আফগানিস্তানের পট পরিবর্তন এখন ভারতের দুশ্চিন্তার কারণ। দুশ্চিন্তার প্রথমটা আফগানিস্তানে ভারতীয় স্বার্থরক্ষা নিয়ে, দ্বিতীয়টা অবশ্যই পাকিস্তান ও কাশ্মীর। ভারতকে কি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হতে হবে? সময় বলবে। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
আফগানিস্তানে আচম্বিত পট পরিবর্তন সন্ত্রাস বিষয়ে ‘নীতিপরায়ণ’ নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘দৃঢ় অবস্থান’ ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। ভারতের ল্যাজেগোবরে হাল এখন এমনই যে, তালিবানদের বাবা-বাছা করতেও আর কুণ্ঠাবোধ নেই। কে জানে, অবস্থা সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে বসতে হয় কি না!
মনে পড়ছে আবদুল বাসিতের মুখটা। সেই সঙ্গে সুষমা স্বরাজ ও সুজাতা সিংয়েরও। ২০১৪ সালে মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম বছরে প্রথমজন ছিলেন পাকিস্তানের হাই কমিশনার, দ্বিতীয়জন বিদেশমন্ত্রী, তৃতীয়জন বিদেশ সচিব। সেই বছরের ২৫ আগস্ট সুজাতার যাওয়ার কথা ছিল ইসলামাবাদ, বিদেশ সচিব পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দিতে। তার আগেই ঘটে ১৯ আগস্টের সেই ঘটনা। কাশ্মীরের হুরিয়ৎ কনফারেন্সের কয়েকজন নেতার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন আবদুল বাসিত। এমন বৈঠক নতুন কিছু নয়। আগেও একাধিকবার হয়েছে। কিন্তু মোদির নির্দেশে সুজাতা সিং খবর পাঠালেন, পাকিস্তানকে ঠিক করতে হবে ‘তথাকথিত’ ‘কাশ্মীরি নেতা’ না কি ভারত সরকার- কার সঙ্গে পাকিস্তান কথা বলবে। কারণ, সন্ত্রাস ও আলোচনা পাশাপাশি চলতে পারে না। সেদিন পাকিস্তান হাই কমিশনে হুরিয়ৎ নেতা সাবির শাহ-র প্রবেশের পর বিদেশমন্ত্রক জানিয়ে দেয়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে পাকিস্তান আন্তরিক নয়। তাদের মনোভাব নেতিবাচক। ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ তারা করেই যাচ্ছে। এই অবস্থায় ইসলামাবাদে বৈঠক করে কোনও লাভ নেই। ভারত-পাকিস্তানের সরকারি স্তরে আলোচনার বন্ধ দরজা সেই থেকে এখনও খোলেনি।
[আরও পড়ুন: জন্মনিয়ন্ত্রণ থেকে গোরক্ষা বিল, বিভাজনী রাজনীতির সিঁদুরে মেঘ দেখছেন সংখ্যালঘুরা]
পরের বছরের ২৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিনের দিন তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে আফগানিস্তান থেকে ফেরার পথে লাহোরে নেমে পড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি! দু’-সপ্তাহ আগে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনের আসরে শরিফের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল কে জানে, মোদিকে দেখা গেল এক ধাক্কায় অবিশ্বাসের পর্দা সরিয়ে বিশ্বাসের উঠোনে পা রাখতে! তাতে লাভের লাভ কী হয়েছে, তাগিদ ও কারণই বা কী ছিল- তিনিই বলতে পারবেন। আজ পর্যন্ত মোদি তার ব্যাখ্যা দেননি। সেই কূটনৈতিক হঠকারিতার সাতদিন পরেই ঘটেছিল পাঠানকোটে বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হানা। অবিশ্বাসের পর্দা আরও ভারী হয়।
এসব মনে পড়ার কারণ আফগানিস্তান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানো শুরু করেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত, আফগানরাই তাঁদের ভবিষ্যৎ-নিয়ন্ত্রক হবেন। তালিবানরা উৎসাহিত। উদ্দীপিতও। তাদের সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে আফগান সরকার তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির মতো চরম অসহায় ভারতও। সন্ত্রাসীদের সংস্রব না-রাখার নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত এখন তালিবানদের তোয়াজে সচেষ্ট। কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানদের সঙ্গে দহরম মহরমের চেষ্টা মোটেই আর গোপন নয়। বিদেশমন্ত্রকের বিবৃতিতেও স্বীকার করা হয়েছে, ‘আফগানিস্তান পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ভারত সে-দেশের বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।’ স্বার্থরক্ষায় মোদি সরকার কতটা মরিয়া এবং আফগান সমস্যা ভারতকে কোন বিপদের মুখে দাঁড় করিয়েছে, এই বিবৃতি তার প্রমাণ। অথচ এই তালিবানদের একটা সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের ‘প্রক্সি’ বলে ভারত মনে করত। আজ তাদের মন পাওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত, জঙ্গিদের প্রতি ভারতের ‘দৃঢ় অবস্থান’ পরিস্থিতির বিচারে কতটা ঠুনকো!
এই ভারত কিছুকাল আগেও জঙ্গি-চরিত্রে ভাল-মন্দের বিচারে অনিচ্ছুক ছিল। মনে করত জঙ্গিরা জঙ্গিই। ভাল বা খারাপ হতে পারে না। তালিবান সম্পর্কেও সেই কাঠিন্য ভারতের ছিল। কিন্তু এখন যখন সবাই ক্রমশ নিশ্চিত যে, আফগান সরকারের পতন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা- ‘চিন্তিত’ ভারত তখন স্বার্থরক্ষায় উদগ্রীব। তিন বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে সে-দেশে লগ্নি হয়েছে। তা রক্ষা করা, ভারতীয় প্রকল্পগুলো চালু রাখা ও পাকিস্তানের প্রভাব রোখার চেষ্টায় ভারত এখন সেসব তালিবান গোষ্ঠীর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছে, যারা সেখানে পাকিস্তান ও ইরানের হস্তক্ষেপের বিরোধী।
আফগানিস্তান-ই এখন প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বিদেশমন্ত্রী জয়শংকরের ঘাড়ের ব্যথা। তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর বৈঠকে তালিবানদের সঙ্গে কীভাবে চলতে হবে, সেই পাঠ সম্প্রতি আফগান বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ হানিফ আতমারকে দিয়েছেন চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনটি বিষয় তিনি নিশ্চিত করেছেন। এক, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আফগানদের সব গোষ্ঠীকে নিয়ে সরকারকে আলোচনায় বসতে হবে। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হতে দেওয়া চলবে না। দুই, আফগানিস্তানকে সন্ত্রাসী জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য হতে দেওয়া চলবে না। সে-দেশ থেকে সন্ত্রাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করতে হবে। তিন, তালিবান নেতৃত্বকে সব সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে মুক্ত হতে হবে। দুশানবে সম্মেলনে জয়শঙ্করও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বুঝেছেন, আমেরিকা, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার তৈরি ‘কোয়াড’-এর পালটা আরও এক ‘কোয়াড’ আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে। চিন, পাকিস্তান, রাশিয়া ও ইরান। এই চতুর্ভুজের প্রথম দু’জন বহু বছর ভারতের মিত্র নয়। শেষ দু’জন আমেরিকার জন্য ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছে। রাশিয়ার প্রস্তাব, অন্তত দু’-তিন বছর তালিবানরা আফগান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার চালাক। পাশাপাশি স্থায়ী মীমাংসার জন্য কথা বলুক। তালিবানরা তা মানবে কি না, বলা কঠিন। না মানলে ভারতের কপালের ভাঁজ আরও গাঢ় ও গভীর হবে। চিন্তা ক্রমশ পরিণত হবে দুশ্চিন্তায়।
দুশ্চিন্তার প্রথমটা আফগানিস্তানে ভারতীয় স্বার্থরক্ষা নিয়ে, দ্বিতীয়টা অবশ্যই পাকিস্তান ও কাশ্মীর। গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশে ভারত চারশোরও বেশি প্রকল্প তৈরি করেছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় প্রকল্পের হানি তালিবানরা করবে না বলে মৌখিক আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু ভারত নিশ্চিত নয়। চিন তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্পে আফগানিস্তানকে শামিল করার চেষ্টা চালাচ্ছে পুরোদমে। পূর্ব লাদাখে তারা ভারতকে যে নতুন করে বিব্রত করবে না, সেই নিশ্চয়তা নেই। মোটকথা, আফগানিস্তানে ভারতের ভাল-মন্দ এবার থেকে নির্ভর করবে অন্যদের মর্জির উপর। ভারতের ভূমিকা স্রেফ দর্শকের।
দ্বিতীয় দুশ্চিন্তা অবশ্যই কাশ্মীর। আফগানিস্তানে পাক আধিপত্য বাড়লে কাশ্মীর নতুন শিরঃপীড়ার কারণ হতে পারে। চিন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরান তালিবানদের বোঝাচ্ছে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে গেলে সন্ত্রাসীদের রাশ তাদের টানতেই হবে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত চরিত্র যা ছিল, তা বদলাতে হবে। তালিবানরাও বোঝাতে চাইছে, অতীতের ছায়া থেকে তারা অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। শিক্ষা ও নারী-উন্নয়নে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু পূর্ণ ক্ষমতা পাওয়ার পর পাকিস্তানের মদতে যুদ্ধপ্রেমী আফগান গোষ্ঠীপতিরা কাশ্মীরের জইশ ও লস্কর জঙ্গিদের যে উসকানি দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ‘সন্ত্রাসবাদ ও আলোচনা একসঙ্গে হতে পারে না’ বলে ভারত এতদিন যার মুখদর্শন করেনি, কে জানে আফগানিস্তান পরিস্থিতি সেই পাকিস্তানের সঙ্গে বিনা শর্তে ভারতকে মুখোমুখি বসতে বাধ্য করবে কি না।
আফগানিস্তান-ই ঠিক করবে, ভবিষ্যৎ ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতি ও কাশ্মীরের ভাগ্য কোন খাতে বইবে। কিন্তু সেটাই সব নয়। মোদি সরকারকেও ঠিক করতে হবে, কাকে তারা প্রাধান্য দেবে। কাশ্মীর-কেন্দ্রিক সংঘ-নির্দেশিত ‘কোর অ্যাজেন্ডা’, না কি কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষের চাহিদা। উপত্যকাকে অখুশি রেখে জম্মু-কাশ্মীরকে খুশি করা যাবে না।