চ্যাটজিপিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগেও রাজনীতিতে বিন্দুমাত্র কমেনি মানুষের সঙ্গে সরাসরি মেলামেশা, তাদের সমস্যা ও জীবনকে স্পর্শ করা, তার সঙ্গী ও শরিক হওয়ার মতো সাবেক সংযোগ পদ্ধতিগুলির গুরুত্ব। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননেতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ‘নব জোয়ার’ কর্মসূচি ও তার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ আবারও হাতেনাতে প্রমাণ করল এই চিরায়ত সত্য। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
পৃথিবী দুর্দম বেগে এগচ্ছে। রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। মালদায় বরকত গনি খান চৌধুরী দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্ব। ভোটের সময় রাজীব গান্ধী এসেছেন প্রচারে। দুপুরবেলায় মালদায় জনসভা। ভিড় খুব কম। সেই সময় জনসভাগুলোতে কিন্তু সচরাচর প্রচুর মানুষ আসত। কিন্তু সেদিন মানুষ নেই কেন? রাজীব গান্ধী স্টেজে বসেই জিজ্ঞেস করলেন বরকত সাহেবকে, এত কম লোক কেন?
প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। ১৯৮৪ সালের এমনই গ্রীষ্মের কোনও এক দুপুরে বরকত গনি খান চৌধুরী রাজীব গান্ধীকে বললেন, চাষা এখন মাঠে চাষ করছে। ফসল তুলছে। চাষের মাঠ ছেড়ে এই দুপুরবেলায় তারা আপনাকে দেখতে আসবে কেন? আপনি কি ইন্দিরা গান্ধী? বরকত তখন বিক্ষুব্ধ নেতা। সেদিন আমিও ছিলাম মালদায়। পরে বরকত সাহেব বলেছিলেন, বিকেলের পর জনসভাগুলো প্রদেশ কংগ্রেস ঠিক করেছে অন্যত্র। আর দুপুরবেলায় মালদায়, যাতে লোক কম আসে।
এসব পুরনো রাজনীতির গল্প। কিন্তু আজ এই গল্পটা কেন করছি? তার কারণ, তখন থেকেই মানুষ জনসভায় আসাটা কমিয়ে দিচ্ছে। চাষের মাঠ ছেড়ে কোনও নেতার জন্য কৃষক আসবেই বা কেন? কারখানা ছেড়ে শ্রমিক আসবে কেন? ছুটির দিন না হলে সরকারি কর্মচারীরা আসবে কেন?
সময় বদলে গেল। বিদেশে দেখলাম, মানুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে টেলিভিশনের পর্দায় বিতর্ক শুনছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টই বা ক’টা জনসভা করছেন? সময় বদলাচ্ছে। জনসভার প্রাসঙ্গিকতা কমছে। মানুষের সঙ্গে জনসংযোগের জন্য আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। ব্রডশিট খবরের কাগজ থেকে এল ইলেকট্রনিক। ইলেকট্রনিক যুগের পর এল নতুন মিডিয়া যুগ, ডিজিটাল। এখন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সর্বশেষ আর্টিফিশিয়াল ইন্ট্যালিজেন্স। চ্যাটজিপিটি। সাংঘাতিক সব ব্যাপার! তাহলে এই ভোটের সময় জনসংযোগের প্রাসঙ্গিকতা, ম্যানুয়াল কনট্যাক্ট কি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল? মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের যে সাবেক প্রথা, সেটা কি উঠে গেল?
সম্প্রতি তৃণমূলের নবীন নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রায় দু’মাস ধরে চলা ‘নব জোয়ার’ কর্মসূচির সাফল্য দেখে মনে হচ্ছে- এখনও সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপট থেকে, মানুষের সঙ্গে যে সরাসরি জনসংযোগ তথা ‘আইবল কনট্যাক্ট’, অনেক জায়গায় গিয়ে মানুষকে স্পর্শ করা, জন-দৃষ্টিকোণ শুধু তৈরি করাই নয়, প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা- এসবের প্রয়োজনীয়তা আজও ফুরয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে চলে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কংগ্রেস তখন অভিজাত সমাজের ড্রয়িং রুমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই ড্রয়িং রুম থেকে কংগ্রেসকে আমজনতার মাঝখানে নিয়ে গেলেন গান্ধী। হাতে একমুঠো নুন নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। ‘ডান্ডি অভিযান’ থেকে ‘অসহযোগ আন্দোলন’। বলা হল, ভারতে জনসংযোগের সবথেকে বড় ‘মসিহা’ মহাত্মা গান্ধী। The great
communicator of India. যে মানুষটির ছবি টাকায় থাকে, সেই মানুষটিই প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনকে, ‘কংগ্রেস’ নামক সংগঠনকে মাস মোবিলাইজেশন-এর পথে নিয়ে গিয়েছিলেন।
শুধু তো গান্ধীজি নন, ধর্মীয় ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি, কেরলের শঙ্করাচার্য চলে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। অর্থাৎ, মানুষের কাছে পৌঁছতে হয়।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও কিন্তু দক্ষিণেশ্বরে প্রথম যুগে, সেখানে গিয়ে বসেছিলেন, এমনটা নয়। তিনি বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্রর বাড়িতে পৌঁছে যেতেন। ব্রাহ্ম সমাজে গিয়ে বলতেন, ‘আমি নুচি খাব।’ এটা হচ্ছে, ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের অসাধারণ নিদর্শন।
মহান মানুষগুলি যে পথে এগিয়েছেন, আজও রাজনীতিতে সেই পথ ব্রাত্য নয়- সেটাই বুঝিয়ে দিল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সাম্প্রতিকতম জেলাওয়ারি সফর। এই সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য কী, পঞ্চায়েত নির্বাচনে এর কী প্রভাব পড়বে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকবে কি না এই নব জোয়ার- এই সবই আলোচনার বিষয়। তবে, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগঠন থেকে জননেতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় উপাদান এই প্রত্যক্ষ সংযোগ ব্যবস্থা।
[আরও পড়ুন: চিন না পাকিস্তান, প্রধান শত্রু কে? কী গল্প বলছে প্যাংগং-ডাল]
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নব জোয়ার কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল, ‘নব’। বৈষ্ণব পদাবলিতে আছে ‘নিতুই নব, নিতুই নব। নবরে নব, নিতুই নব।’ অর্থাৎ, নিরন্তর আমরা নতুনের সাধনা করছি। একটু মনে করুন, সিপিএম যখন দীর্ঘকালব্যাপী শাসন চালানোর পর সংকটাকীর্ণ হয় তখন নতুনতর বামফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা করেছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর অবয়ব সামনে এনে একটা নতুন সিপিএম গঠনের প্রয়াস শুরু হয়। একটা ভোট যুদ্ধে সিপিএম নিজেকে সামলাতে পেরেছিল এবং বুদ্ধবাবু মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। এগুলো হল একধরনের রাজনৈতিক কারিগরি বিদ্যা। আসলে সিপিএম বদলাতে পারেনি। আর সেই কারণেই শেষরক্ষাও হয়নি। এটাও গোটা পৃথিবী জুড়ে হয়। লেবার পার্টি নতুন লেবার পার্টি হয়ে ওঠে। কেননা, সময়ের হাত ধরে, প্রজন্মের হাত ধরে সংস্কৃতি বদলায়, রুচি বদলায়, অগ্রাধিকার বদলায়।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম সফরে নেমে বলেছিলেন- পঞ্চায়েতে প্রার্থী ঠিক করবে জনগণ। যারা তস্করবৃত্তির জন্য পরিচিত, আর যাই হোক, তাদের প্রার্থী করা হবে না। সুতরাং, দলতন্ত্র নয়, মানুষের অগ্রাধিকার। তাই নিয়ে দল এবং বেসরকারি সংস্থার মধ্যে মূল্যায়নে তুলকালাম কাণ্ড বেধে যায়। তখন মনে হয়েছিল, এ যাত্রা শেষ পর্যন্ত বন্ধ না হয়ে যায়! অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। তাঁর চেষ্টা সম্পূর্ণ সফল না-ও হতে পারে। সাধারণত একটা চেষ্টা শুরু হলে শতকরা একশো ভাগ সাফল্য আসে না। তা’ বলে তাঁর এই প্রয়াস, এই উদ্যোগ যে অনুচিত- এমনটা কি কেউ বলবে?
শুধু তা-ই নয়, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি হিসাবে এই রূপান্তর পর্বে জননেত্রীকেই অনুকরণ করেছেন। অনেকেই বলেছেন- মমতা চা খেতে যান। অভিষেকও মানুষের সঙ্গে চা খাচ্ছেন। যেখানে যেখানে অসন্তোষ, সেখানে গাড়ি থামিয়ে তাদের কথা শুনছেন। সেটা মতুয়া সম্প্রদায়ও হতে পারে, হতে পারে উপজাতি সমাজও। এই গরমের মধ্যেও কাতারে কাতারে মানুষ এসেছে, সেটাও তো চোখের সামনে আমরা দেখেছি। এই সবই প্রশংসনীয়। শেষ রক্ষা হবে কি হবে না, তার বিচার ভবিষ্যৎ বলবে।
এক বন্ধুবর সম্পাদক প্রশ্ন করেছিলেন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগেও যদি শেষ পর্যন্ত অভিষেকের নব জোয়ার, জনসংযোগ কর্মসূচি প্রমাণ করে, মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগই হল আসল; সেক্ষেত্রে এই মেকি বাস্তবতা রূপায়ণের প্রযুক্তি আর সবই মোবাইল ক্যামেরায় দেখা- কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা তাহলে অপ্রয়োজন? সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু অবাস্তব কাণ্ড করার জন্যই কি তাহলে এই আধুনিক প্রযুক্তি?
আমার মনে হয়, সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে রান্নায় অনুপানের গুণ বদলায়। কিন্তু সবকিছুই থেকে যায়। ১৯৯০-’৯১ সালে লন্ডনে ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-এর সম্পাদক বলেছিলেন, আমরা ব্রডশিট থেকে ট্যাবলয়েডে চলে যাচ্ছি। ব্রডশিটগুলো গ্রামের দিকে থাকবে। শহরে ট্যাবলয়েড করতে হবে। কেননা, মানুষ এখন আর এত বড় বড় কাগজ পড়তে চাইছে না। টেলিভিশন সেই পরিসর দখল করছে। আবার সেই টেলিভিশনের পরিসর দখল করছে ডিজিটাল চ্যানেল। সেই ডিজিটালের পরিসর এখন দখল করছে কৃত্রিম মেধা পদ্ধতি। আমরা জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য মাস বা পারসুয়েসিভ ওয়েপন তৈরি করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডিও তৈরি হচ্ছে, এই ধরনের পারসেপশন তৈরিতে।
এইসব কাণ্ডকারখানা যেমন চলছে; পাশাপাশি গান্ধীজি থেকে শঙ্করাচার্য- সেই ট্র্যাডিশনও কিন্তু সমানে চলে আসছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিকতম জনযাত্রা।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com