নন্দিতা রায়, রাজসমন্দ: আফরাজুলকে মনে আছে! রাজস্থানের সেই বাঙালি শ্রমিক, যাঁকে খুন করে জ্বালিয়ে দেওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই সূত্রে অনেক রাজনৈতিক বিতণ্ডার সাক্ষী হয়েছিল গোটা দেশ। নৃশংসতায় শিউরে উঠতে হয়েছিল। যদিও একবছর পার হতে চলল, তবু সেদিনের বীভৎসতা এখন মনে করলে আঁতকে ওঠে রাজসমন্দের মানুষ।
[সীমান্তবর্তী এলাকায় বাড়ছে মুসলিম জনসংখ্যা, চিন্তায় বিএসএফ]
উদয়পুর থেকে ৬০ কিমি দূরে জেলা শহর রাজসমন্দ। চওড়া চার লেনের রাস্তা পার করে শহরে ঢোকার বড় রাস্তা শ’ফিট রোড। সেখানেই বজরং চৌরাহাতেই মুদির দোকান কিষেন গুজরের। সামনে কয়েকজন কমবয়সি যুবক দেখে এগিয়ে সেই ঘটনার কথা বলে জায়গাটা কোথায় জানতে চাইলাম। উত্তর শুনে হতবাক। এই তো পাশের গলি। দিবারাত্র জনবহুল এমন জায়গাতে কীভাবে অমন ঘটনা ঘটল অথচ কেউ দেখতে পেল না, প্রশ্ন করলাম। কিষেণ কী একটু ভেবে বলল, “গলির ভিতরের দিকে অনেক ফাঁকা জায়গা আছে। সেদিকে লোকজন বিশেষ যায় না।” গলির শুরুতেই বেশ বড় বড় বাংলো টাইপের বাড়ি। খানিকটা এগিয়ে গেলে সত্যিই ফাঁকা ফাঁকা বনবাদাড়। গলির মুখ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই স্থানীয় বিধায়ক, রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ও প্রযুক্তিমন্ত্রী কিরণ মাহেশ্বরীর বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি। সঙ্গে বিজেপির দপ্তরও। তার সামনে কিরণের হাসিমুখের বিশাল ছবির গলায় মালা ঝুলছে। আফরাজুলের ঘটনা নিয়ে প্রচুর জলঘোলা হয়েছিল সেসময়, কিন্তু ভোটের বাজারে তা কোনও ইস্যু নয় বলেই জানালেন মুকেশ খটিক। তবে, সেই ঘটনা যে তাঁদের মনে দাগ কেটে গিয়েছে, সেকথা মানেন। বললেন, “রাজসমন্দের নাম তো ওই ঘটনার জন্য বদনাম হয়ে গিয়েছে। সারা দেশের মানুষ মনে করছে এখানে খারাপ লোকেরা থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এখানে এরকম কিছু নেই। খুনি শম্ভুলালের জন্য আমাদের কোনও মায়াদয়া নেই। ওর তো ফাঁসি হওয়া দরকার। এখন যোধপুরের জেলে রয়েছে। আর ওর ভাইপো, যে ভিডিও তুলেছিল, এখন উদয়পুরের হোমে রয়েছে। উলটোদিকের যে গলিটা দেখছেন ওখানেই শম্ভুলালের বউ আর মেয়ে থাকে। ওদের কী দোষ বলুন। তবে, শম্ভুলাল যা করেছে তা ক্ষমা করা যায় না।
[সবরীমালাতেও লাভ হল না বিজেপির, কেরলের উপনির্বাচনে বড় জয় বামেদের]
ভিডিওতে ‘লাভ জিহাদ’ এসব অনেক বড় বড় কথা বলেছিল ও। কিন্তু সব ফালতু কথা। ওর সঙ্গে কিছু নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল আফরাজুলের, তাই খুন করে দিয়েছে।” শম্ভুলাল স্থানীয় হলেও রাজসমন্দের লোকেরা যে তাঁকে ঘৃণাই করে তা অনেকের কথাতেই বুঝলাম। বরং পেটের দায়ে কাজ করতে এসে বিদেশ বিভুঁইয়ে প্রাণ হারানো আফরাজুলের জন্য সহানুভূতি রয়েছে। আসার পথেই পার হয়ে এসেছি রাজসমন্দ জেলার প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান নাথদোয়ারা। শ্রীনাথজি, বিষ্ণু মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। সেই থেকেই জায়গার নাম। শ্রীনাথজি মন্দির গুজরাটিদের বিখ্যাত তীর্থস্থলও। প্রচুর পর্যটকের আগমন হয় সে কারণে। সেখানে এবার কংগ্রেসের প্রার্থী সি পি জোশী। দীর্ঘদিন রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন এই এআইসিসি নেতা। সেই সুবাদে অনেকের কাছেই পরিচিত নাম। দশ বছর পরে আবার নাথদোয়ারা থেকে প্রার্থী হয়েছেন। ২০০৮ সালে মাত্র এক ভোটে হেরেছিলেন। সেই সময় কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনায় মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে অশোক গেহলটের সঙ্গে তাঁর নামও উঠেছিল। কিন্তু এক ভোটের হার সব হিসাব পালটে দেয় সেবার। সেই হার যে তিনি আজও ভুলতে পারেননি, সেকথা কংগ্রেসের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যায়। তাই এবারে শোক ভুলতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন যোশী। তবে, যোশীর লড়াই যে সহজ নয় সেকথা মানছেন কংগ্রেস কর্মীরাই। স্থানীয় কংগ্রেস নেতা পঙ্কজ শর্মার কথায়, “দশ বছরে ভোটারদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের ভোটাররা তাঁকে চেনে না। পুরনো লোকজনেরা আছেন ঠিকই তবে তাঁরা কতটা সঙ্গে থাকবে, তা ভোটের সংখ্যায় বোঝা যাবে। তবে উনি প্রচুর কাজ করছেন, প্রচার চালাচ্ছেন। আর রাজ্যে এবার আমাদের হাওয়া রয়েছে। তাতে ভর করে বৈতরণী পার হয়ে যাবেন বলেই আশা করছি।”
[মাটির তলায় ‘মৃত্যুফাঁদ’ খুঁজে বের করবে ইসরোর ‘ছোটা ভিম’]
১৯৯১ সালে রাজসমন্দ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তারপর থেকে অপেক্ষার ২৭ বছর পার। জেলা সদর থেকেই স্নাতকোত্তরের পড়াশোনা করতে পারবে এখানকার ছেলেমেয়েরা। স্থানীয় বিধায়ক উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী হওয়ার পর সেই আশা ছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাতে ক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ। স্থানীয় কলেজ ছাত্রী ঋতু বললেন, “আমার তো কলেজের পরে আর পড়াশোনা হবে না। রোজ উদয়পুর যাতায়াত করা যাবে না। আর বাড়ির লোকও ওখানে থেকে পড়ার জন্য ছাড়বে না। মন্ত্রীর কাছে বহু দরবার করা হয়েছে কিন্তু কাজ যে হয়নি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছেন।” রাজসমন্দ সদরই নয়, পুরো জেলাতেই প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া রয়েছে বলেই জানা গেল।
The post বাংলার শ্রমিক আফরাজুলের খুনের দায় নিতে নারাজ রাজসমন্দ appeared first on Sangbad Pratidin.