটিশ শাসকদের ভারতীয়দের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে যে-ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল, তাকে ‘ইউ টার্ন’ ধাঁচের শব্দেই হয়তো ব্যাখ্যা করা যায়।

প্রাক্‌-বিদ্রোহের সময়ে রামমোহন রায়ের মতো সমাজ সংস্কারকের আবেদনে সাড়া দিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের তরফে বেশ কিছু সংস্কারমূলক আইন চালু করা হয়েছিল। কিছু সংস্কারপন্থী মানুষজন তাতে বিরূপ হয়েছিলেন বটে, যদিও সেই বিরূপতাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুব একটা পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু কয়েকটি উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহের পরে, ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহ, ব্রিটিশ প্রশাসকদের অনেক বেশি সতর্ক করে দিল। ইতোমধ্যে ‘মেক্‌লে মিনিটস’-ও (১৮৩৫) প্রকাশ্যে চলে এসেছিল, যা স্পষ্ট করে দিয়েছিল– ব্রিটিশ শাসকদের তরফে ভারতীয়, বিশেষত পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের, ‘মেয়েলি’ ও ‘কাপুরুষ’ বলে চিহ্নিত করার প্রবণতাকে। এই সুবাদে শাসক ও শাসিতের টানাপোড়েনের সম্পর্কও ধীরে-ধীরে রাজপথে চলে আসে।

 

[আরও পড়ুন: জঙ্গলবন্দি ৪০ দিন! মহারাষ্ট্রের অরণ্যে উদ্ধার শিকলে বাঁধা মার্কিন মহিলা]

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, ব্রিটিশ প্রশাসনিক মহলের এই শ্লেষের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি মধ্যবিত্ত আত্মশক্তি অর্জনের প্রক্রিয়ায় নেমে পড়ে। উনিশ শতকের সাতের দশকের পর থেকে কলকাতায় যেমন একদিকে রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠন তৈরি হতে শুরু করে, তেমনই বঙ্গীয় যুবকদের মধ্যে শরীরচর্চার হিড়িক লেগে যায়। যে-চর্চার নেপথ্যে আত্মক্ষমতা অর্জনের প্রবল তাড়না ছিল। ‘হিন্দু মেলা’-র মাধ্যমে ‘ফিজিক্যাল কালচার’ বা শরীরচর্চার সংস্কৃতি নতুন মাত্রা পায়। নানা ধরনের কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। তবে বাঙালি কুস্তিগিরদের সঙ্গে মূলত অবাঙালি উত্তর ভারতীয় কুস্তিগিরদের লড়াই হত বলে তা বাঙালি-পৌরুষ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে খুব একটা কার্যকর ছিল না। ঘটনাচক্রে, বাঙালি মধ্যবিত্তের সামনে ফুটবল সেই সম্ভাবনার বাস্তব প্রতিফলনের সুযোগ এনে দেয়, যেখানে বাঙালি যুবকদের সরাসরি শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবকাশ তৈরি হবে।

বিষয়টি অবশ্য খুব একটা সহজ ছিল না, কারণ ফুটবলের নিয়ম সহজ হলেও, ফুটবল খেলতে গেলে যে-ধরনের নৈপুণ্য এবং শারীরিক সক্ষমতা প্রয়োজন হয়, গোরা দলগুলির বিরুদ্ধে সেসব আয়ত্ত করতে যথেষ্ট অনুশীলন ও সময়ের প্রয়োজন ছিল। প্রাথমিক পর্বে মূলত কলেজ-পড়ুয়ারাই ফুটবল খেলতে শুরু করে, যার নেতৃত্ব এসেছিল নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী তরফে। ১৮৯০-এর দশকের শুরুতে ‘ইস্ট সারে রেজিমেন্ট’ নামে একটি ব্রিটিশ দলকে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল শোভাবাজার ক্লাব– যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। ১৮৯৩-তে তৎকালীন ভারতীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ পেরেন্ট বডি আইএফএ-র উদ্যোগে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় আইএফএ শিল্ড নামক সর্বভারতীয় নক আউট টুর্নামেন্ট শুরু হলে– ফুটবলকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে।

১৯০৯ সালে ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’ (১৮৮৯ সালে ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত) শিল্ড খেলার সুযোগ পায়। আর, তৃতীয় বছরে অর্থাৎ ১৯১১-তে ঘটে যায় সেই যুগান্তকারী ঘটনা। সেন্ট জেভিয়ার্স ও তারপর চারটি মিলিটারি দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতে নেয় সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। ২৯ জুলাই ১৯১১, রেফারি পুলারের শেষ বঁাশি বাজার পরে বিশাল যে-ভিড় খেলোয়াড়দের প্রায় কঁাধে নিয়ে স্বতস্ফূর্ত বর্ণাঢ্য মিছিল-সহ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাস্থল মোহনবাগান লেনে পৌঁছে দিয়েছিল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব।
ঔপনিবেশিক আমলে, শাসক মিলিটারি দলের পরাজয়ে, এত বড় উল্লসিত জনসমাবেশ কেউই আগে দেখেনি।

সে-বছর প্রথম যে-ম্যাচে মোহনবাগান দশজনে খেলে জয় পেয়েছিল (অধ্যাপক চ্যাটার্জি কলেজে ছুটি না-পাওয়ায় সময় মতো মাঠে পৌঁছতে পারেননি), সেন্ট জেভিয়ার্স দলের বিরুদ্ধে সেদিনের সেই ম্যাচে কার্যত জনশূন্য মাঠে খেলতে নেমেছিলেন সবুজ মেরুন জার্সিধারীরা। ক্রমে একে-একে ব্রিটিশ মিলিটারি রেজিমেন্ট টিমগুলিকে হারিয়ে (রেঞ্জার্স, রাইফেল ব্রিগেড, মিডলসেক্স রেজিমেন্ট, অবশেষে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্ট) মোহনবাগান যত এগিয়েছে– ততই দর্শকের সংখ্যা বেড়েছে। তখন যেন প্রত্যেকটি ম্যাচ ছিল মোহনবাগান– থুড়ি বাঙালির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই।

 

[আরও পড়ুন: ৩ পড়ুয়ার মৃত্যুতে ‘বুলডোজার অ্যাকশন’ দিল্লিতে, গুঁড়িয়ে দেওয়া হল অবৈধ নির্মাণ]

স্বদেশি যুগের শেষ বছরে এই শিল্ড-প্রাপ্তি ছিল আদতে বাঙালির শরীরচর্চা সংস্কৃতির চরম মোক্ষলাভ। ব্রিটিশ অপবাদের বিরুদ্ধে রুখে দঁাড়িয়ে পরাধীন জাতির সবচেয়ে শিক্ষিত অংশের প্রতিনিধি হিসাবে নানা শারীরিক কসরত– যথা, লাঠি বা ছোরা খেলা, বা মুগুর ভঁাজা– এসব যেন শেষ পর্যন্ত এগারোজনের সম্মিলিতভাবে একটি দলগত খেলায় পরিপূর্ণতা পায়। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর হিসাবে কলকাতার মেয়াদের শেষ বছরে– মানে, ১৯১১ সালে– ‘অমর একাদশ’ মোক্ষপ্রাপ্তি ঘটায় সমগ্র বাঙালি জাতির। এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকেই জন্ম নিয়েছে অনন্য রূপকথা, যার আবেদন এখন বিশ্বজনীন।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক ইতিহাসের অধ্যাপক
subhransuroy1@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ১৯০৯ সালে ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’ (১৮৮৯ সালে ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত) শিল্ড খেলার সুযোগ পায়।
  • উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, ব্রিটিশ প্রশাসনিক মহলের এই শ্লেষের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি মধ্যবিত্ত আত্মশক্তি অর্জনের প্রক্রিয়ায় নেমে পড়ে।
Advertisement