shono
Advertisement

Breaking News

নার্গিসের নোবেল জয় নিয়তির মুচকি হাসি

জেলখানায় বসেই নার্গিস মহম্মদির বিশ্বজয়।
Posted: 06:16 PM Oct 08, 2023Updated: 06:21 PM Oct 08, 2023

১৩ বার গ্রেফতার হয়েছেন, পাঁচবার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট ৩১ বছরের জেল, ১৫৪ ঘা চাবুক, শেষবার গ্রেফতার হন গত বছরের নভেম্বরে। অথচ নিয়তির মুচকি হাসি এমনই খেলা ঘোরাল যে, জেলখানায় বসেই নার্গিস মহম্মদি জানতে পারলেন, নোবেল কমিটি তাঁকে ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। কলমে লেখক প্রাবন্ধিক, কবি, সমাজকর্মী যশোধরা রায়চৌধুরী

Advertisement

‘দুঃসময় থেকে সুসময়ে/ মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে/ আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে/ তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে/ তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি/ আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সূচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে!’

তুর্কির কবি নাজিম হিকমতের লেখা কবিতার পংক্তি, যা সুভাষ মুখোপাধ্যায়-কৃত অনুবাদে ‘জেলখানার চিঠি’ বলে বাংলায় পরিচিত, পড়তে পড়তে, ‘বাপ’-এর জায়গায় ‘মা’ বসানো, বিপরীত এক জেলখানার চিঠি পড়লাম যেন নার্গিস মহম্মদির নোবেলপ্রাপ্তির খবরে। তেহরানের এভিন জেলখানায় সাজা ভুগছেন কৃষ্ণকেশী, ঝকঝকে চোখের, ৫১ বছর বয়সি, পেশায় প্রযুক্তিবিদ নার্গিস মহম্মদি। ৮ বছর হল তিনি দেখেননি ছেলেমেয়েদের। চাক্ষুষ করেননি পরিবারকে। ‘পরিবার’ বলতে স্বামী অ্যাক্টিভিস্ট তাঘি রহমানি, যমজ ছেলেমেয়ে আলি আর কিয়ানা, এখন যাদের বয়স ১৬- তিনজনেই স্বভূমি থেকে নির্বাসিত। আশ্রিত ফরাসি দেশে। রাহমানি নিজেও ১৪ বছর জেলবন্দি থাকার পর নির্বাসনে। আর, সামাজিক পরিবর্তনের জন্য লড়াই লড়তে থাকা নার্গিস মহম্মদি ‘দেশদ্রোহী প্রোপাগান্ডা ছড়ানো’-র জন্য এখন জেলখানায়।

ইরানের প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী শিরিন এবাদি-র সংগঠন ‘ডিফেন্ডার অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টার’ বা ‘ডিএইচআরসি’-র ভাইস প্রেসিডেন্ট তিনি। ইরান সরকার কেড়ে নিয়েছে তাঁর পেশা, পরিবার, স্বাধীনতা।

১৩ বার গ্রেফতার হয়েছেন, পাঁচবার দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট ৩১ বছরের জেল, ১৫৪ ঘা চাবুক, শেষবার গ্রেফতার হন গত বছরের নভেম্বরে। অথচ নিয়তির মুচকি হাসি এমনই খেলা ঘোরাল যে, জেলখানায় বসেই নার্গিস জানতে পারলেন নোবেল কমিটি তাঁকে ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। নোবেল কমিটির ব্যাখ্যানে, ইরানের মেয়েদের উপরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই ও সার্বিকভাবে নারীর অধিকারের জন্য সরব হওয়ার জন্যই এই পুরস্কার দেওয়া হল।
মহম্মদি লিখেছেন, তিনি জেলখানার জানালা দিয়ে তেহেরানের উত্তর দিকের পাহাড়ের গায়ে গাছ ও ফুলেদের দেখেন। ওই জানালার ফাঁকটুকুই তাঁর বিশ্ব। মুক্ত এক ইরানের কথা ভাবার জন্য ওই দৃশ্যটিই সম্বল। তিনি বলেন, আরও শাস্তি দিক ওরা আমাকে, আরও কেড়ে নিক আমার স্বাধীনতা, তত আমি হয়ে উঠব আরও বেশি বদ্ধপরিকর। গণতন্ত্র আনতেই হবে ইরানে। স্বাধীনতা চাই ইরানে।

ইরান সরকার নার্গিস মহম্মদির টেলিফোনে কথা বলা এবং সাক্ষাৎকারের অধিকারও কেড়েছে। কারণ, ২০২২ সালে তিনি একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পাশ্চাত্য মিডিয়াকে টেলিফোন যোগে, বা প্রশ্নোত্তরমালার মাধ্যমে, গোপনে। বাইরের জগতের কাছে নিজের ভাষা, নিজের বাণী পৌঁছে দেওয়া
নার্গিসের এই ‘ঔদ্ধত্য’-কে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সেখানকার স্বৈর-সরকার।
নার্গিসের ছোটবেলায়, তাঁর মা নাকি তাঁকে বলেছিলেন, কখনও রাজনীতিতে নামিস না। কারণ মায়ের পরিবার ছিল প্রতিবাদী। ৯ বছরের নার্গিসের স্মৃতিতে মুদ্রিত হয়ে আছে এই দৃশ্য– টেলিভিশনে ‘প্রতিবাদীদের’ মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘোষণা হচ্ছে, আর মা বসে শুনছেন চেনা কোনও নাম শোনা যায় কি না। একদিন এক আত্মীয়ের নাম শুনে মায়ের লুটিয়ে পড়ে কান্না নার্গিস ভুলতে পারেননি। কিন্তু মনে ভীতি কায়েম হওয়ার বদলে দুর্দম প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের এই ছাত্রীটির মনে।

বছর ৩০ আগে ইরান ছিল পহল্‌ভি রাজবংশের করায়ত্ত। তখন কিন্তু এত বিধিবিধান, আইন করে মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করা দেখা যেত না। বোরখাহীন, চাদরহীন, মুক্তকেশী মেয়েদের দেখা যেত। চুলে বব-কাট দেওয়া মেয়েদেরও দেখা যেত তেহরানের পথে, নানা পেশায় পাশ্চাত্যের মেয়েদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। কিন্তু ইতিহাসের পথ সরলরৈখিক নয়, এক রেখায় চলে না প্রগতির পথে সমস্ত সভ্যতা। সমস্ত সভ্যতার ভেতরে বারবার বৃত্তাকার ছন্দে ফিরে আসতে দেখা যায় পুরনো অভ্যাস ও বিশ্বাসকে। উচ্চাবচভাবে বারবার ঘুরে আসে ভাবনার সেসব বদ্ধতা, যাদের আমরা পুজো করি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্মের নিদান অথবা জাতীয় অভ্যাসের নাম দিয়ে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ‘বিপ্লব’-এর পর মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল হিজাব বা বোরখা। এখানে মনে রাখতে হবে, ইরানে আইনানুসারে হেড স্কার্ফ, মাথা-ঢাকা-চাদর বা হিজাব যেহেতু মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক, বিদেশিনীরাও সেখানে গিয়ে সেটাই মেনে চলতে বাধ্য ছিলেন। তেহরানগামী প্লেনে হামেশাই দেখা মিলবে সম্পূর্ণ বাহু-ঢাকা পোশাক ও ম্যাচিং হিজাব পরিহিতা নানা ভিনদেশি মহিলা ব্যুরোক্র্যাট বা ডিপ্লোম্যাটের। ২০১৮ সালে চিন থেকে সাংগীতিক সফরে যাওয়া একজন শিল্পীকে জোর করে হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁর কনসার্টের মাঝখানে।

নার্গিসের এই শান্তি পুরস্কার আরও অর্থবহ কেননা, বছরখানেক আগে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে, ইরান জ্বলে উঠেছিল তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর। একটি দৃশ্য ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। উন্মুক্ত বেণির এক নারী কেটে ফেলছেন তাঁর চুল। ইরানের এই মুখহীন নারী তখন দিকে দিকে প্রতীকের মতো। তেহরান-সহ ইরানের ৮০টি শহরে ইনকিলাবের আগুন জ্বলছিল। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল অনেক মানুষের, রাস্তা থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে যাচ্ছিল মানুষ। খড়্গহস্ত, কঠোর হাত শাসকের। ইরান সরকারের বয়ান ছিল, এই আন্দোলন নাকি বহিরাগত, বিদেশি শক্তির উসকানি-প্রসূত। কাজেই স্বীয় সংস্কৃতিকে বজায় রাখতে হবেই।

সঠিকভাবে হিজাব পরেননি, সঠিকভাবে মাথা ঢাকেননি, সঠিকভাবে কেশ আবৃত করেননি– এই কারণে মৃত্যু ঘটেছিল মাহসা আমিনির। সরকারের পোষা নীতিপুলিশের ঘেরাটোপে থাকাকালীন আহত মাহসাকে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। ইরান সরকার এ-কথা স্বীকার করেনি যে, মাহসাকে মেরেছে রাষ্ট্র। কিন্তু মাথায় আঘাত ও রক্তক্ষরণ নিয়ে কোমায় দু’দিন থাকার পর যখন মাহসার মৃত্যু হল, দ্রুত উত্তাল হয়ে উঠেছিল দেশ। আন্তর্জাল-যোগে দ্রুত ছড়িয়েছিল খবর। আগুন ঘিরে মেয়েদের নৃত্যরত মূর্তি, কালো হিজাব বা বোরখা আগুনে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য ভাইরাল হয়। নার্গিসের পুরস্কারপ্রাপ্তি বছরব্যাপী প্রতিবাদ ও সরকার পক্ষের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে যোগ্য প্রত্যুত্তর যেন-বা। মারিয়াম ফুমামি, লন্ডনে বসবাসকারী ইরানি সাংবাদিক ‘এক্স’-এ (টুইটার) লিখেছেন– এ জয় আমাদেরই জয়। জেলখানার বাইরে আর ভিতরে, অজস্র মৃতের কবরখানায় নার্গিসের নাম অনুরণিত হচ্ছে। আমাদের সকলের, ইরানের মেয়েদের, যে-লড়াই চলেছে, তারই যেন একটা স্বীকৃতি মিলল নার্গিসের জয়ে। পৃথিবী ইরানের ভিতরের জন-আন্দোলনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল এতদিনে।

৮ বছর আগে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শেষ ফোটোগ্রাফ তুলেছিলেন। পরিবার অপেক্ষা করছে- কবে ছাড়া পেয়ে, আবারও একটি টাটকা ফোটোগ্রাফ একত্রে তোলা যাবে, সেই সুসমাচারের জন্য, যে-ছবির মধ্যমণি অবশ্য নার্গিস মহম্মদি।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement