shono
Advertisement

অভিজিৎ ‘অর্ধেক বাঙালি’, আর রবীন্দ্রনাথ?

গুণীকে লাঞ্চনার বিষকৌটো আমরা কেমন সযত্নে পাঁজরের তলায় লুকিয়ে রেখেছি। The post অভিজিৎ ‘অর্ধেক বাঙালি’, আর রবীন্দ্রনাথ? appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 03:33 PM Oct 16, 2019Updated: 05:43 PM Oct 16, 2019

সরোজ দরবার: সেও এরকমই পুজো শেষের দিনকাল। ছুটির পর খুলেছে শান্তিনিকেতন। বোলপুরে টেলিগ্রাম এল যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। কবি তখন কয়েকজন অধ্যাপক ও নেপালচন্দ্র রায়কে নিয়ে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হল সেই টেলিগ্রাম। তিনি পড়ে দেখে নেপালবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ড্রেন তৈরির টাকা জোগাড় হয়ে গেল। আশ্রমে সে-সময় একটা নতুন নর্দমা তৈরির কাজ অর্ধেক অবস্থায় পড়েছিল। টাকার টানাটানিও চলছিল।

Advertisement

[আরও পড়ুন: খাণ্ডবদহন থেকে ‘ইকোসাইড’, প্রকৃতির বিনিময়ে চলছে দখলের রাজনীতি]

প্রায় ১০৬ বছর পরের কথা। অমর্ত্য সেনের পর আবার এক বঙ্গসন্তান যখন নোবেল পেলেন, তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলো জানালেন, খবর শোনার পর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘুমোতে চলে গিয়েছিলেন। এস্থার জানাচ্ছেন, ঘণ্টাখানেক বাদে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হবে অথচ অভিজিৎ ঘুমোতে যাচ্ছেন দেখে তিনি নিজেই উঠে পড়েন। এমআইটি-র অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচার যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, অভিজিতের শরীরী ভঙ্গিতে কী আশ্চর্য নিরাসক্তি। এতবড়ো পুরস্কার প্রাপ্তিতেও কী অপূর্ব নির্লিপ্তি। চকিতে যেন মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সে-দিনের কথা।  

এই নিরাসক্তি কাকতালীয় মনে হতে পারে, কিন্তু নয়। বরং অভিজিৎবাবুর এই শরীরী ভাষাই মনে করিয়ে দেয়, তিনি রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর দেশের লোক। ইতোমধ্যেই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাওয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, অভজিৎবাবুর ন্যাশানালিটি নিয়ে। আদৌ তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে ভারতের গর্ব করার কিছু আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ-রাজ্যের এক নেতা তাঁকে ‘অর্ধেক বাঙালি’ বলে অভিহিত করেছেন, খবরে প্রকাশ। প্রশ্নকর্তারা সকলেই বাঙালি। অভিজিৎবাবুও বাঙালি। এবং, বাঙালি বলেই তিনি সম্ভবত জানেন, বাংলা থেকে তাঁর কপালে কী কী জুটতে পারে।

