বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচন কি হবে রংহীন? না কি তাতে ঝিকিয়ে উঠবে রাজনৈতিক উত্তাপের তরঙ্গ? নির্ভর করছে বিরোধীদের ভূমিকা ও সংঘশক্তির উপর। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজ্যসভা নির্বাচনের তাপ-উত্তাপ থিতিয়ে গিয়েছে। বাড়ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে তৎপরতা। রাজ্যসভার নির্বাচন সাম্প্রতিক ভারতীয় রাজনীতির ক্যানভাসে যে-ছবি নতুন করে ফুটিয়ে তুলল, তা দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী শিবিরের যাবতীয় নড়াচড়া বরাবরের মতো এবারও হয়তো পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে। প্রার্থী হিসাবে বিজেপি শেষ পর্যন্ত যাঁকে পছন্দ করবে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে তিনিই হবেন পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। যদি না, অস্বাভাবিক কিছু ঘটে!
‘অস্বাভাবিক’ আদৌ কিছু ঘটার সম্ভাবনা কতটা, আজ বুধবার বিকেল-সন্ধে নাগাদ তা বোঝা যাবে। সবার নজর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর- নিষ্পলক নিবদ্ধ। বিরোধীদের একঘাটে আনা ও জল খাওয়ানো যে চায়ের কাপ ও ঠোঁটের দুস্তর ব্যবধানের সমতুল্য, এর আগে বহুবার তা প্রকট হয়েছে। এবারেও কি তারই পুনরাবৃত্তি?মমতার বুধবাসরীয় প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতার উপর ঝুলে থাকছে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিজেপির সিদ্ধান্ত।
‘পণ্ডশ্রম’ শব্দটির প্রারম্ভিক প্রয়োগ ভেবেচিন্তেই করা। কেননা, নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছাই যে দল ও সরকারের শেষ কথা, গত আট বছরে সেই সত্যের নড়চড় হয়নি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হওয়া কঠিন। তাছাড়া, গত আট বছরে বিরোধী নেতারা এমন কিছু করে উঠতে পারেননি, যাতে সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষ আশায় বুক বাঁধতে পারে। আশাতেই তো বাঁচা।তা সে যতই কুহকিনী হোক।
[আরও পড়ুন: কাশ্মীরি পণ্ডিতরা কি এখন বিজেপির ‘শাঁখের করাত’ শাঁখের করাত?]
রাষ্ট্রপতি পদে লড়াই ক্ষুরধার হতে পারে দুটি ‘অসম্ভব’ সম্ভবপর হলে। প্রথমত, বিরোধী শক্তি সবাই যদি একজোট হয় ও প্রার্থী হিসাবে ‘অজাতশত্রু’ কাউকে যদি বাছা যায়। মুশকিল হল, এই আট বছরে রাজনীতির কোনও অধ্যায়েই বিরোধীরা জোটবদ্ধতার প্রমাণ রাখতে পারেনি। সদ্যসমাপ্ত রাজ্যসভার ভোট তার আরও একটা ‘ইন্ডিকেটর’। আবার, এ. পি. জে. আবদুল কালামের পর রাষ্ট্রপতি পদে সেই অর্থে ‘অজাতশত্রু’ ও সর্বগ্রাহ্য কারও খোঁজও মেলেনি।
অন্যদের কথা অনুচ্চারিত থাক। তর্কাতীতভাবে দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি কংগ্রেস নিয়েই কথা হোক। কী দেখা গেল রাজ্যসভার ভোটে? কর্নাটক, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় তারা নিজের ঘর অটুট রাখতে পারল না। অন্য বিরোধীদের মন জয়েও ব্যর্থ। জেডি(এস) নেতা এইচ. ডি. কুমারস্বামীর সঙ্গে মিটমাটের রাস্তায় গেলে বিজেপি ওই রাজ্যে একটি বাড়তি আসন পায় না। কংগ্রেসি জেদ জেডি(এস)-এর ঘর ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু বিজেপির পথের কঁাটা হতে পারেনি। মহারাষ্ট্রে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ওয়াধেরার পছন্দের প্রার্থী ইমরান জিতেছেন। কিন্তু বিরোধী জোটের শক্তিক্ষয়ে বাড়তি যে-উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল, জোট সরকারের তিন শরিক তা জোটাতে ব্যর্থ। অথচ দেখা গেল, বিজেপির তৎপরতা। মোদির আমলে এই দলটির সার্বিক আচরণ ও চলাফেরায় যেমন বদল ঘটেছে, তেমনই বদলে গিয়েছে দলের দর্শন। যত অকিঞ্চিৎকর ও গুরুত্বহীন হোক, এই দলটা কোনও নির্বাচনেই হারার জন্য নামে না। পঞ্চায়েত-পুরসভা থেকে শুরু করে বিধানসভা-লোকসভা-রাজ্যসভায় বারবার সে প্রমাণ তারা রাখছে। এবারও রাখল কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায়।
হরিয়ানায় কংগ্রেসের পা কেটেছে পচা শামুকে। নিজেদের ঘর তারা গোছাতে পারেনি। এই ভোটকে কেন্দ্র করে চৌটালা পরিবার আবার এককাট্টা হয়ে গিয়েছে। হরিয়ানার রাজনীতিতে জাট বনাম অন্যদের লড়াই চিরকালের। রাজ্য রাজনীতি প্রধানত জাট-সর্বস্ব। কিন্তু তাই বলে অ-জাট শক্তি হেলাফেলার নয়। মনোহরলাল খাট্টারকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি তার প্রমাণ রেখেছে। কংগ্রেস যতদিন এই দুই প্রধান জাতের মধ্যে ভারসাম্যের রাজনীতি ঠিকঠাক করেছে, ততদিন ক্ষমতায় থেকেছে। এবার জাট নেতা ভূপিন্দর সিং হুডার হাতে সব ক্ষমতা তুলে দিয়ে রাহুল ভেবেছিলেন বিশ্বস্ত অজয় মাকেনকে তরানো যাবে। কিন্তু বাদ সাধলেন ভজনলাল পুত্র কুলদীপ সিং বিষ্ণোই ও বংশীলালের পুত্রবধূ কিরণ চৌধুরি। কংগ্রেসের অন্দরমহলের ফিসফাস, একদা গান্ধী পরিবারের অনুগামী এই দুই নেতার সঙ্গে রাহুল গান্ধী শেষবেলায় একবার কথা বললে এই হাল হত না। অজয় মাকেন হেসে-খেলে রাজ্যসভায় যেতে পারতেন।
রাহুলের এই ‘ছেড়ে-দেওয়া, তেড়ে-ধরা’ মানসিকতার ছিটোফোঁটাও বিজেপির কোনও স্তরে দেখা যাবে না। দলের প্রতিটি স্তরে শীর্ষনেতাদের উপর নজর ও দখল পুরনো দিনের কমিউনিস্ট পার্টির অনুশাসনের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিজেপিতে আজ বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, নেতৃত্বের বিরুদ্ধচারিতা, বিবৃতি-মন্তব্যের ফুলঝুরি অদৃশ্য। কংগ্রেসে সর্বত্র দৃশ্যমান।
বিজেপির প্রবল চাপ সহ্য করে এখনও যে-দুই রাজ্যে কংগ্রেস গ্রাহ্য, তার একটি রাজস্থান, অন্যটি ছত্তিশগড়। রাজস্থানে তারা তিনটি আসনই জিতেছে। এই কৃতিত্বের সিংহভাগ মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের প্রাপ্য। পরিষদীয় দলকে পুরোপুরি ধরে রেখে তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজস্থানে কংগ্রেসের অস্তিত্ব রক্ষায় তাঁর চেয়ে দক্ষ আর কেউ নেই। রাজ্যসভা ভোটের এই সাফল্য মুখ্যমন্ত্রী গেহলটের অবস্থান অবশ্যই দৃঢ় করবে। কিন্তু তার অর্থ যদি হয়, এইভাবে আগামী দিনেও তিনি শচীন পাইলটকে একঘরে করে রাখবেন, সেটা হবে মারাত্মক ভুল। মনে রাখতে হবে, রাজ্যসভা নির্বাচনে শচীন তাঁর অনুগামীদের বিপথগামী করে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘শিক্ষা’ দিতে চাননি। রাজ্য কংগ্রেসের প্রবীণ ও নবীন এই দুই সেরা মুখকে খুশি করে ২০২৩-এ রাজস্থান ধরে রাখতে হলে ১০ জনপথকে বাড়তি কসরত করতেই হবে।
ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল এখনও কংগ্রেসের একমাত্র ভরসা। এই দুই রাজ্যের বাইরে কংগ্রেসকে বিজেপি কিছুটা কলকে দেয় হরিয়ানায়, হুডার দরুন। আর কর্নাটকে, সিদ্দারামাইয়া ও ডি.কে. শিবকুমারের দৌলতে। মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস ফতুর হয়েছে নিজের দোষে। অন্তর্কলহে। পাঞ্জাবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তিও এখন নেই। উত্তরাখণ্ড ও হিমাচল প্রদেশের হালও তথৈবচ। গুজরাত প্রায় শূন্যকুম্ভ।
রাজ্যসভার ভোট কংগ্রেসকে যতটা হতোদ্যম করেছে, তার চেয়ে বেশি চিন্তায় ফেলেছে ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলা। রাষ্ট্রপতির ভোটের সলতে পাকানোর মোক্ষম সময়টায় কংগ্রেস ঘুরপাক খাচ্ছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) চত্বরে! সোমবার এগারো ঘণ্টা জেরার পর রাহুলকে ফের মঙ্গলবার হাজির হতে বলা গ্রেফতারির গৌরচন্দ্রিকা কি না, এমন একটা সন্দেহ কংগ্রেসের একাংশে উঁকি মারছে। পারস্পরিক শত্রুতার তীব্রতা ও বিশ্বাসহীনতা এই আশঙ্কার কারণ। এই মামলাতেই সোনিয়া ও রাহুলকে জামিন নিতে হয়েছে। বিজেপিতে ভাবনাচিন্তা করার যথেষ্ট দক্ষ মগজের যে অভাব নেই, এই ঘটনা তার প্রমাণ। বিরোধীদের তাঁবে রাখতে ‘সাম-দান-দণ্ড-ভেদ’ নীতির এমন সুচারু ও সার্থক রূপায়ণ বিজেপি অতীতে দেখাতে পারেনি। আট বছর যাবৎ এই নীতির প্রয়োগ তারা শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
রাষ্ট্রপতির ভোটে অঙ্কের হিসাবে সম্মিলিত বিরোধীদের চেয়ে বিজেপি ও তার সহযোগীরা ২.২ শতাংশ ভোটে পিছিয়ে। কিন্তু তবুও তারা অনেক কদম এগিয়ে দৌড় শেষ করার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। গত আট বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব ভোটে এমনই হয়েছে। সংসদে একটা বিলও তাই আটকানো যায়নি। এবারেও যাতে অন্যথা না হয়, সেই দায়িত্ব বর্তেছে রাজনাথ সিং ও জে. পি. নাড্ডার উপর। পাল্টা দায়িত্ব নিচ্ছিলেন সোনিয়া স্বয়ং। মোক্ষম সময়ে কোভিড তঁাকে ধরাশায়ী করেছে। উপরি সর্বনাশ ইডি-র রক্তচক্ষু। বিরোধী শিবিরের নজর তাই তৃণমূল নেত্রীর রাজনীতিতে নিবদ্ধ।
বিরোধী শিবিরকে নেতৃত্ব দানের প্রশ্নে কংগ্রেস ও তৃণমূল দুই মেরুর বাসিন্দা। সর্বগ্রাহ্য প্রার্থী হয়ে প্রবীণ মারাঠা শরদ পাওয়ার সবাইকে কাছে টানতে পারতেন। কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের উপান্তে এসে ৮১ বছরের অশক্ত মারাঠা ‘স্ট্রং ম্যান’ হারার জন্য ময়দানে নামতে চাইছেন না। একমাত্র তিনি যদি সাহসী হন, লড়াইটা তাহলে সমানে-সমানে ও সেয়ানে-সেয়ানে হলেও হতে পারে। অন্যথায় রংহীন, রূপহীন, জৌলুসহীন, ম্যাড়মেড়ে হয়ে থাকবে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের নির্বাচন।