বিশ্বদীপ দে: সেই আদিকাল থেকেই মানুষ রহস্য ভালবাসে। যে রহস্যের জন্ম সাহিত্য, সিনেমা কিংবা লোকগাথায়, তার চেয়ে অনেক বেশি আবেদন সেই ভয়ের, যা ফুটে ওঠে খবরের কাগজের পাতায়। কেননা খবরের কাগজে যা থাকে তা ‘ফ্যাক্ট’। তাই সত্যির আঁচে আরও গনগনে হয়ে ওঠে রহস্যের (Mystery) বুনোট। কোনও বানানো গপ্পো নয়, একেবারে ‘আঁখো দেখা হাল’ পাঠককে আরও বেশি শিরশিরে অভিজ্ঞতার ভিতরে টেনে নিয়ে যায়। ঠিক যেমন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। ‘উইকলি ওয়ার্ল্ড নিউজ’-এর পাতাজোড়া একটা খবরে চোখ আটকে গিয়েছিল সকলের। বাকি আর সব খবর মুহূর্তে ফিকে হয়ে গিয়েছিল। এও সম্ভব? ১৯৫৪ সালে হারিয়ে যাওয়া বিমান কিনা ফিরে এসেছে ৩৫ বছর পরে। বিমানের ভিতরে সব মানুষ ততদিনে হয়ে গিয়েছে কঙ্কাল (Skeleton)! সেই মৃতদের নিয়েই এতদিন ধরেই আকাশে আকাশে ঘুরে বেরিয়েছে বিমানটি!
এমন খবর যে সকলের মাথা ঘুরিয়ে দেবে তা আলাদা করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। পড়বার পরে জেগে উঠতে থাকে একের পর এক প্রশ্ন। আর সব প্রশ্নের গায়েই এসে লাগতে থাকে অলৌকিকতার সোনালি মোড়ক। সেটা বলার আগে তাহলে শুরু থেকে শুরু করা যাক। ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পশ্চিম জার্মানি (West Germany) থেকে ব্রাজিলের (Brazil) উদ্দেশে উড়েছিল ফ্লাইট ৫১৩ (Santiago Flight 513)। পোর্তো আলেগ্রেতে পৌঁছতে তার লাগার কথা ১৮ ঘণ্টা। কিন্তু…
[আরও পড়ুন: বাস্তবের ‘বাহুবলী’! বাইক মাথায় বাসের ছাদে উঠছেন এই ব্যক্তি, ভিডিও দেখে বিস্মিত নেটদুনিয়া]
আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে দিয়ে যাওয়ার সময় আচমকাই সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও কোনও খোঁজ মিলল না। এমন ঘটনা অবশ্য বিরল নয়। বহু ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার সময় এমন ঘটে। সকলেই ধরে নিলেন, বিমানটি ভেঙে পড়েছে মাঝসমুদ্রে। বহু অনুসন্ধানকারী দলই এলাকা চষে ফেলল। কিন্তু ফ্লাইট ৫১৩-র চিহ্নটুকুও মিলল না! ক্রমে সময় গড়াল। সকলের স্মৃতি থেকে মুছে গেল দুর্ঘটনার স্মৃতি। বছর দুয়েক পরে ব্যবসায় পাততাড়ি গোটাল সান্টিয়াগো এয়ারলাইন্স। আর কোনও রকম প্রমাণ না মেলায় একসময় বন্ধ হয়ে গেল ফ্লাইট ৫১৩-র তল্লাশি অভিযানও।
একেবারে জাম্প কাট টু ১৯৮৯, ১২ অক্টোবর। আচমকাই এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলাররা আবিষ্কার করলেন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে এক অচেনা বিমান! অনেক চেষ্টা করা হল বিমানটির সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু কেউই কোনও সাড়া দিচ্ছে না! ব্যাপারটা কী যখন কারও মাথায় ঢুকছে না, তখনই পরের চমক! আকাশ থেকে নেমে আসছে বিমানটি। এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের নির্দেশেই কোনও বিমান ঠিকঠাক মাটি ছুঁতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিমানটি কোনও নির্দেশের তোয়াক্কা না করেই দিব্যি মাটিতে নেমে এল। রানওয়ে দিয়ে মসৃণ দৌড়ে গিয়ে একসময় থেমেও গেল হিসেব মেনে।
চমকের তখনও বাকি ছিল। বা বলা ভাল, আসল চমক তখনও প্রকাশ্যেই আসেনি। বিমানকর্মীরা কৌতূহলী হয়ে বিমানটির দরজা খুলতেই কার্যত ‘ফ্রিজ’ করে গেলেন! এ কী! বিমানের ভিতরে যাত্রীদের আসনে বসে রয়েছে সারি সারি কঙ্কাল। মোট ৯২টি। ৮৮ জন যাত্রী। চারজন বিমানকর্মী। আর ককপিট! সেখানে রয়েছে বিমানটির পাইলট ক্যাপ্টেন মিগুয়েল ভিক্টর কারির কঙ্কাল। সেই কঙ্কালের হাত কিন্তু বিমানের কন্ট্রোলে। যেন সেই হাতই এই মাত্র সুদক্ষ হাতে সেফ ল্যান্ডিং ঘটিয়েছে ফ্লাইট ৫১৩-র। হারিয়ে যাওয়া বিমানটিকে ততক্ষণে চিনতেও পেরেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। এ যে সেই সাড়ে তিন দশক আগে হারিয়ে যাওয়া বিমান। অনেক খুঁজেও যার কোনও খোঁজ মেলেনি। তার মানে এত বছর ধরে একটানা আকাশে উড়েছে সেটি। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? বিমানের সকলে মারা যাওয়ার পরেও কী করে তা এভাবে নেমে আসতে পারে মাটিতে? এতদিনের জ্বালানিই বা এল কোথা থেকে?