এই অভূতপূর্ব মণিহার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পেয়েছেন, অমর্ত্য সেন-অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বা বাদ যাবেন কেন! সে-কালে প্রায় পাঁচ সাতশো লোক কলকাতা থেকে বোলপুরে গিয়ে কবিকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিনকার ভাষণে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন তা অনেককেই ক্ষুব্ধ করেছিল। কবি স্পষ্টই জানিয়েছিলেন, ‘বৈদেশিক সম্মানের বন্যায়’ যাঁরা নৌকা ভাসিয়ে সম্মান জানাতে এসেছেন, তা বাস্তব নয়। কারণ বন্যা শেষ হলেই পড়ে থাকবে ‘ভাঙাচোরার আবর্জনা অবশিষ্ট’। তার থেকে আগে যে-অপমান তিনি দেশ থেকে পেয়েছেন, তাই-ই ভালো। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় খানিকটা প্রলেপ দিয়ে বলেছেন, যে-দিন এই সংবর্ধনার আয়োজন ছিল, সেদিনই কবির স্ত্রী ও ছোটো ছেলের মৃত্যুদিন। তা ছাড়া একটি তিক্ত চিঠিও সেদিনই পেয়েছিলেন তিনি, এবং সংবর্ধনা আসরের একদম সামনে এমন কয়েকজনকে দেখেছিলেন যাঁরা বরাবর কবিকে ‘অনাদর’ করেছেন। তাই তিনি কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু প্রমথনাথ বিশী চাঁচাছোলা জানিয়ে দিয়েছেন, ভেবেচিন্তেই কবি সেদিন এই কথাগুলি বলেছিলেন। কারণ, বহু বিজ্ঞজনই তো রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রসঙ্গে নাক কুঁচকোতেন। প্রমথনাথের মত, ‘প্রতিভাবান ব্যক্তিরা অযোগ্যের হাতে অপমানে ও অবজ্ঞায় যে আঘাত পান, সাংসারিক সুখদুঃখ-লাভক্ষতির দ্বারা তাহার বিচার করা চলে না। সাধারণ লোকেরা এই বেদনার প্রকৃতি জানে না বলিয়াই ইহাকে লঘু দুখবিলাস বলিয়া মনে করে। প্রতিভাবানের এই দুঃখ কেবল ব্যক্তিগত সম্মান-অসম্মানের ব্যাপার নয়- ইহা দ্বারা তাঁহার কবিধর্ম, সাহিত্যিক সত্তা, প্রতিভার প্রকৃতি পীড়িত ও লাঞ্ছিত হতে থাকে।’

