shono
Advertisement

Breaking News

বিজেপির সঙ্গে লড়তে হলে দরকারে নতুন দল গড়তে হবে রাহুল গান্ধীকে

ঝুঁকি নিয়ে বর্তমান ‘ইন্দিরা-রাজীব-সোনিয়া’-র কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রাহুলকে।
Posted: 01:44 PM Jun 19, 2021Updated: 03:46 PM Jun 20, 2021

ইন্দিরা গান্ধী নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন সর্বসময়ের কৌশলী রাজনীতির অনুশীলনকারী হিসাবে। রাহুল গান্ধীকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে: তিনি কি ক্ষমতার নির্মম সাধনায় মুখ্য ভূমিকা নিতে ইচ্ছুক, না কি অ্যাকাডেমিক মহাবিশ্বে নতুন নতুন ভাবনায় নিজেকে সমর্পণ করেই ক্ষান্ত থাকতে আগ্রহী? স্থিতিশীল আরামদায়ক অবস্থানে থাকা তাঁর বা কংগ্রেসের পক্ষে আর একবিন্দুও বিকল্প নয়। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই 

Advertisement

 

রাহুল গান্ধীর উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর। তাঁর বিরোধী দল বিজেপি তাঁকে ‘পাপ্পু’ বলে দাগিয়ে প্রায় অযোগ্য নেতা হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চাইছে যেমন, কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও এই প্রবণতা কিছু কম নয়। কংগ্রেসে তাঁর অনেক সহকর্মীই আড়ালে আবডালে তাঁর এই প্রাচীন দলের গভীরতর সংকটের জন্য দায়ী করেন। প্রতিবার, তা সে কংগ্রেসের কোনও নেতা দল ত্যাগ করুন বা কোনও নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয় হোক- রাহুল গান্ধীই হয়ে ওঠেন সেসবের প্রধান কারণ, প্রধান অপরাধী। যা হোক, অতশত না ভেবে বরং আসল প্রশ্নটা করে ফেলা যাক: রাহুল গান্ধী বিনা কংগ্রেস কি নরেন্দ্র মোদির বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার জন্য কিঞ্চিৎ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকত?

[আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গে কি ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করবে কেন্দ্রীয় সরকার?]

২০১৪ এবং ২০১৯ সালে, দু’টি সাধারণ নির্বাচনে বিশাল পতনের পরে, এর সুস্পষ্ট উত্তর হবে, রাহুল-নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস মোদি-নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার পক্ষে অক্ষম। কোনও সংশয় নেই, গান্ধী বংশের কুলতিলক-ই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার করে তুলেছে। রাজবংশের পঞ্চম প্রজন্ম হিসাবে তাঁর উপস্থিতিই মোদিকে সুযোগ করে দিয়েছে ‘নামদার বনাম কামদার’ আখ্যানকে বিরোধিতার প্রধান আখ্যান হিসাবে তুলে ধরার। মোদি সুচারুভাবে জনপ্রিয় এক যুদ্ধের দামামা বাজিয়েছেন: আপনারা কি কোনও সুবিধাপ্রাপ্ত অপরীক্ষিত পারিবারিক উত্তরাধিকারী বেছে নেবেন, না কি এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে বেছে নেবেন একজন ‘চাওয়ালা’-কে, যিনি আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হতে চলেছেন? যে ‘নতুন’ ভারত গড়ে উঠবে যোগ্যতার আদর্শে, সেখানে অভিজাত বংশের প্রশ্রয়ী অস্তিত্বের সঙ্গে তুলনা করলে সু-বিপণিত মোদিযাত্রা অনেক বেশি জোরাল। এছাড়া রয়েছে রাহুল গান্ধীকে ‘পাপ্পু’ বলে বিজেপি-র একটানা বিষাক্ত প্রচার, যা মিথ্যা, অর্ধসত্য ও স্বার্থ চরিতার্থ করার আখ্যানের মিশ্রণ, তা লাখো লাখো ভোটারকে প্রভাবিত করছে স্পষ্টতই। এমনকী, যখন তিনি বৈধ এবং অনুসন্ধানী প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, যেমনটা তিনি গত বছরের গোটা কোভিড সময়কাল ধরে করেছিলেন, তখনও অনুপযুক্ত নেতা হিসাবেই তাঁর ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনীতিতে এমন ভাবমূর্তির ক্ষত সারাই করা সহজ কাজ নয়, বিশেষত যখন তাঁবেদার মিডিয়া ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই জোট বেঁধে খেলতে পেরে স্বস্তি পায়।

এমনও নয় যে, ১৭ বছর আগে, রাহুল গান্ধী যখন প্রথম রাজনৈতিক দৃশ্যে প্রবেশ করেন, তার আগে কংগ্রেস দর্শনীয়ভাবে ভাল কাজ করছিল। সর্বোপরি, কংগ্রেস সেই রাজনৈতিক দল, যা ১৯৮৪ সাল থেকে কেন্দ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। মায়ের হত্যার পরে রাজীব গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী রূপে দায়িত্বপ্রাপ্ত করাটা নির্বাচনী জয় হিসাবে দেখা হলেও আক্ষরিক অর্থে তাঁর হাতে এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ এবং হিন্দি বলয় জুড়ে পতন ১৯৮০-র দশক-শেষের ঘটনা, যা ভারতীয় রাজনীতির পরিবর্তিত দৃষ্টান্তের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। যেখানে কংগ্রেসের ফাঁপা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি দুর্বল প্রতিশ্রুতি মন্দির এবং মণ্ডল বাহিনীর ক্রমবর্ধমান শক্তি দ্বারা খোলসা হয়ে পড়ছিল ক্রমশ।

ইন্দিরা গান্ধীর বছরগুলিতে একটি স্বেচ্ছাচারী ‘হাই কমান্ড’ সংস্কৃতির জন্ম হচ্ছিল, যার ফলে কংগ্রেসের আকাশে একাধিক প্রজন্মের আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিক করা হয়েছিল। দেবরাজ উরস থেকে শরদ পাওয়ার, সেখান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত- যে কোনও রাজ্য নেতা যিনি ‘হাই কমান্ড’-কে চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখিয়েছিলেন, হয় তাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছিল দল থেকে, নয়তো তাঁদের নিজস্ব আঞ্চলিক দল গঠনে বাধা দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি অবিশ্বাস্য নয় যে, কংগ্রেসের প্রায় প্রাক্তন আটজন নেতা বর্তমানে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন। একমাত্র নেহরু-গান্ধী পরিবারই কংগ্রেস দলটিকে ধরে রাখতে পারবে- এই অবিশ্বাস্য বিশ্বাস দলটির মূল নেতৃত্বের কাঠামোকে দুর্বল এবং দেশের বিশাল অংশে দলীয় সংগঠনটির প্রত্যাবর্তন করতে পারার সম্ভাবনা ক্ষীণ করে দিয়েছিল।

যে সাংগঠনিক পতন কংগ্রেসকে কিনারে আছড়ে ফেলেছে, তার জন্য রাহুল গান্ধীকে (Rahul Gandhi) একমাত্র দোষী সাব্যস্ত করা যায় না, এবং তা এই কারণে যে, রাজনীতিতে তাঁর আগমনের সম্ভাবনা ছিলই। তাঁকে যে কারণে দায়ী করা যেতে পারে, তা হল তাঁর এটা বুঝতে না পারা যে, কংগ্রেসের বর্তমান আকার মতাদর্শগতভাবে সংঘ পরিবারের বিরোধী আদর্শ নয়। বা, মোদি-নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম শক্তিশালী নির্বাচনী মেশিন নয় কংগ্রেস। কংগ্রেস ক্ষমতার একটি বৃহৎ এবং আলগা ‘বড় তাঁবু’, যার ক্ষুধার্ত নেতাকর্মীরা ভিআইপি সুবিধায় অভ্যস্ত, তা সে লালবাতি গাড়িই হোক কি রাজ্যসভার আসন, কিংবা অভিজাত বাংলো হোক। এটি রাতারাতি রূপান্তরিত হবে না কোনও বিপ্লবী দলে, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনকারীর সংখ্যাই বেশি। বা, রূপান্তরিত হবে না সেই দলে, যেখানে সমমনা বামপন্থী সহযাত্রীরা রয়েছেন। যাঁরা সম্প্রতি কংগ্রেস দলটি ছেড়েছেন, তাঁদের মধ্যে রাহুল গান্ধীর এককালীন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও আছেন। এই ছেড়ে যাওয়া, রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অনিবার্য বাস্তবকে প্রতিফলিত করে- একটা বড় সময়ের জন্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তাঁরা অসন্তুষ্ট। যদি রাহুল গান্ধীকে ভোট-চুম্বক বা ক্ষুরধার নির্বাচনী কৌশলবিদ হিসাবে দেখা না-যায়, তাহলে কংগ্রেসের একটি বড় অংশ তাঁকে সম্পূর্ণভাবে কখনওই গ্রহণ করবে না– এটা প্রায় শিরোধার্য বলা যায়।

ঠিক সেই কারণেই রাহুল গান্ধী যদি আন্তরিকভাবে কংগ্রেসকে ‘গণতান্ত্রিক’ করতে চান, কংগ্রেসের সংশোধন চান, তাহলে তাঁকে এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, এই কাজটি তিনি কংগ্রেসের নেতৃত্বে থেকে করতে পারবেন না। সত্যিটা হল, আপনি বর্তমান কংগ্রেসের মধ্যে থাকবেন, বা কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী রাজনীতিও করবেন এবং একইসঙ্গে একটি ‘নৈতিক’ বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করবেন- এমনটা কোনওভাবেই হবে না, হওয়াটা অসম্ভব। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এবং পুঁজি-ভিত্তিক ক্ষমতার সমকালীন রাজনীতিতে বৌদ্ধিক সংযুক্তি বা আত্মা আলোড়নকারী মহাত্মা হওয়ার স্থান সামান্য। উদাহরণস্বরূপ, আপনি নিজেকে কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ বলে দাবি করে ক্ষমতালোভে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেন না, বা বাংলায় ইসলামিক পিরজাদার সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে পারেন না। খোলাখুলিভাবে বললে, কংগ্রেস (Congress) নানা দোষে দুষ্ট। তাই এই দলটিকে প্রগতিশীল মানদণ্ডের দৃঢ় প্রতিরক্ষাকারী হিসাবে আর দেখা যাচ্ছে না।

রাহুল গান্ধী যদি সত্যি সত্যিই বিজেপির বিরুদ্ধে একটি মতাদর্শগত লড়াইয়ে ইচ্ছুক থাকেন, তাহলে তিনি ভুল সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আর, তিনি যদি মূল্যবোধ-ভিত্তিক রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন, তবে অবশ্যই তাঁকে তাঁর প্রত্যয়ের প্রতি সাহসী হতে হবে, ঝুঁকি নিতে হবে। ঝুঁকি নিয়ে বর্তমান ‘ইন্দিরা-রাজীব-সোনিয়া’-র কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের দল গঠন করতে হবে, যেখানে সঙ্গী হবেন তাঁর স্বপ্নে স্বপ্নিল কমরেডরা। তাঁর যদি উন্নত রাজনীতি সম্পর্কিত কোনও দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তাহলে তাঁকে সেই দৃষ্টির প্রতি মানুষকে আন্দোলিত করতে হবে। টুইটারে মোদি সরকারকে আক্রমণ করে শুধু হবে না, বা মার্কিন শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আন্তর্জালে কথোপকথনের মাধ্যমেও হবে না। তাঁকে রাস্তায় নামতে হবে, দেশের জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে অধিকারের সংস্কৃতির জায়গায় প্রতিস্থাপন করতে হবে সমানাধিকারের রাজনীতিকে। একমাত্র এই উপায়ে তিনি রাজবংশের ফাঁদ থেকে উদ্ভূত হয়ে বিদ্যমান শাসক ব্যবস্থার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।

চাইলে তিনি তাঁর ঠাকুরমার রাজনৈতিক দলিল থেকে খানিক অনুসরণ করতে পারেন। তাঁকে যেভাবে ‘পাপ্পু’ বলা হয়, ঠিক সেভাবেই ইন্দিরা গান্ধীকেও ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ বলে বিদ্রুপ করা হত। তা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন ১৯৬৯ সালের মধ্যে কংগ্রেসের পুরনো ধারণা-কায়দা ভেঙে অত্যাশ্চর্য সাফল্যের সঙ্গে তাঁর নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে। ইন্দিরা গান্ধী নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন সর্বসময়ের কৌশলী রাজনীতির অনুশীলনকারী হিসাবে। রাহুল গান্ধীকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে: তিনি কি ক্ষমতার নির্মম সাধনায় মুখ্য ভূমিকা নিতে ইচ্ছুক, না কি অ্যাকাডেমিক মহাবিশ্বে নতুন নতুন ভাবনায় নিজেকে সমর্পণ করেই ক্ষান্ত থাকতে আগ্রহী? স্থিতিশীল আরামদায়ক অবস্থানে থাকা তাঁর বা কংগ্রেসের পক্ষে আর একবিন্দুও বিকল্প নয়।

পুনশ্চ সম্প্রতি যখন মুকুল রায় ফিরে এলেন তৃণমূল কংগ্রেসে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এমন একজনকে কেন তিনি ফিরিয়ে আনলেন, যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? তিনি তখন জোরের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, রাজনীতিতে কখনও দরজা বন্ধ হয় না। এটি একটি নিরন্তর ও শর্তহীন ক্ষমতার লড়াইয়ের শিক্ষা, যে লড়াইয়ে কংগ্রেস একদা মহীয়ান ছিল। সেই শিক্ষা আবার নতুন করে নিতে হবে কংগ্রেসকে। নয়তো আদি ভারতজোড়া রাজনৈতিক ‘ছাতা’ দলটি, অচিরেই স্থানীয় দলের ছত্রাকে পরিণত হবে।

[আরও পড়ুন: কংগ্রেস সিস্টেমের কী হল?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement