shono
Advertisement

রাহুল গান্ধীকে খোলা চিঠি

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভরাডুবির জন্যও কি একা অধীর চৌধুরী আর আবদুল মান্নান দায়ী?
Posted: 03:14 PM Sep 25, 2021Updated: 03:14 PM Sep 25, 2021

মোদি এবং অমিত শাহকে আপনার যতই অপছন্দ হোক, এটা তো মানবেন, ওঁরা ২৪x৭ রাজনীতিটাই করেন? তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও যেভাবে পরিশ্রম করছেন, যেভাবে পরিণতমনস্ক হয়ে উঠেছেন, আপনি জাতীয় স্তরে তা করতে কিন্তু ব‌্যর্থ। তাই তর্কটা শুধুমাত্র পারিবারিক ‘উত্তরাধিকারী’ হওয়া নয়, মূল প্রশ্ন হল, আপনি যোগ‌্যতার প্রমাণ দিতে পারছেন কি না। ‘কংগ্রেস সিস্টেম­­’-এর অবস্থা এখন তথৈবচ! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

শ্রদ্ধেয় রাহুল গান্ধী,

অনেক দুঃখ-বেদনা নিয়েই আপনাকে এই চিঠি লিখছি। অ‌্যালেন অক্টাভিয়ান হিউম থেকে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্মাণ ঘটিয়েছিলেন, সেই প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন সংগঠনটির এই ছেঁড়া তমসুক দশা দেখে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একদা এই দলটিকেই অভিজাত শ্রেণির বৈঠকখানা থেকে আমজনতার কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। গান্ধীজির প্রশংসা করে লেনিন বলেছিলেন, সেদিনের পটভূমিতে আসলে তিনি এক প্রগতিশীল মানুষই ছিলেন। রাজনীতি-বিজ্ঞানী ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক ব‌্যবস্থাকে বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস সিস্টেম’। অথচ, এখন, সেই কংগ্রেসের রাজ‌্যওয়াড়ি পরিস্থিতি দেখে, আপনার অতি বড় ভক্তও আহ্লাদে আটখানা হতে পারবে না।

পাঞ্জাবে মুখ‌্যমন্ত্রী বদল করলেনই যখন, তাহলে একদম ভোটের মুখে কেন করলেন? জাঠ শিখের বদলে দলিত শিখকে মুখ‌্যমন্ত্রী করা অবশ্যই অতীব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই মুহূর্তে বিজেপিতেও কোনও দলিত মুখ‌্যমন্ত্রী আছেন বলে জানা নেই। কিন্তু এই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে কংগ্রেস কাজে লাগাতে হিমশিম খাচ্ছে। কারণ, ক‌্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং বনাম নভজ্যোৎ সিং সিধুর অন্তর্কলহ মেটানো কোনওভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। আবার হাইকমান্ড ঘোষণা করেছে যে, আসলে ভোটের পর নভজ্যোৎ সিধু-ই হবেন দলের মুখ‌্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। তাতে ক‌্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছেন, আমার আপাতত একটাই লক্ষ‌্য: সিধুকে কিছুতেই মুখ‌্যমন্ত্রী হতে দেব না।

[আরও পড়ুন: রোমাঞ্চে ঠাসা পাঞ্জাব চিত্রনাট্য, ক্যাপ্টেনের বিতারণ কংগ্রেসের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ না ‘হারাকিরি’?]

রাহুলজি, পাঞ্জাবের মতো কৃষি ও কৃষক প্রধান এক রাজ্যে, যেখানে অকালি-র মতো প্রাচীনতম ‘এনডিএ’ শরিক বিজেপিকে পরিত‌্যাগ করেছে, ফলে মায়াবতীর সঙ্গে অকালি জোট বেঁধেছে, তৃণমূল কংগ্রেস সেখানে এই অকালি-মায়াবতী জোটে ছোট শরিক হতে পারে। এই অবস্থায়, ভোটের মুখে, শাসক দলের এহেন অভ্যন্তরীণ কুরুক্ষেত্রে আপনার কোনও দায়িত্ব আছে বলে কি আপনার মনে হয় না?

ধরুন, ছত্তিশগড়ে মুখ‌্যমন্ত্রী অপসারণের দাবিতে সরব টি. এস. সিং দেও। আপনি নাকি সরকার গঠনের সময় বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি সামলাতে বলেছিলেন- আড়াই বছর পর মুখ‌্যমন্ত্রী বদল হবে। সেই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই এখন মুখ‌্যমন্ত্রী-বদল অভিযান তুঙ্গে! এই বদলেও স্বাভাবিকভাবে জাতপাতের ইস্যু এসে গিয়েছে। কংগ্রেস দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন কোনও বিষয় নয়। নেহরু-গান্ধী, প্যাটেল-সুভাষের সময়ও এই ঘাত-প্রতিঘাত ছিল। হয়তো এখন যেভাবে কদর্য রূপ পেয়েছে, তা হয়তো সেদিন ছিল না। ব‌্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতা দখল ও ভোগের এহেন নির্লজ্জ, নগ্ন এবং যেনতেন প্রকারেণ দাদাগিরি ছিল না। দলের এই গোলমাল সামলানোর জন‌্য কংগ্রেস দলের কাণ্ডারী হিসাবে আপনার কি কোনও দায়িত্ব নেই?

রাহুল গান্ধী, আপনি মানুষ হিসাবে খুবই ভাল মনের বলে আমি মনে করি। দেখুন, সাংবাদিক হিসাবে শুধু নয়, এই অখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের এক নাগরিক হিসাবেও আমার কাছে কোনও ‘মডেল’ রাজনৈতিক দল নেই। ‘আদর্শ নেতা’ নেই। এমনকী, কোনও আদর্শ সার্বভৌম রাষ্ট্রও এই পৃথিবীতে আছে বলে মনে করি না। আঅমি নিজে ‘নোটা’ টাইপ- কিন্তু এদেশে ভোট ব‌্যবস্থায় ‘নোটা’ স্বীকৃতি পেলেও অনেক সময় তাতে অন‌্যান্য দলের লাভ হয়ে যায় বলে মনে করা হয়। কাজেই ‘নোটা’-তে মনের শান্তি হলেও- তা উচিত কি না প্রশ্ন থাকে। এই ‘নোটা’-ভাবনার মধ্যে থেকে এক ধরনের হতাশাবাদ ও সিনিসিজমের জন্ম হতে পারে।

আপনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। মনে হয়েছে ইন্টেলিজেন্ট পাবলিক স্পিকিংয়ে আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ‌্যালয় ‘ডাব্বু’ খেতাব দিলেও আপনার মধ্যে অনেক সৃজনশীল ধারণা আছে। আপনার শৈশব-কৈশোর ও তরুণ জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার জন‌্যও সহানুভূতি কাজ করে। ব‌্যক্তিত্ব গঠনের নেপথ্যে পারিবারিক, সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মনস্তত্ত্ব (কার্যত বন্দিদশার প্রভাব) অনুভব করি।

কিন্তু আপনি তো দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এবং এখনও দলের প্রকৃত কাণ্ডারী। তাহলে আপনি কেন দায়িত্ব গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন? হয় আপনি সভাপতির পদ গ্রহণ করে দলের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির দায়িত্বভার নিন; আর তা না হলে বলুন- আপনি দায়িত্ব নিতে চান না। আপনি যে দলের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, তা ‘সাময়িক বৈরাগ‌্য’ নয়। অন‌্য কেউ এই দায়িত্ব গ্রহণ করুন।

নতুন কোনও সভাপতি হোক কংগ্রেসের। কিন্তু এখনকার এই ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না’ পরিস্থিতিটা পরিত‌্যাজ‌্য হওয়া দরকার। আপনিই নেতা। সারাক্ষণ আপনি টুইটও করছেন, কিন্তু আপনি দায়িত্ব নেবেন না। অনেকে বলছেন ইন্দিরার জমানায় দায়িত্ব নেননি সঞ্জয় গান্ধী, কিন্তু ‘জরুরি অবস্থা’ জারি থেকে ‘নাসবন্দি’- সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নেপথ্যে তিনিই ছিলেন অদৃশ‌্য প্রভু।

দেখুন, গোয়াতে কংগ্রেস নেতারা তৃণমূল কংগ্রেস চলে আসতে চাইছেন- আপনি এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওঁদের দলে টানতে তৎপর হননি। ওঁরা নিজেরাই চলে আসছেন তৃণমূলে। এই হল নেতৃত্বের সংকট! এর আগে এমনটা হয়েছে ত্রিপুরায়। এখন ক‌্যাপ্টেনের সঙ্গে বিজেপি পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করেছে। ক‌্যাপ্টেন কি একাই দায়ী? হাইকমান্ডের কোনও দায়িত্ব নেই? শরদ পাওয়ারের মতো নেতা বলেছেন, কংগ্রেসকে সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি মানসিকতা ছাড়তে হবে, ও আঞ্চলিক দলের নেতৃত্ব মানতে হবে। রাহুলজি, আপনি কি বুঝতে পারছেন না, পাওয়ারের এ বক্তব‌্যর সঙ্গে মমতা থেকে স্তালিন- প্রত্যেকেই একমত।

[আরও পড়ুন: উপনির্বাচনের উত্তাপে ফুটছে ভবানীপুর, লড়াই আসলে কার?]

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস যে শূন্য হয়ে গেল- তার জন‌্যও কি একা অধীর চৌধুরী আর আবদুল মান্নান দায়ী? হাইকমান্ড যখন লো-কম‌ান্ড হয়ে যায়, তখন রাজ‌্যস্তরের নেতাদেরও নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ দেওয়ার বৈধ কর্তৃত্ব হারাতে হয়। সিপিএম না মমতা- অভিমুখ কোনদিকে, তা-ও কি আপনি স্পষ্ট করতে পেরেছিলেন ২০২১-এর ভোটে?

মোদি এবং অমিত শাহকে আপনার যতই অপছন্দ হোক, এটা তো মানবেন, বয়সে আপনার চেয়ে অনেক বড় হলেও ওঁরা ২৪x৭ রাজনীতিটাই করেন? আপনার মতো ‘অ‌্যামেচার’ মনোভাব নিয়ে ওঁরা রাজনীতি করেন না। এমনকী, তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও যেভাবে পরিশ্রম করছেন, যেভাবে পরিণতমনস্ক হয়ে উঠেছেন, আপনি জাতীয় স্তরে তা করতে কিন্তু ব‌্যর্থ। তাই তর্কটা শুধুমাত্র পারিবারিক উত্তরাধিকারী হওয়া নয়, মূল প্রশ্ন হল, আপনি যোগ‌্যতার প্রমাণ দিতে পারছেন কি না। মোদি জমানার ১০ বছরে মানুষের ক্ষোভ, হতাশা, অসন্তোষ বেড়েছে- কিন্তু আপনি এখনও ‘সিরিয়াস রাজনেতা’ হতে পারলেন না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement