shono
Advertisement

প্রতিহিংসার রাজনীতি?

‘বন্দি’ কেজরিওয়াল কি ‘মুক্ত’ কেজরিওয়ালের চেয়ে ভয়ংকর হবেন?
Posted: 09:18 PM Mar 27, 2024Updated: 09:18 PM Mar 27, 2024

কেজরিওয়াল দ্বিতীয় মায়াবতী হতে চাইলে তাঁর এই ভোগান্তি হত না। অজিত পাওয়ার হতে চাইলে ললাট লিখন অন্যরকম হত। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থেকেও যদি না-থাকার মতো আচরণ করতেন, নানা বাক্যবাণে জোটকে ক্রমাগত আঘাত করে যেতেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় না যেতেন, তাহলে এই দুর্ভোগ  তাঁকে পোহাতে হত না। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় 

Advertisement

‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’ (ইডি) কি অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে জেরা করতে চেয়েছিল? না কি গ্রেপ্তার? উত্তরটা হল গ্রেপ্তার। সেজন্যই বারবার সমন পাঠাচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদের কোনও ইচ্ছাই তাদের ছিল না। ঠিকই করা ছিল ইডি দফতরে গেলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। জেরা করাটা মুখ্য হলে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি গিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারত। সেই সময়টুকু চেয়ে নিতে পারত। কেজরিওয়াল কি বারবার সমন উপেক্ষা করে ঠিক করেছেন? সহজ উত্তর– না। তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। তাহলে কেন তিনি বারবার সমন অগ্রাহ্য করলেন? এর উত্তরও কঠিন নয়। তিনি জানেন, তাঁকে নিয়ে বিজেপি রাজনীতি করছে। সেই রাজনীতির মোকাবিলা তিনি রাজনীতি দিয়েই করতে চেয়েছেন। সমন অগ্রাহ্য করছিলেন নিজের ঘর কিছুটা গুছিয়ে নিতে।

এই অবস্থায় ইডি, আদালতের অনুমতি নিয়ে, তাঁকে হাজিরা দিতে বাধ্য করাতে পারত। তা তারা করেনি। কেজরিওয়াল আইনি রক্ষাকবচ চেয়েছিলেন। ইডি সেই সুযোগ না দিয়েই গ্রেপ্তার করেছে তাঁকে। কেজরিওয়ালের পিছনে বিজেপি যে হাত ধুয়ে নেমেছে, তা স্পষ্ট। কেন নেমেছে? আবগারি নীতির দুর্নীতি ফঁাসের জন্য? মোটেই না। নেমেছিল তিনি কংগ্রেসের হাত ছাড়তে চাইলেন না বলে। যত দিন টালবাহানা করেছেন, তত দিন বিজেপি তঁাকে ছেড়ে রেখেছিল। যেদিন ‘ইন্ডিয়া’ জোটে শামিল হয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় রাজি হলেন, সেদিনই বিজেপি ঠিক করে ফেলে তঁার ভাগ্য। কেজরিওয়াল নিজেও তা বেশ বুঝতে পারছিলেন। গ্রেফতারির আশঙ্কার কথা তাই তিনি অনেক দিন আগে থেকেই বলতে শুরু করেন।

[আরও পড়ুন: ‘এআই’ পারবে না রুশদি হতে]

‘বন্দি’ কেজরিওয়াল কি ‘মুক্ত’ কেজরিওয়ালের চেয়ে ভয়ংকর হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর বিজেপির কাছে নেই। কেউ মনে করেন, ‘আম আদমি পার্টি’ মানেই কেজরিওয়াল। ‘ওয়ান ম্যান শো’। তঁাকে বন্দি করা মানে দল চুরমার হয়ে যাওয়া। এতে দিল্লি, পাঞ্জাব ও গোয়ায় বিজেপির সুবিধা। তাছাড়া বোঝানো যাবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিচিত হওয়া নেতা নিজে আদতে কতখানি দুর্নীতিগ্রস্ত। আবার কারও ধারণা, এতে আপ-এর পালে সহানুভূতির হাওয়া বইবে। বিশেষ করে
নিম্ন ও মধ্যবিত্তর কাছে, যাদের জন্য কেজরিওয়াল অনেক কিছুই করেছেন। আপ আপাতত থিতু হয়ে পালে হাওয়া তুলতে চাইছে। নানা কর্মসূচি নিচ্ছে। তারাও বুঝেছে, আদালত থেকে সুরাহা পেলে একরকম, নইলে অন্যভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে। বিজেপি সহজে ছাড়বে না।
কেজরিওয়ালের গ্রেফতার অবশ্য ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে কিছুটা চাগিয়েছে। যদিও বিজেপির সর্বাত্মক আগ্রাসনের মোকাবিলায় তা কতটা পোক্ত, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

আবগারি নীতিতে কেজরিওয়ালের দলের কোষাগারে ১০০ কোটি টাকা এসেছে কি না, তা প্রমাণসাপেক্ষ। দেশে এই মুহূর্তে এমন একটিও দল নেই, যারা এই ধরনের কাজের মাধ্যমে টাকা জোগাড় করে না। দল চালাতে গেলে টাকা লাগে। ভোট করতে গেলে টাকা লাগে। যারা যেখানে ক্ষমতায় থাকে, তারা এভাবেই টাকা রোজগার করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, যঁার বয়ানের ভিত্তিতে কেজরিওয়ালকে ধরা হল, তিনি বিশ্বাসযোগ্য কি না। হায়দরাবাদের ‘অরবিন্দ ফার্মা’-র কর্তা
পি. শরৎচন্দ্র রেড্ডিকে ধরার পর তাঁর প্রথম বয়ান ছিল, কেজরিওয়ালকে তিনি চিনতেন না। ঘুষও দেননি। সেই ব্যক্তিই চাপে পড়ে রাজসাক্ষী হলেন, কোমরে ব্যথার দরুন দিল্লি হাই কোর্ট থেকে জামিন পেলেন, ইডি জামিনের বিরোধিতা করল না এবং তিনি জানিয়ে দিলেন ১০০ কোটি ঘুষ দিয়েছেন কেজরিওয়ালকে। অবাক হওয়ার মতো নয় কি?

অবাক হওয়ার মতো ঘটনা আরও আছে। সুপ্রিম কোর্টের দৌলতে চাপ, ভয় ও তোলাবাজির স্বরূপ এখন উন্মুক্ত। কিন্তু বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের চরিত্র লছমনঝোলার গঙ্গার মতো স্বচ্ছ। বিরোধীরা ভণিতা না করেই বলছে, নির্বাচনী বন্ড-ই এ দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। ‘দ্য বিগেস্ট স্ক্যাম’। এর কোনও জুতসই জবাব প্রধানমন্ত্রী এখনও দেননি। বিজেপি শুধু বলেছে, নির্বাচনে কালো টাকার ঝনঝনানি বন্ধ করতেই এই ব্যবস্থা। সুপ্রিম কোর্টে সেই যুক্তি আমল পায়নি। প্রধান বিচারপতি
ডি. ওয়াই. চন্দ্রচূড় নিজেই ‘কুইড প্রো কো’ বা পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কারা বন্ড কেনার পর কী সুবিধে পেয়েছে, কারা সুবিধে পাওয়ার পর বন্ড কিনেছে, কারা কীভাবে ইডি-সিবিআইকে চুপ করিয়েছে, এসব আজ নিত্য প্রকাশিত হচ্ছে। কই, সরকারকে তো ক্ষুব্ধ হতে দেখা যাচ্ছে না! সরাসরি ‘তোলাবাজ’, ‘ধান্দাবাজ’ বা ‘মাফিয়াগিরি’-র অভিযোগ আনা সত্ত্বেও কই কারও বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকতে তো দেখা যাচ্ছে না!

পান থেকে চুন খসতে না খসতেই যারা রে রে করে ওঠে, নির্বাচনী বন্ড নিয়ে তারা কেন এত নীরব? সরকার ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে থাকলে সুপ্রিম কোর্টকেই তো প্রস্তাব দিতে পারে সর্বোচ্চ আদালতের তত্ত্বাবধান ও তদারকিতে বন্ড সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্ত করার? সরকার সেই প্রস্তাব দেবে না। সুপ্রিম কোর্টও স্বতঃপ্রণোদিত হয়নি। অথচ এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তা জড়িত। জড়িয়ে রয়েছে দেশের গণতন্ত্রের টেকা না-টেকার প্রশ্নও। কেজরিওয়াল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তঁাকে গ্রেফতার করার প্রয়োজন কোথায় ছিল?  

কাউকে গ্রেফতারের প্রয়োজন হয় দু’টি কারণে। এক, দেশ ছেড়ে পালানোর সম্ভাবনা দেখা দিলে। দুই, তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করার শঙ্কা থাকলে। কেজরিওয়াল কি পালাবেন? প্রমাণ নষ্ট করবেন? আবগারি কেলেঙ্কারির তদন্ত চলছে আড়াই বছর ধরে। কেজরিওয়াল একবারের জন্যও লাপাতা হওয়ার চেষ্টা করেননি। প্রমাণ নষ্ট করার থাকলে এত দিনে করে দিতেন কিংবা দিয়েছেন। আপ বরং দাবি করছে, আড়াই বছরে তাদের কারও কাছ থেকে ঘুষের একটি টাকাও ইডি উদ্ধার করতে পারেনি। তাহলে? উত্তরটা লেখার শুরুতেই দেওয়া আছে। কেজরিওয়াল দ্বিতীয় মায়াবতী হতে চাইলে তাঁর এই ভোগান্তি হত না। অজিত পাওয়ার হতে চাইলে ললাট লিখন অন্যরকম হত। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থেকেও যদি না-থাকার মতো আচরণ করতেন, নানা বাক্যবাণে জোটকে ক্রমাগত আঘাত করে যেতেন, কংগ্রেসের
সঙ্গে আসন সমঝোতায় না যেতেন, তাহলে এই দুর্ভোগ তাঁকে পোহাতে হত না। 

কেজরিওয়ালের সমর্থনে রাহুল গান্ধী ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে হিন্দিতে যা লিখেছেন, তার বাংলা তরজমা, ‘এক ভীত-সন্ত্রস্ত-স্বৈরাচারী– এক মৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।’ সেই পোস্টে ‘কোম্পানিদের কাছ থেকে হপ্তা উসুল’ ও বিরোধী দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার অভিযোগ এনে রাহুল বলেছেন, এসবও ওই ‘অসুর শক্তি’-কে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তাই নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেপ্তার সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।

রাহুল কারও নাম করেননি। কিন্তু বুঝতে অসুবিধা নেই কার উদ্দেশে ওই কথা। আশ্চর্যের, তেমন কোনও প্রতিবাদও দেখা যাচ্ছে না। রাহুলের হয়রানি বাড়াতে রাজ্যে রাজ্যে মামলা ঠোকার সংস্কৃতি বিজেপিই চালু করেছে। অথচ বন্ড নিয়ে তাদের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির সঙ্গেও নির্বাচনী বন্ড ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আবগারি মামলার রাজসাক্ষী পি. শরৎচন্দ্র রেড্ডির সংস্থা বন্ড মারফত বিজেপিকে দফায় দফায় মোট সাড়ে ৫৯ কোটি টাকা দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যেসব তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে বন্ড মারফত চাদার কতটা তোলাবাজি, কতটা ব্ল্যাকমেল, কোনগুলো ‘কুইড প্রো কো’ অর্থাৎ, ‘এটা দাও, ওটা নাও’, সেই আগ্রহের নিরসন দেশের স্বার্থে অবশ্যই হওয়া উচিত। সর্বোচ্চ আদালত কি বন্ড উপাখ্যানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের রহস্য উন্মোচনে আগ্রহী হবে?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup ছাঁদনাতলা toolbarvideo শোনো toolbarshorts রোববার