রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: রঙের সঙ্গে আমার কোনও কলহ নেই। বরং রঙিন হতে চেয়েছি সারা জীবন। এবং যত বেড়েছে বয়স, যত বুড়ো হয়ে যাওয়ার ভয় ঢুকছে মনে, ততই বাড়ছে রঙের প্রতি টান। ঝলমলে রঙিন থাকার চুম্বকন ততই অনিবার্য হয়ে উঠছে জীবনে।
কিন্তু- এবং এ এক বিপুল ‘কিন্তু’ নিঃসন্দেহে- এই যে বছরে বছরে ঘুরে আসা রঙের উৎসব, গায়ে গায়ে রং মাখানোর এই জবরদস্তি বাড়াবাড়ি, কখনও কখনও অশালীন উৎপীড়ন, ছেলেবেলা থেকেই এই ভয়ংকর খেলাটি আমার বাৎসরিক আতঙ্ক ও অসহায়তা। কতবার যে রঙের সফ্ট টার্গেট হয়েছে আমার বিনম্র ভদ্রতা, কী বলব! দোল বা হোলি সম্পর্কে আমার সবথেকে হৃদয়-বিদারক নালিশ হল: এই উৎসব বেমালুম নষ্ট করে, নস্যাৎ করে উড়িয়ে দেয় মানুষের ব্যক্তিগত পরিসর। রং লাগানোর, রং মাখানোর, রঙে চুবিয়ে দেওয়ার অবাধ অজুহাতে কী নির্মমভাবে পর্যুদস্ত হয় প্রিভেসি। ‘আমাকে রং মাখাবেন না দয়া করে’, ‘প্লিজ শুধু কপালে দিন’, ‘একটু বুঝুন, আমার মন চায় না রং মাখতে’- এসব অনুনয় দোল উৎসবে কী বিদলিত, কী পরাভূত! আমার সংবেদন চিরদিন বলেছে, দোল উৎসব নির্মমভাবে দমনশীল! যিনি রং মাখতে চাইছেন না, দোল উৎসব যাঁর কাছে নিয়ে আসে রং খেলা বা রং দেওয়া-নেওয়ার সূক্ষ্ম মানসিক অনুষঙ্গ ও পরত, যার মধ্যে তেমন কোনও ভূমিকা নেই সারা শরীরকে রং মাখিয়ে ভুতুড়ে তৈরি করার অবদমনের- সেই মানুষটির অসহায় আকুতির কথা আমরা কিন্তু রঙের এই প্লাবিত উৎসাহনে মনে রাখি না। রঙের এই সর্বগ্রাসী বশীকরণ অনেক মানুষকে রঙের উৎসবের দিনে এক দুর্দম বিজয়োন্মত্ততার মধ্যে নিপীড়িত করে, সন্দেহ নেই।
আমার আজীবন মনে হয়েছে, এই একটি মাত্র উৎসবের দিন, যেদিনটি আমি আমার নিজের মতো করে কাটাতে পারি না। আমাকে আমার মতো থাকতে দেয় না দোল। কেড়ে নেয় আমার ‘স্পেস’, আমার স্বাধীনতা, রং গায়ে না-লাগিয়ে আমার মুক্ত সঞ্চরণের অধিকার। বাড়ির মধে্যও নিস্তার নেই। একমাত্র দোলের দিন আমি বুঝতে পারি, সারা জীবন একাকিত্বের চর্চা করেও, কী দুর্জ্ঞেয় সঙ্গদোষে আজও ভুগছি!
[আরও পড়ুন: সাম্প্রদায়িকতার ফাটল আগেই ছিল দেশে, দিল্লি সেটা দেখিয়ে দিল]
বন্ধ দরজা জোর করে খুলিয়ে ঢুকে পড়ে ওরা- পায়ে একটু আবির দিয়ে প্রণাম করবে বলে! এবং ছলনার শিকার হই আমি। পায়ের আবির মাথায় ওঠে অচিরে। তারপর আরও সব কদাচারী রঙের আবির্ভাব হয় ওদের দুর্বিনীত ঝোলা থেকে। শার্ল বোদলেয়রের মতো আমিও নিজেকে চিনতে পারি না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ওরা চলে যায় হাসতে হাসতে, আমাকে রঙিন করার অনন্য পুলকে। ওরা কি বুঝবে কোনও দিন, ওদের এই অর্বাচীন আনন্দে একইসঙ্গে মিশে যায় আমার অসহায় আর্তি, আমার দুর্বল, পরাজিত ক্রোধ? স্বীকার করছি, একটি বাসনাও মিশে থাকে আমার সুভদ্র সংবরণে- বৈরী সংহারের বাসনা। মনে মনে আমি রঙের উৎসবকে হত্যা করি।
অথচ, আমি রং ভালবাসি। এবং যাপনও করি রঙিন জীবন। শুধু রঙের সংজ্ঞাটি বদলে নিয়েছি আমার জীবনে। ওই যে সেই অনেক পুরনো রবীন্দ্রনাথ, তিনিই পালটে দিয়েছেন আমার জীবনে প্রতিদিন রঙের উৎসব- ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে।’ আমি এই রঙে বিশ্বাসী। আর তা-ই প্রতিদিনই আমার রঙের উৎসব। রং লাগায় আমার মনে সুর, সুরা, সাহিত্য, সংলাপ; রং দেয় আমাকে যাপনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম মিড়, মনন ও বোধের বিচিত্র কম্পন; রং দেয় আমাকে সম্পর্কের সুখ ও বেদনা; বিচ্ছেদের আড়াল ও দূরত্ব। আমি এই রঙেরই প্রার্থী হয়েছি আজীবন। এই যাচনায় কোনও পরাক্রম নেই। কোনও জবরদস্তি নেই। নেই কোনও জয়শঙ্খ ও বিজয়গর্বের প্রতিভাস। আছে শুধু বিনম্র প্রার্থনা। আর সেই রঙের বোধ থেকে, সংবেদ থেকে যেন না কোনও দিন চু্যত হই, আছে এই নিভৃত চাওয়া।
আমি, আরও অনেক মানুষের মতো, এই একান্ত নিজস্ব রঙের উৎসবে রং দিয়েছি, রং পেয়েওছি। কোনও ধমক, দমন কাজ করেনি এই রং খেলায়। শেষ পর্যন্ত এই রং খেলার কাছে বারবার যা পেয়েছি, তা নিবিড় রঙিন নিঃসঙ্গতা। সে বারবার এসেছে। বারবার চলে গিয়েছে। চোখ বুজলে দেখতে পাই, সে উঠছে সিঁড়ি দিয়ে। তার কপালে জ্বলছে লাল টিপ- শ্যামল কপালে লাল টিপের আলো, সেই রং মুহূর্তে লাগল মর্মে, ছড়িয়ে গেল আমার সমস্ত কাজের প্রাণনে। সে এসে বসল আমার নির্জনতার হৃদয়ে। শোনাল গান। রেখে গেল তার সুর। তার কণ্ঠের ওঠা—পড়া। তার সমস্ত শরীরের আন্দোলন, ভেসে-যাওয়া। তার চলে যাওয়ার পরে পড়ে রইল তার রঙিন সৌরভ। এই রং খেলায় আমি বিশ্বাসী। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। এই পরিসরটুকু কেড়ে নিও না তোমাদের রং-বাহিনীর রণেচ্ছু পরাক্রমে।
[আরও পড়ুন: ৫০ বছরের স্বাধীনতার প্রাক্কালে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশ চাই]
The post মনে মনে রঙের এই উৎসবকে হত্যা করি appeared first on Sangbad Pratidin.