[আরও পড়ুন: চোখ উঠেছে কপালে! বিচিত্রদর্শন ছাগলছানা দেখতে ভিড় উপচে পড়ছে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে]
প্রশ্ন, প্রশ্ন, প্রশ্ন! যে কোনও অলৌকিক ঘটনার সঙ্গেই অপরিহার্য ভাবে জুড়ে থাকে প্রশ্ন। কিন্তু এ তো অলৌকিক নয়। রীতিমতো খবরের কাগজে ছাপা হওয়া খবর! আর এখানেই ‘কাহানি মে টুইস্ট’। প্রকাশিত এই খবর নিয়ে সাড়া পড়ে গেলেও তা ছিল একেবারেই বানানো গল্পগাছা। বলা ভাল আষাঢ়ে গপ্পো। স্রেফ ধাপ্পাবাজি। আসলে ‘উইকলি ওয়ার্ল্ড নিউজ’ জাতে ট্যাবলয়েড। এর আগেও এমন আজগুবি খবর ছেপেছে তারা। উদ্দেশ্য একটাই। আর তা সহজেই অনুমেয়। বিক্রি বাড়ানো। তবে তা অবশ্য সহজে প্রমাণ করা যায়নি। কিন্তু এমন কিছু অকাট্য প্রমাণ রয়েছে, যা নিয়ে একটু মাথা ঘামালেই পরিষ্কার হয়ে যায়, এর মধ্যে সত্যতার লেশমাত্র নেই।
এক নম্বর প্রমাণ অবশ্যই ‘উইকলি ওয়ার্ল্ড নিউজ’-এর বদনাম। ১৯৮৫ সালেও এমন গল্প ফেঁদেছিল তারা। সেবারের গল্পটা ছিল ফ্লাইট ৯১৪-র। সেটি নাকি নিরুদ্দেশ হওয়ার ৩৭ বছর পরে ফিরে এসেছিল। দুই ঘটনার এতটা মিল কাকতালীয় হতে পারে না। প্রমাণ নম্বর দুই। জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক ‘দ্য টোয়ালাইট জোন’-এর ১৯৬১ সালের একটি এপিসোডের নাম ছিল ‘দ্য ওডিসি অফ ফ্লাইট ৩৩’। সেই গল্পে একটি বিমান বাইশ বছর পিছিয়ে গিয়ে ১৯৩৯ সালে চলে গিয়েছিল। কেউ যদি এটা দেখার পরে ফ্লাইট ৫১৩-র খবরে চোখ বোলায়, তার সঙ্গে সঙ্গেই চেনা চেনা লাগতে শুরু করবে। এবং প্রমাণ নম্বর তিন। ১৯৫৪ সালে ওই নামের কোনও বিমানের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর ছাপা হয়নি কোনও খবরের কাগজে। যা কিছু ক্লিপিং তা ১৯৮৯ সালেরই। সুতরাং, গোড়াতেই গলদ। দুর্ঘটনাই যেখানে ঘটেনি সেখানে ফিরে আসার প্রশ্নই যে নেই।
কিন্তু সাধারণ মানুষ এসব প্রমাণের তোয়াক্কা করে না। কথাতেই বলে, মানুষ ভূত দেখে পরের চোখে। সব সময় অমুকে দেখেছে, তমুকে শুনেছে না বললে ভূতের গল্প যে জমে না। আর খোদ খবরের কাগজের ক্লিপিং যেখানে কঙ্কাল পাইলট আর ভূতুড়ে বিমানের সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেখানে ব্যাপারটা যে জমে কুলপি হয়ে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য। কেউ আবার অলৌকিকতা সরিয়ে রেখে কল্পবিজ্ঞানকে টেনে এনেছেন। তাঁদের মতে, বিমানটা নাকি ওয়ার্ম হোল দিয়ে একলাফে ৩৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছিল। ইন্টারনেটে চোখ বোলালে এমন ধরনের রোমাঞ্চকর আরও ঘটনার খোঁজ মেলে। কিন্তু একটু যুক্তি দিয়ে বুঝতে গেলেই ক্রমে উটের পাকস্থলী খুঁজে পাওয়া যায়। গল্পের গরু গাছে ওঠে এই প্রবাদটা তো পুরনো হয়ে গেছে। ট্যাবলয়েডের বিমান ৩৫ বছর আকাশে ওড়ে, এটা শুনতে কেমন লাগবে?