কৃশানু মজুমদার: রোহিত শর্মার টিম ইন্ডিয়ায় নেই একজনও বাঙালি ক্রিকেটার। নাজমুল হোসেন শান্তর বাংলাদেশে এগারো জনই বাঙালি।
কানাডার বিশ্বকাপ দলে রয়েছেন এক বঙ্গসন্তান। কানাডার (Canada Cricket Team) 'বাঙালি' নারিন নামেই তিনি পরিচিত। সুনীল নারিনের মতোই তিনিও রহস্যময় স্পিনার। সদ্য আইপিএল জয়ী ক্যারিবিয়ান তারকাকেই তিনি করেছেন 'জীবনের ধ্রুবতারা'। হাজার বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা, বিরুদ্ধ স্রোত অতিক্রম করে কানাডার জার্সিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেমে পড়েছেন বাঙালি নিখিল দত্ত (Nikhil Dutta)।
[আরও পড়ুন: আমেরিকার মাটিতে প্রথমবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ, নিউ ইয়র্কের মুখে শুধুই উদাসীনতা]
রবিবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হার মেনেছে কানাডা। বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচে নিখিল নেন একটি উইকেট। রবিরাতে ওন্টারিওবাসী মিহির দত্তর সঙ্গে যখন যোগাযোগ করা হল, তখন ছেলের পারফরম্যান্স আশানুরূপ হয়নি বলে হতাশা গোপন করেননি তিনি। এক নিঃশ্বাসে মিহিরবাবু বলছিলেন, ''বিশ্বকাপের আগে দল থেকে হঠাৎই ওকে ছেঁটে ফেলা হল। পরে দলে আবার ফিরলও। অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটেছে। প্রথম ম্যাচটা দিন-রাতের ছিল। নাকল বল ওর প্রধান অস্ত্র। শুকনো বল তাও গ্রিপ করা যায়। কিন্তু বল ভিজে থাকলে গ্রিপ করায় সমস্যা হয়। সেটাই হল দিন-রাতের ম্যাচে। তার উপরে আউটফিল্ড খুব দ্রুতগতির ছিল। একটা উইকেট পেলেও রান বেশি দিয়ে ফেলেছে।''
একই সঙ্গে আশঙ্কিতও তিনি। একসময়ে কলকাতার ক্লাব ক্রিকেটে উয়াড়ি, খিদিরপুরের হয়ে খেলা মিহিরবাবু এক নিঃশ্বাসে বলে যাচ্ছিলেন, ''এই ম্যাচের রেশ আবার পরের ম্যাচগুলোয় পড়বে না তো?''
চলতি মাসের ৭ তারিখ কানাডার দ্বিতীয় ম্যাচ আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে। সেই ম্যাচের আগে ৬ তারিখ নিউ ইয়র্কে যাবেন নিখিলের মা শ্রীলা দেবী এবং স্ত্রী মেঘনা। কথায় বলে স্নেহ নিম্নদিকেই ধাবিত হয়। ছেলের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন শ্রীলা দেবী। তিনি বলছিলেন, ''লুচি, আলুর দম, মাছের প্রিপারেশন খুব পছন্দ করে নিখিল। ওর কোনও বিষয়েই অভিযোগ নেই। যা খেতে দেবেন, তাই খাবে। না পেলে দুধ-কর্নফ্লেক্স খেয়ে রাত কাটিয়ে দেবে। কেউ জানতেও পারবে না।'' এরকম একজন ব্যক্তিত্বকে দলে পেতে চাইবেন সব অধিনায়কই।
সদ্য বিয়ে করেছেন নিখিল। স্ত্রী মেঘনা এবং বাবা-মার সঙ্গে কানাডার 'নারিন'।
কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগেই তো চূড়ান্ত দলে তাঁকে নেওয়া হয়নি। পত্রপত্রিকায় খবর হয়েছিল, বোর্ড রাজনীতির শিকার হয়ে দল থেকে বাদ পড়েছেন নিখিল দত্ত-সহ আরও দুজন। কানাডা বোর্ডের সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েছিলেন নিখিল বাদে বাদ পড়া বাকি দুই ক্রিকেটার। আদালতের রায়ে নতুন করে আবার দল নির্বাচন করা হয়। দলে ঢুকে পড়েন নিখিল।
কানাডা ক্রিকেট বোর্ডে এখন মোটেও বসন্ত বিরাজ করছে না। চার্লস ডিকেন্সের কথায়, ''ইট ওয়াজ দ্য ওয়ার্স্ট অফ টাইমস।'' এ বড় সুখের সময় নয়। সেই কারণেই হয়তো আশঙ্কিত হচ্ছেন মিহিরবাবু। যদি একটা ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখিয়ে টুর্নামেন্টের বাকি ম্যাচগুলোয় কোপ পড়ে ছেলের উপরে! কিন্তু নিখিল যে আবার অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নন। তাঁর ফোকাস বিশ্বকাপে। মার্কিনীদের বিরুদ্ধে আশানুরূপ পারফম্যান্স না হওয়াতেও বিচলিত নন। মিহিরবাবুকে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় নিখিল লিখেছেন, ''একটা ম্যাচে হতেই পারে। আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরব পরের ম্যাচগুলোয়।''
নিখিলের এই মানসিক জোরই তাঁর নিজস্ব টিপছাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনূর্ধ্ব ১৫ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে তাঁকে ভয় দেখানো হয়েছিল, স্লেজিংয়ের বাউন্সার ধেয়ে আসবে তাঁর দিকে। স্বাভাবিক খেলাই খেলতে পারবেন না। কিন্তু সে সবকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছেন নিখিল। এই মানসিক জোরই নিখিলকে বাধার এভারেস্ট ডিঙোতে সাহায্য করেছে। কানাডার ক্রিকেট পরিকাঠামো থেকে হালআমলের বোর্ড রাজনীতি--স্রোতের বিপরীতে নিরন্তর সাঁতার কেটে চলেছেন এই বঙ্গসন্তান।
কুয়েতে জন্ম নিখিলের। কানাডার বোলিংয়ের অন্যতম ভরসাও তিনি। বাবা মিহির দত্ত কলকাতার বেলেঘাটার বাসিন্দা ছিলেন একসময়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ১৯৮৯ সালে কলকাতা ছাড়েন তিনি। কর্মসূত্রে মধ্যপ্রাচ্য, নাইরোবি হয়ে ১৯৯৯ সালে কানাডায় পাকাপাকিভাবে থাকা শুরু করেন তাঁরা। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দেশে নতুন করে শুরু করা এবং জীবনের স্রোতে ভেসে চলা কতটা কঠিন, তা ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন।
২০০৩ বিশ্বকাপে এক বাঙালি দেশনায়ক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বপ্ন অল্পের জন্য ভেঙে যায়। সেই বিশ্বকাপই আরেক বঙ্গসন্তানকে ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। ২০০৩ সালে মিহিরবাবু ও কানাডার জাতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার ডেরেক পেরেরা মিলে তৈরি করেন ওন্টারিও ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। সেটাই নিখিলের ক্রিকেট শেখার প্রথম পাঠশালা।
গোড়ার দিকে 'দুসরা' করতেন। পরে সুনীল নারাইনের মতো 'নাকল' বলে প্রতিপক্ষের উইকেট ভেঙে দেওয়া শুরু করেন। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে তাঁর প্রথম শিকার কেভিন পিটারসেন। সিপিএলেই নারিনের স্নেহধন্য হন কানাডার 'বাঙালি' নারিন। বিশ্বকাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্দ্রিয়াস গাউস তাঁর প্রথম উইকেট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২.৪ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৪১ রানের বিনিময়ে একটি উইকেট নেন নিখিল।
ছক্কা হাঁকিয়ে, উইকেট তুলেও শান্ত থাকেন সুনীল নারিন। উচ্ছ্বাস দেখান না, স্লেজিং করেন না। নিখিলও সেরকমই। মাঠের ভিতরে ও বাইরে খুব ভদ্র একজন মানুষ। সবার ভালোবাসা আদায় করে নিয়েছেন। মিহিরবাবু এবং শ্রীলা দেবীর বন্ধু সুস্মিতা দত্ত বলছিলেন, ''অত্যন্ত সুশিক্ষিত এবং ভদ্র ক্রিকেটার নিখিল। সবার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে। মাঠে মাথা গরম করেছে নিখিল, এমন কথা শুনিনি কখনও। ও আমাদের গর্ব।''
ক্রিকেট মাঠে বাঙালিকে স্বপ্ন দেখানো সৌরভ বহু আগে ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছেন। তাঁর স্বপ্নের ব্যাটনটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো এই মুহূর্তে কেউ নেই এই বাংলায়। মহারাজের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই যেন স্তিমিত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির ক্রিকেট-আভা। ঘরের পাশের আরশি নগরের একদল বাঙালি এ বারও সগর্বে ঘুরবেন বিশ্বকাপের আসরে। আমরা পারছি না কেন? কেন পিছিয়ে পড়ছি, এই কথাটাই যেন বুদবুদ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এই বাংলার বাঙালির বুকে।
জামাইকা, গুজরানওয়ালা, বার্বাডোজ, রোপার, চণ্ডীগড়, রাওয়ালপিণ্ডি...কানাডার বিশ্বকাপ দলে বহু ভাষাভাষী এবং বহু সংস্কৃতির মেলবন্ধন। সেই দলেরই এক বঙ্গসন্তান আসল যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালির জয়ধ্বজা ওড়াচ্ছেন।
কানাডার নিখিল দত্ত আসলে এক লড়াইয়ের নাম। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি! নেই, বাঙালি কোথাও নেই, এই দীর্ঘশ্বাস যখন পরিতাপের কারণ হয়ে উঠছে, তখন চলতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অন্য এক চিত্রনাট্য তুলে ধরছে। বলে দিয়ে যাচ্ছে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বাঙালি রয়েছে আগের জায়গাতেই। ঊষর জমিতে এখনও ফুল ফোটাতে পারে। দরকার শুধু আত্মবিশ্বাস আর মনের জোর।