পাকিস্তান ও আমাদের দেশের দাওদি বোহরা গোষ্ঠী-সহ সোমালিয়া, ইজিপ্ট, কঙ্গো, ইয়েমেন, মিশরের কিছু কিছু অংশে প্রএ এই প্রথায় জোর করে, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, কন্যাসন্তানদের যৌনাঙ্গের ক্লিটোরিসের পাশের চামড়া, কেটে দেওয়া হয়। কলমে অনুভা নাথ
ইরানী বালিকা যেন মরু-চারিণী/ পল্লীর প্রান্তর-বন মনোহারিণী/ ছুটে আসে সহসা গৈরিক-বরণী/ বালুকার উড়নী গায়। মেয়েবেলায় ‘ইরান’ বলতে নজরুল ইসলামের এই গানটি কানে বাজত, চোখের সামনে ভেসে উঠত একটি কল্পিত দৃশ্যপট- কমলা জামা পরা সুন্দরী একটি মেয়ে, সে মরুভূমির ঊষর প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে নাচছে।
এত বছর পেরিয়ে সে-ই ইরানকে যেন বা দেখতে পেলাম অন্য আঙ্গিকে। মাহসা আমিনিকে, বাইশ বছরের তরুণী, ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, ইরানের রাজধানী তেহেরানে সেখানকার নীতিপুলিশ, গাশত-ই-এরশাদ, আটক করেছিল। তাঁর অন্যায়? না, হিজাব পরায় গোলমাল। সেই দায়ে তাঁকে কারাগারে বন্দি করা হয়। অভিযোগ, পুলিশি নিগ্রহের দরুন তিনদিন কোমাচ্ছন্ন থাকার সময়ই হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।
এই বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে ইরানের সরকার এক হাস্যকর ও মধ্যযুগীয় দায়িত্ব দিয়েছে। তারা যে কোনও বয়সের মহিলাকে যে কোনও জায়গায় আটক করার ক্ষমতা রাখে নীতিপুলিশির রুল ফলিয়ে। মাথার চুল খোলা থাকলে, জামার ঝুল খাটো বা চাপা হলে পুরুষ উত্তেজিত হয়ে পড়বে- তাই মহিলাদের পরতে হবে ঢাকা পোশাক। এই সমস্ত কিছু সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করে নীতিপুলিশ। নিয়মের ব্যত্যয় হলেই মহিলাদের ভাগ্যে জুটতে পারে মাহশার মতো নির্যাতন। জেল, জরিমানা, এমনকী শারীরিক নিগ্রহ। মাহশা আমিনির মৃত্যুর পরই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ইরান। প্রকাশ্যেই সেখানকার মেয়েরা হিজাব পুড়িয়ে, চুল কেটে এই মধ্যযুগীয় নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। নারী স্বাধীনতার আগুন ঝিকিয়ে উঠেছিল।
ভারসাম্যহীনতার নিরিখে এই পৃথিবীতে জলবায়ুর পরই বোধহয় মহিলাদের অবস্থানগত বৈষম্য জায়গা করে নেবে। কিছু মহিলা তাঁদের আত্মক্ষমতা, সাহস, জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেদের সত্তা, অবস্থান ও নারীত্বকে বারেবারে গর্বিত করেছেন। তেমনই আবার নির্ভয়া, মাহশা আমিনি-সহ আরও কত নাম-না-জানা মহিলাকে প্রতিদিন বারবার লাঞ্ছিত হতে হয়েছে, হয়।
পাকিস্তান ও আমাদের দেশের দাওদি বোহরা গোষ্ঠী-সহ সোমালিয়া, ইজিপ্ট, কঙ্গো, ইয়েমেন, মিশরের কিছু কিছু অংশে প্রচলিত আছে ‘ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন’ সংক্ষেপে ‘এফজিএম’।
এই প্রথায় জোর করে, সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, কন্যাসন্তানদের যৌনাঙ্গের বাইরের অংশ, ক্লিটোরিসের পাশের চামড়া, কেটে দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এর ফলে, সেই মেয়েটির কৌমার্য রক্ষিত হবে, এদিকে মেয়েটির স্বামী/পার্টনার আরও বেশি করে যৌন আনন্দ ভোগ করতে পারবে।
নারীর বক্ষসৌন্দর্য নিয়ে কত না রচনা! পুরুষদের কল্পনাবিলাসের শেষ নেই। অথচ নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি বড় এলাকা জুড়ে চলে পাশবিক প্রথা। নারীত্বের প্রতীক স্তনের ওপর গরম পাথর চেপে ধরা হয়, তার ফলে স্তনের ভিতরের স্পর্শকাতর টিস্যু নষ্ট হয়ে যায়। স্তন তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এভাবে মেয়েদের সৌন্দর্যের উপর আস্তর রচনা করা হয়, যাতে পুরুষরা নারী স্তনের প্রতি আকর্ষণ অনুভব না করে। দুঃখজনক বিষয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েদের মায়েরা এই প্রথার পক্ষে। মেয়েটিকে অল্পবয়সি বলে মনে হলে সে আরও কিছুদিন পড়াশোনা করার সময় পাবে- এমন ভাবনাও নাকি কাজ করে। কারণ যা-ই হোক, আচরণটি মর্মান্তিক।
[আরও পড়ুন: দেবালয় পুড়ছে, মণিপুরে পুড়ছে জনপদও, এই হিংসার শেষ কোথায়?]
