সম্প্রতি মোহন ভাগবত ‘অল ইন্ডিয়া ইমাম অর্গানাইজেশন’-এর প্রেসিডেন্ট উমের আহমেদ ইলিয়াসি-র সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করলেন। এমন আগ্রহ, তাগিদ ও উদ্যোগের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একটা থাকেই। মোহন ভাগবতের এই মসজিদ-মাদ্রাসা পরিদর্শন, ইমামদের সঙ্গে কথা বলা, বিশিষ্টজনের মন বোঝার অন্তরালেও রাজনীতির একটা পরশ রয়েছে। স্বীকার না করলেও তা স্পষ্ট। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’-র (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবতকে নিয়ে সম্প্রতি খুব আলোচনা হচ্ছে। দিন কয়েক আগে তিনি দিল্লিতে এক মসজিদে গেলেন। তারপর এক মাদ্রাসায়। জীবনে এই প্রথমবার কোনও মাদ্রাসায় তাঁর পদার্পণ। ‘অল ইন্ডিয়া ইমাম অর্গানাইজেশন’-এর প্রেসিডেন্ট উমের আহমেদ ইলিয়াসি-র সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করলেন। মুসলমান সমাজের পাঁচজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গেও দেখা করেছেন কিছুদিন হল। বিষয়টা এতদিন চাপা ছিল। এখন প্রকাশ্যে। মোহন ভাগবত তাঁদের সঙ্গে দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁদের কথা যেমন শুনেছেন, তেমনই সংঘের নীতি ও আদর্শের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই পাঁচ বিশিষ্টজন দেশের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এস. ওয়াই. কুরেশি, দিল্লির প্রাক্তন উপ-রাজ্যপাল নাজিব জং, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন উপাচার্য জমিরউদ্দিন শাহ, প্রাক্তন সাংসদ ও সাংবাদিক শাহিদ সিদ্দিকি এবং ব্যবসায়ী সইদ শেরওয়ানি।
মোহন ভাগবতের এই তৎপরতায় দেশের মুসলমান সমাজ আলোড়িত। হায়দরাবাদী এমআইএম নেতা আসাউদ্দিন ওয়াইসি ওই পাঁচ অতি পরিচিত মুসলমানকে ‘এলিট’ শ্রেণির প্রতিনিধি বলে কটাক্ষ করে বোঝাতে চেয়েছেন- ওঁরা আর যে-ই হন, প্রকৃত মুসলমান প্রতিনিধি নন। কেউ কেউ এই সাক্ষাৎ ও ভাগবতের উদ্যোগকে ‘আদিখ্যেতা’ মনে করছেন। বলছেন, আরএসএসের মতো ‘আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক’ একটা সংগঠনের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ওই গণ্যমান্যরা মুসলমান আত্মমর্যাদায় ঘা দিয়েছেন। এই মহলের মতে, এমনটা করা ওঁদের একদমই উচিত হয়নি। কারণ, সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে তাঁরা আরএসএস-এর যাবতীয় ‘অপকর্ম’-কে মান্যতা দিয়েছেন।
[আরও পড়ুন: ‘এসসিও’ বৈঠকে চিনের সঙ্গে কথা না বলে কি বার্তা দিল ভারত?]
নেতিবাচক এই প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি মুসলমান সমাজের একাংশ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দিয়েছে। তারা মনে করছে, এই সংলাপের প্রয়োজন আছে। সংলাপ না থাকলে মন বোঝা দায়। তাছাড়া, গণতন্ত্রে সংলাপের কোনও বিকল্প নেই। মুসলমানদের কাছে যাওয়া ও তাদের কথা শোনার পিছনে কোন তাড়না কাজ করছে, ভাগবত তা জানেন। সংঘ অবশ্য এই উদ্যোগকে ‘নতুন কিছু’ মানতে রাজি নয়। সংঘের সর্বভারতীয় প্রচার প্রমুখ সুনীল আম্বেকরের ব্যাখ্যা, এটা আমরা নিয়মিত করে থাকি। সরসংঘচালক নিয়ম করে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেশেন। আমরা একে ‘সংবাদ’ বলি। কাউকে জানতে গেলে মিশতে হয়। না মিশলে মন জানা-বোঝা দুষ্কর।
এই জানা-চেনার উদ্যোগের পিছনে অনুচ্চারিত কারণ অবশ্যই সংঘের নীতি ও আদর্শের প্রচার এবং তা সর্বজনীন করে তোলা। সংঘের আদর্শের রাজনীতিকরণের দায়িত্ব যেহেতু বিজেপির, তাই এই জাতীয় আগ্রহ, তাগিদ ও উদ্যোগের পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একটা থাকেই। মোহন ভাগবতের এই মসজিদ-মাদ্রাসা পরিদর্শন, ইমামদের সঙ্গে কথা বলা, বিশিষ্টজনের মন বোঝার অন্তরালেও রাজনীতির একটা পরশ রয়েছে। স্বীকার না করলেও তা বোঝা যায়।
ভাগবত যে-সময় এসব করছেন, সেই ‘টাইমিং’ লক্ষণীয়। হিজাব (Hijab) মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যদিও এখনও রায় শোনায়নি। কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও জ্ঞানবাপী মসজিদ মামলা শেষমেশ অযোধ্যার পথে হাঁটবে, এমন একটা ধারণা মুসলমান সমাজে ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। একইরকম সলতে পাকানো হচ্ছে মথুরাতেও। আড়াই বছর পর সুপ্রিম কোর্টে শুরু হতে চলেছে জম্মু-কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিকরণ ও ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ সংক্রান্ত মামলা।
কর গোনা কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে দেশের প্রায় সর্বত্র গোমাংস নিষিদ্ধ। লাগাতার প্রচার চলছে নিরামিষ ভক্ষণের।বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে পুজো-পার্বণ উপলক্ষে দিনের পর দিন মাছ-মাংসর দোকান বন্ধ রাখার ফরমান জারি হচ্ছে। কোনও কোনও রাজ্যে মন্দিরের দুশো গজের মধ্যে পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আমিষ বিকিকিনি। রামনবমী শুরু হয়েছে। এই প্রথম দিল্লির বহু মহল্লায় ডিমের দোকানেরও ঝাঁপ বন্ধ হল!
বিজেপি-শাসিত সব রাজ্যে আজানের জন্য লাউড স্পিকার ব্যবহারে রাশ টানা হয়েছে। যুক্তি, ইসলামের জন্মের সময় লাউড স্পিকার ছিল না। অতএব হিজাবের মতো সেটাও অপরিহার্য নয়। ২০২৪-এ জয়ের হ্যাটট্রিক করতে চান নরেন্দ্র মোদি। মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চাৎপদ ‘পশমন্দা’ শ্রেণির মন জেতার ‘ব্লু প্রিন্ট’ তাই তৈরি। ইতিমধ্যেই জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি ও জামিয়া হামদর্দ ইউনিভার্সিটিতে ‘পশমন্দা’ মুসলমানদের জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের দাবি করেছে বিজেপির ওবিসি সংগঠন। লক্ষ্য, মুসলমান অনগ্রসরদের কাছে টানা। মোহন ভাগবতের নতুন উদ্যম রাজনীতির এই আলোতেই দেখা দরকার।
সন্দেহ নেই, নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হিন্দু-মুসলমান সদ্ভাবে ফাটল বেড়েছে। একে-অন্যকে আরও বেশি অবিশ্বাস করছে। সন্দেহ করছে। অধিকাংশ মুসলমান নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে তারা দিন দিন আরও বেশি কোণঠাসা। হিন্দুদের মনেও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বাড়ছে। অনেক মানুষ মনে করছে, মুসলমানদের বড় বেশি তোল্লাই দেওয়া হয়েছে। ভোটের জন্য। সেই বাড়াবাড়ি চিরতরে বন্ধ হওয়া জরুরি। ভেদাভেদ অবশ্যই আগের তুলনায় তীব্রতর। প্রশাসন ও আইন পাস থেকে চুন খসলে মুসলমানদের রেয়াত না-করা ও সব্ক শেখাতে মুখিয়ে রয়েছে। কাজেই, ভাগবতের উদ্যোগ ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের সংশয়।
পাঁচ ‘এলিট’ মুসলমানকে ভাগবত যা বলেছেন, তা অবশ্য মন্দ নয়। যেমন, হিন্দুত্বের অর্থ, ধর্মীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা নয়, সবাইকে নিয়ে পথচলা। সব সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ থাকলেই দেশ এগোবে। সংবিধান অলঙ্ঘনীয়। তার চরিত্র বদলের কোনও অভিপ্রায় সংঘের নেই। তিনি বলেছেন, হিন্দুরা দু’টি বিষয়ে খুবই স্পর্শকাতর। প্রথমটি গোহত্যা। মুসলমানদের উচিত এই স্পর্শকাতর বিষয়টিকে সম্মান জানিয়ে গরুর মাংস খাওয়া স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া। অন্যটি ‘কাফের’ বিশেষণ। মুসলমানরা কথায় কথায় হিন্দুদের ‘কাফের’ বলে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। ভাগবত বলেন, এ দেশের মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের ‘ডিএনএ’ অভিন্ন। হিন্দুত্ববাদ হল ভারতীয়দের জীবনশৈলী। যাপিত জীবনের ধরন। ঠিক এইভাবে মুসলমান জনতাও কোথায় আহত হন কুরেশি, নাজিব জংয়েরা তা ভাগবতকে বুঝিয়েছেন। বলেছেন, মুসলমান মানেই ‘জেহাদি’, ‘পাকিস্তানি’, ‘দেশদ্রোহী’ নয়। কট্টরবাদীরা এই ধারণা সাধারণ ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের মনে গেঁথে দিচ্ছে। তা-ও বন্ধ হওয়া দরকার। সেজন্য প্রয়োজন এই ধরনের সংলাপের। দুই সম্প্রদায়ে সংলাপ যত বাড়বে, ততই কমবে ভুল বোঝাবুঝি।
কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদ যেভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে, বিজেপির রাজনীতি যেভাবে ধুনো জোগাচ্ছে, তাতে সংঘের চাওয়া-পাওয়ায় আদৌ কিছু কি যায়-আসে? অন্যভাবে বলা যায়, মোদি-যুগে উগ্র-হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির রমরমা যেভাবে বাড়ছে, তাতে রাশ টানার ক্ষমতা সংঘের আছে কি? উত্তর অবশ্যই নঞর্থক। সহজ ভাষায়- না, নেই। একই সঙ্গে সত্যি, এসব সংগঠনের রাশ টানার কোনও ইচ্ছা বা আগ্রহ বিজেপির নেই। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের জঙ্গি শাখা বজরং দল। তার বৃদ্ধি কচুরিপানার মতো। গত সাত বছরে তাদের আখড়ার সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ‘শ্রীরাম সেনা’। পাঁচ বছর ধরে উত্তরপ্রদেশের ‘আইন’ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের তৈরি ‘হিন্দু যুব বাহিনী’। এরা কেউ সংলাপে বিশ্বাসী নয়। সংঘের নীতি ও আদর্শের ধার ধারে না। বিজেপি তাদের কাছে কাজ হাসিলের বৈতরণি। মানুষ গঠন নয়, হিন্দু রাষ্ট্র গঠন ও প্রশ্নাতীত হিন্দুপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠাই তাদের
ধ্যান-জ্ঞান।
বজরং দল বিজেপিকে বিব্রত করছে বলে একটা সময় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী খেদোক্তি করেছিলেন। ইদানীং যা চলছে, তাতে আজকের কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের চোখে মোহন ভাগবতও হয়তো একদিন অসহ্য ঠেকবেন। সংলাপের পক্ষে তাঁর যুক্তি পাগলের প্রলাপ বলে চিহ্নিত হবে। তিরষ্কৃত হবেন।