অর্থাৎ, এ-লাঞ্ছনার ইতিহাস বহুদিনের। সম্মানের বন্যা শেষ হলে কী আবর্জনা যে পড়ে থাকে, অমর্ত্য সেন-কে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অহরহ ঘটতে থাকা ট্রোলিং-ই তা বুঝিয়ে দেয়। ‘উনি দেশের জন্য কী করেছেন?’ এ-তো প্রায় জাতীয় প্রশ্ন হয়ে উঠতে চলেছে। অভিজিৎ সম্ভবত জানেন, বাঙালির এই লাঞ্চনার ইতিহাস ও অভিপ্রায়। আজ তাই তাঁকে নিয়ে যত প্রশ্নের ছলে নিন্দার বুদুবুদ ভাসছে, তাতে অনেকেই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন বটে, কিন্তু পিছু ফিরলে দেখলে বোঝা যায়, এই নিন্দাই খাঁটি সত্যি। রবীন্দ্রনাথ থেকে অমর্ত্য সেন হয়ে অভিজিৎ পর্যন্ত, এর বাইরে যা-কিছু হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের কথায় তা ‘বাস্তব’ নয়। রবীন্দ্রনাথ সেদিন কিঞ্চিৎ রুষ্ট হয়েছিলেন, অমর্ত্যবাবু বরাবরই চুপ, আর অভিজিৎ তো ঘুমোতেই চলে গেলেন। দেশের মানুষের পাওনা তিনি আগে থেকে জানেন বলে, মাথার উপর রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস আছে বলেই বোধহয় এই আশ্চর্য নির্লিপ্তির অভিজ্ঞান তাঁর করায়ত্ত। বস্তুত এটাই তো বাঙালির অন্তঃস্থ শক্তি। সে-তো কোনোদিনই লোভে পা দেয়নি। এমনকি সেই সুপ্রাচীনকালে যখন ঐতরেয় আরণ্যকে বাঙালিকে পাখির জাত বলে কটাক্ষ করা হচ্ছে তখনও সে লোভে পড়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র স্বীকার করে নেয়নি। বরং সমস্ত বিরুদ্ধমত প্রশ্রয় পেয়েছে এই বাংলাতেই। লোভের নমুনা কি নেই? আছে। তবে বাঙালি সামগ্রিক ইতিহাস বলে, তার সন্ন্যাসের ইতিহাসে শক্তি অনেক বেশি। উচ্চ মেধা, উচ্চ চিন্তা, খ্যাতির শীর্ষ ছুঁয়েও অন্তরে বৈরাগ্য ধারণ করা বাঙালিমানসের বৈশিষ্ট্য। চৈতন্য থেকে রবীন্দ্রনাথ – সেই পরম্পরাই প্রবহমান। এই লোভজর্জর, আত্মপ্রচারের যুগে আজও বহু সাধারণ বাঙালি এই সত্যিতেই বিশ্বাস করেন এবং জীবনে পালনও করেন। আর সেই সত্যি ও শক্তি যিনি অন্তরে ধারণ করে নোবেল পাওয়ার পরও ঘুমোতে চলে যান, তাঁকে ‘অর্ধেক বাঙালি’ বললে, আসলে এই বাঙালিমননকেই অস্বীকার করা হয়। বরং দেশকাল নির্বিশেষে বাঙালি এই শক্তিকে যিনি লালন করে চলেছেন, তিনিই তো পুরোদস্তুর বাঙালি। তবু, কোনও ব্যক্তিবিশেষ নন, যাঁরা যারা এই ‘অর্ধেক বাঙালি’র ধারণা পোষণ করছেন, যাঁরা অভিজিতের কাজকে, ব্যক্তিজীবনকে প্রশ্নের মুখে তুলে নিজেদেরকে জ্ঞানী সমালোচক প্রমাণের চেষ্টায় রত, তাঁরা আসলে চোখে আঙুল দিয়ে গোটা বাঙালি সমাজকে দেখিয়ে দিচ্ছেন, সেই রবীন্দ্রনাথের সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি, গুণীকে লাঞ্চনার বিষকৌটো আমরা কেমন সযত্নে পাঁজরের তলায় লুকিয়ে রেখেছি। প্রকারন্তরে আমরাই কি তবে ‘অর্ধেক বাঙালি’ হয়ে চিরটাকাল থেকে যাচ্ছি না!

এ-সবই অবশ্য রাজনৈতিক চাপানউতোর বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তাতে মাছের থালায় শাকের আঁটি ফেলা হয় মাত্র। কাজী আবদুল ওদুদ ‘দেশের জাগরণ’ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক অসার্থকতার মূলে আমাদের শিক্ষিতদের শোচনীয় আত্মসর্বস্বতা ও অপ্রেম। যদি বলা যায় যে দেশের রাজনৈতিক চেতনার প্রারম্ভে তাঁরা পূজারি হয়েছিলেন পরিতোষ-দেবতার আর আজ পূজারি হয়েছেন অসন্তোষ-দেবতার তবে অপ্রিয় কথা বলা হয় সত্য কিন্তু অসত্য-কথা নয়।’  

অপ্রিয় হলেও এ-মত আজও সত্যি, বরং আরো তীব্রভাবে সত্যি। অভিজিৎবাবুরা তা জানেন। তাঁরা তাই ঘুমোতে চলে যান। আমাদেরই বরং জেগে থাকতে হয় বিষজর্জর খণ্ডিত বাঙালিয়ানায়, ‘অর্ধেক বাঙালি’ হয়ে থাকার ভবিতব্য মাথা পেতে নিয়ে। 

[আরও পড়ুন: দাউদ ঘনিষ্ঠের থেকে সম্পত্তি ক্রয়, প্রফুল প্যাটেলকে তলব ইডির]

The post অভিজিৎ ‘অর্ধেক বাঙালি’, আর রবীন্দ্রনাথ? appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup রাজধানী এক্সপ্রেস toolbarvideo ISL10 toolbarshorts রোববার