সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়: এত ‘সমকালীন’ পরিচালক আমার মনে হয় না বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কেউ আছেন! অথবা হিন্দিতেও, যদি তাঁর কথা ভাবি, ‘ভুবন সোম’ একটি নতুন যুগের সূচনা করে। তাঁকে বাদ দিলে বাংলা ছবি পিতৃহন্তার অন্যায় বরণ করবে।
অনেক সময় ভাঙনটাই বড় হয়ে ওঠে। তার মধ্যে যদি কিছু অসাম্য থাকে, কিছু অসংগতি, তবুও। যেমন নজরুল ইসলাম। দুয়ের দশকে (১৯২০—’৩০) নজরুলের ক্ষণস্থায়ী অমিতাচার উপেক্ষণীয় নয়। এরকমই কথা সাতের দশকের শুরুতে মনে হয়েছিল মৃণাল সেন প্রসঙ্গে। মনে পড়ে ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটির সেই বিবস্ত্র ম্যানিকুইন। আমাদের মনে হয়েছিল, যেন বা বাংলা চলচ্চিত্রের পরিকাঠামোয় তা অবিস্মরণীয় প্রতিকূলাচার। তখন আমাদের মানচিত্রে আগুন আর রক্ত, আমাদের গীতবিতান তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘুম, আমাদের জাগরণ, আমাদের সমাধিফলক জুড়ে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গেরিলা সমাবেশ। সেইরকম এক ঝড়ের রাতের অভিসারে আমরা দেখলাম মৃণাল সেনের কর্কশ তর্জনী, আমরা জানলাম ওই পুতুল ব্যর্থ, বন্ধ্যা, জননাঙ্গ বিরহিত। রাজনীতি আমাদের বলে দিচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদ কাগজের বাঘ। সিনেমা আমাদের জানাল নব্য—উপনিবেশবাদ আপাত—সজ্জিত, কিন্তু অন্তরে নপুংসক। সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে– বাঙালির সেই উদ্ধত যৌবন তাঁকে বরণ করেছিল।
শয়ে শয়ে অসংগতি ও ছেলেমানুষি সত্ত্বেও আমাদের মুখর ক্যান্টিনে ছড়িয়ে পড়তে থাকল ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’ ও ‘কোরাস’—এর দৃশ্যসমূহ।
আমরা মৃণাল সেনকে ভালবেসেছিলাম।
এ কথা সত্যি যে, আজ বুঝি, সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের তুলনায় তাঁর উচ্চতা কিছুটা কম। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করলে চলবে না যে, নবতরঙ্গ আন্দোলনকে তিনি ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ক্যামেরা যে নিজেই নিজের প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠতে পারে– এই কথা আমরা মৃণাল সেনের সূত্রেই স্পষ্ট জেনেছিলাম। এত ‘সমকালীন’ পরিচালক আমার মনে হয় না বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কেউ আছেন! অথবা হিন্দিতেও, যদি তাঁর কথা ভাবি, ‘ভুবন সোম’ একটি নতুন যুগের সূচনা করে। এই যে সৌরাষ্ট্র তটে এক অসামান্য রূপসী নায়িকার গ্রীবাবিভঙ্গ, তা তো শুধুমাত্র নারীর রূপের বর্ণনাও নয়, নিসর্গবর্ণনাও নয়। এমন বুর্জোয়া বিদ্রুপ ও তাচ্ছিল্য, যা মধ্যবিত্তর সমস্ত নৈতিকতা ভেঙে তছনছ করে দেয়। মৃণাল সেন দেখাতে পারেন এবং একমাত্র তিনিই দেখতে পারেন যে, মধ্যবিত্তর একটি সামান্য ফ্ল্যাটে, ভাড়াটে কোটরে তছনছ হয়ে পড়ছে বার্লিন দেওয়াল। তিনিই দেখতে পারেন ও দেখাতে পারেন যে একটি মেয়ে সারারাত না ফিরলে সামাজিক রিরংসা ও আক্রোশ কীভাবে প্রবল হয়ে ওঠে।
কী আশ্চর্য, এতদিন আগে তিনি বানিয়েছিলেন ‘একদিন প্রতিদিন’! কী আশ্চর্য, এতদিন আগে তিনি দেখেছিলেন ‘বাইশে শ্রাবণ’ কীভাবে এক নারীর প্রণয় ও বিপর্যয়! এ সমস্তই দেখেছিলেন দৈনন্দিনতার স্বাদ নিয়ে। ঋত্বিক ঘটকের মতো তাঁর কাছে কিংবদন্তি ছিল না। সত্যজিৎ রায়ের মতো কোনও উনিশ শতক ছিল না। মৃণাল সেন আজকের, আজকের এবং আজকের। এই কথাটি তিনি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। সেজারে জাবাত্তিনি—কে উদ্ধৃত করে। আজ বোঝা গেল মৃণাল সেন কলকাতা শহরে সত্যিই গতকালের হয়ে গেলেন।
কিন্তু বাংলা বা ভারতীয় ছবি তাঁকে ভুলতে পারবে না। তাঁর ওই চাপা অধরোষ্ঠিত যে বিদ্রুপ, যা নাগরিকতার সিলমোহর, তা বাদ দিলে বাংলা ছবি পিতৃহত্যার অন্যায় বরণ করবে।
মৃণাল সেন আমাদের শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন!
The post এই কলকাতা ’১৮-য় তিনি গতকালের হয়ে গেলেন appeared first on Sangbad Pratidin.