আফ্রিকার মৌরাটেনিয়ায় ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ের উপর চলে বিয়ের নামে ভয়ংকর অত্যাচার। সেখানে মেয়েদের বিবাহযোগ্যা হওয়ার জন্য পৃথুলা হওয়া আবশ্যিক। একটি ছ’-বছরের বাচ্চা মেয়েকে জোর করে প্রতিদিন প্রায় কুড়ি লিটার উটের দুধ, দু’-কাপ মাখনের সঙ্গে দু’-কেজির কাছাকাছি মিলেট খাওয়ানো হয়। ওখানকার সমাজের এটাই দস্তুর। বিয়ে দিতে গেলে মেয়েকে হতে হবে স্বাস্থ্যবান। তার শরীর, সংসারের শ্রীবৃদ্ধির প্রতীক। যত মোটা মেয়ে, তত নাকি ভাল বিয়ে। সেই দেশে মেয়েদের আইনত বিয়ের বয়স কমপক্ষে আঠারো, কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রমরমিয়ে চলছে বাল্যবিবাহ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মৌরাটেনিয়ায় ২০১৭ সালে ৩৭% মেয়েদের আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ১৪% মেয়েদের বয়স ছিল পনেরোর কম। এভাবেই মেয়েদের শৈশব, অধিকার, তাদের জীবন সবকিছুই হয়ে উঠেছে বিরাট প্রহসন। আমাদের দেশে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা ও ‘অনার কিলিং’-এর মতো ঘটনা ঘটতেই থাকে।
সম্প্রতি, আমাদের দেশে সুপ্রিম কোর্ট যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। বিবাহিতা, অবিবাহিতা সমস্ত মহিলার আইনত ও নিরাপদ গর্ভপাতের অধিকার আছে। এই অধিকার অর্জন করতেও লেগে গেল স্বাধীনতার পরে সুদীর্ঘ ৭৫টি বছর। অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত গত জুন মাসে নারীর গর্ভপাতের অনুমোদনের সিদ্ধান্তের ক্ষমতাকে নারীদের উপর নয়, তাদের অঙ্গরাজ্যের উপর ন্যস্ত করেছে। অর্থাৎ, এবার থেকে অঙ্গরাজ্যের নিয়ম মহিলার গর্ভপাতকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ধারণা করা হচ্ছে, এই রায়ের পর অর্ধেকের বেশি অঙ্গরাজ্যে ‘গর্ভপাত’ নিষিদ্ধ হতে পারে, অথবা নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে। সেদেশের ১৩টি অঙ্গরাজ্য ইতিমধ্যেই গর্ভপাতের বিরুদ্ধে আইন পাশ করিয়েছে।
অর্থাৎ, নারীর দৈহিক ও মানসিক অধিকার তার নিজস্ব নয়, তৎকালীন সমাজের। সমাজের দোহাই দিয়ে সেটা যে কোনও সময়ে, যে কোনও নিয়মের বেড়াজালে বদলে ফেলা যায়। এটিই প্রতিপাদ্য বিষয় রূপে উঠে আসছে। মেয়েদের তরফে এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ আগেও করা হয়েছে। লেখা হয়েছে নানাবিধ রচনা। জোর দেওয়া হয়েছে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের উপর। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসনের সামনে (কখনও চড়া, কখনও বা নমিত) তা বারবার ফিকে হয়ে যায়। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে।