‘এনসিআরবি’-র পরিসংখ্যান অনুসারে– ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিদিন
গড়ে ৮৬টি ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। তার চেয়েও শঙ্কার কথা, এই ৮৬টি ধর্ষণের মামলার প্রায় ৮২টিতে ধর্ষক ধর্ষিতার পূর্বপরিচিত। এরপরেও ধর্ষণ কোথায়, কোন রাজ্যের কোন লোকেশনে হল, তা নিয়ে তর্ক করব আমরা? লিখছেন শ্রীপর্ণা দত্ত।
‘শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?’ এই জিজ্ঞাসা আসলে পুরুষের। তত্ত্বকথার কচকচানি যা-ই থাক, পুরুষের লিঙ্গবোধের নির্মিতিতে মেয়েরা শুধুই যৌনবস্তু। আর. জি. কর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ধর্ষণ ও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে আমরা যেসব কথা বলেছি– সবেতেই চিকিৎসকের আগে ‘মহিলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে পড়ুয়া চিকিৎসকের মেধা, পেশাগত দক্ষতা, উজ্জ্বল আগামীর স্বপ্ন– সব বাদে যে-তথ্যটি সর্বত্রস্বীকার্য, তা হল: তিনি স্ত্রী-লিঙ্গধারী। ধর্ষক বা ধর্ষকদের কাছে তাই তিনি নিছক নারীদেহ, যাকে যখন খুশি, যেমনভাবে খুশি দুমড়ে-মুচড়ে আমোদ করা যায়।
নাবালক, বা একটু ‘মেয়েলি’ ভাবের পুরুষ কিংবা যৌন পরিচয়ের ক্ষেত্রে যঁারা প্রান্তিক, তঁাদের অনেকেই যৌন নিগ্রহ ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, আজীবন বহন করেছেন বিধ্বস্ত মন ও শরীর। কেউ-বা হয়তো এখনও একা-একা বহন করছেন ট্রমার গুরুভার। কিন্তু কোনও নারী ধর্ষিতা হলে, তিনি শুধু শরীরে-মনে বিক্ষত হন তা নয়, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে তঁার ‘একা’ হয়ে যাওয়া, বা পরিবারের সম্মানহানির প্রতীকচিহ্ন হয়ে ওঠা– বারেবারে তঁাকে দঁাড় করিয়ে দেয় বিপজ্জনক খাদের ধারে। ঠিক এই কারণেই নারীর যৌনতায়, তঁার অধিকারের থেকে, বড় হয়ে ওঠে পরিবার, গোষ্ঠী ও সমাজের অধিকার, সম্মানের পরাকাষ্ঠা। ১৯৭৯-তে রাষ্ট্রসংঘ ‘Convention on the elemination of discrimination against Women’ নামে একটি সনদে, পৃথিবী জুড়ে মেয়েদের উপর হয়ে চলা নানা বৈষম্যমূলক আচরণের মধ্যে ‘ধর্ষণ’-কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে চিহ্নিত করেছিল।
আবার বিখ্যাত বই ‘দ্য হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি’-তে মিশেল ফুকো বিশ্লেষণ করেছেন– ‘যৌনতাকে কাজে লাগিয়ে বহু কার্যসাধনের পথ প্রশস্ত করা সম্ভব, অনেক রকম রণনীতির কেন্দ্রীয় উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন প্রকল্পের সহায়ক হয়ে ওঠে এই উপাদান।’ নিজের দেহ, নিজের যৌনতার উপর যেখানে মেয়েদের নিজের অধিকার হওয়ার কথা, এর পরিবর্তে তাকেই ‘ভিকটিম ব্লেমিং’-এর শিকার হতে হয়। ‘নির্বাচিত কলাম’-এ তাই তসলিমা নাসরিন লিখেছিলেন– ‘নারীকেও খেয়ে দেয়ে এঁটো কঁাটার মতোই ফেলে দেওয়া হয়। পুরুষকে কেউ শত খেলেও সে ছিবড়ে হয় না, কারণ সে ফুল বা ফল নয়, সে মানুষ।’ অস্যার্থ, সমাজের কাছে “Men’s need” যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, মেয়েরা ঠিক ততটা দূরত্বেই ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’। পুরুষতন্ত্র এখনও মেয়েদের যৌনতাকে নিজের সম্পত্তি, নিজের অধিকার বলে মনে করে।
তাই সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হয়, পরশুরাম পিতৃ-আজ্ঞা পালনে কেটে দেয় মা রেণুকার শির, রূপ কানোয়ার সতী হন, উচ্চবর্ণের বাবুদের দ্বারা গণধর্ষিতা ফুলন দেবী ডাকাত হয়ে যান, অরুণা শানবাগ ধর্ষণ ও ভয়াবহ নির্যাতনে ৪২ বছর ধরে না-মরে বেঁচে থাকেন হাসপাতালের বিছানায়, নির্ভয়া ‘লাইফ অফ আ পাই’ সিনেমা দেখে ফেরার পথে গণধর্ষণে উপড়ে যায় তঁার নিজের অন্ত্র, অনিতা দেওয়ানের ময়না তদন্তে পাওয়া যায় যোনির ভিতর ঢুকে থাকা বিরাট স্টিলের টর্চ; উন্নাও, হাথরাস, কামদুনি, ধানতলা– এমন অজস্র লোকেশন ও ঘটনার অভাব নেই।
‘এনসিআরবি’-র পরিসংখ্যান অনুসারে– ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি ধর্ষণের মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, প্রতি ১৬ মিনিটে একজন করে নারী ধর্ষিতা হন ভারতে। এই পরিসংখ্যানের বাইরেও আছে আরও বড় সংখ্যক নারী, যঁারা সাহস করে অভিযোগ করে উঠতেই পারেননি। অনেকে আবার এটাও বিবেচনা করতেই পারেন না, বৈবাহিক ধর্ষণও শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ে। ‘এনসিআরবি’-র তথ্য অনুসারে সামনে এসেছে শিউরে ওঠার মতো তথ্য, প্রতিদিন গড়ে নথিভুক্ত হওয়া ৮৬টি ধর্ষণের মামলার প্রায় ৮২টিতে ধর্ষক ধর্ষিতার
পূর্ব-পরিচিত। এরপরেও ধর্ষণকে কেন অঞ্চল বা রাজ্যভিত্তিক সমস্যা, তথা সামাজিক অভিশাপ বলে ভাবা হবে! সারা ভারত যদি এই সমস্যায় তোলপাড় হতে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, সারা ভারতেই আইনশৃঙ্খলায় এতখানি শৈথিল্য এসেছে যে ধর্ষণকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
আর. জি. কর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড আরও একটি অপ্রিয় বিষয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল। তা হল: কর্মক্ষেত্রে যৌনহেনস্তা ও নিরাপত্তার সার্বিক দিকচিহ্নটি কেমন। ২০১৩-এ কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌনহেনস্তা নিবারণে আইন চালু হয়। ‘এনসিআরবি’-র ২০২২ সালের তথ্য অনুসারে– কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন একজন করে মহিলা যৌনহেনস্তার অভিযোগ দায়ের করেন। সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ‘বিশাখা গাইডলাইন্স’ তেমনভাবে মান্য করা হয় না, (নতুন নিয়ম অনুসারে) ‘আইসিসি’ থাকলেও হয় তা অকেজো, না হয় নিয়মরক্ষার জন্য নির্মিত। যে-সহানুভূতি ও গুরুত্ব সহকারে এই ধরনের অভিযোগকে মান্যতা দেওয়া দরকার, তা-ও হয় না। আর, অভিযুক্ত যদি ক্ষমতাশালী বা কর্তৃপক্ষর নেকনজরে থাকা কেউকেটা হন, তাহলে কী হয় বলা বাহুল্য– অভিযোগকারিণী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুবিচার পান না। তথাকথিত ভদ্রবৃত্তীয় পেশার বাইরে যে-কর্মজগৎ, সেখানে বহু মহিলা কর্মরত। রাতে রোগীর সেবায় থাকা সেবিকা, অনুষ্ঠান বাড়ির রান্নার কাজ বা পরিচ্ছন্নতার কাজ যঁারা করেন, ছোট ব্যবসায়ী, হকার, সাফাইকর্মী বা দূর গ্রাম থেকে সবজির বস্তা নিয়ে শহরে আসা মহিলারা, বাবুর বাড়ির গৃহপরিচর্যা বা শিশু পরিচর্যার কাজ করা মহিলারা, শপিং মল বা সৌন্দর্য বিপণিতে যঁারা কাজ করেন– কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তা প্রতিরোধী আইনে তঁারা কতটুকু সুরাহা পান? ঘরে-বাইরে সকল মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রর!
আর. জি. কর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সাধারণ মানুষকে দঁাড় করিয়ে দিয়েছে এক চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখে।
সামগ্রিক গণ-প্রতিবাদ তারই সাক্ষ্য বহন করে। প্রত্যেকেই নির্যাতিতার সুবিচার চাইছে, চাইছে প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। কিন্তু এ-দেশের বিচারব্যবস্থায় যে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়, তা কোথাও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ‘আইপিসি’-র পরিবর্তে ভারতীয় ‘ন্যায় সংহিতা’ চালু হলেও এমন বিরলতম নৃশংসতার মামলার ক্ষেত্রেও খুব দ্রুত সমাধানের দিশা তেমনভাবে নেই। আর এই দীর্ঘসূত্রিতা কোথাও অভিযুক্তকে করে তুলছে আরও বেপরোয়া। যদিও ভারতীয় ‘নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা’ অনুসারে প্রতিটি থানা অভিযোগকারীর কাছ থেকে অভিযোগ পেলে তা নথিভুক্ত করতে বাধ্য, অভিযোগের ঘটনাস্থল তার থানার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে না-হলেও।
প্রতিটি অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে ‘এফআইআর’-এর প্রতিলিপি তৎক্ষণাৎ দেওয়া এবং যাবতীয় তদন্ত প্রক্রিয়া ভিডিওগ্রাফির অধীনে করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর সুফল সমাজের কেন্দ্র থেকে প্রান্তের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে তো? ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি’ হিসাবে কোন ধরনের শাস্তির কথা ভাবা হচ্ছে– তারও স্পষ্ট রূপরেখা প্রয়োজন। দরকারে এমনভাবে আইন সংশোধন করা উচিত, যেখানে এই ধরনের অপরাধে অভিযুক্তের মনে প্রাপ্য শাস্তি সম্পর্কে ভয়ের সঞ্চার ঘটে এবং সেই পরিণামী শাস্তি গণ-আলোচনার বিষয়বস্তু হয়। পৃথিবীর ক্রমমুক্তির পথটি কঁাটা-বিছানো, তবে এরপরেও স্বপ্ন দেখা
নিশ্চয় অন্যায় নয়!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজ
sreeparnaduttaanurag@gmail.com