সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর: নিম্ন দামোদরের বানভাসির দায় কি তবে ‘ক্যাপটেনহীন’ স্কাডা’র? কত জল আসবে? যত জল আসবে, ততটাই কি প্রবাহিত হয়ে চলে যাবে নিম্ন দামোদরে? এসব প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দিতে পারতো ‘স্কাডা’ (SKADA)। কিন্তু দক্ষ কর্মীদের অভাবে তা আর ঠিকমতো কাজ করছে না। সেই কারণে কোটি টাকা খরচ করে ‘স্কাডা’ প্রযুক্তি বসিয়েও সুফল মিলছে না বলে আক্ষেপ কর্মীদের।
ডিভিসির (DVC) বিভিন্ন ব্যারেজ থেকে জল ছাড়া নিয়ে রাজ্য ও ডিভিসি বাকবিতণ্ডা বহু দিনের। সেই জটিলতা দুর করতেই সেচ দপ্তরের বর্ধমান ডিভিশন দুর্গাপুর (Durgapur) ব্যারেজে ২০১৯-এর ১৪ এপ্রিল বসে ‘স্কাডা’ প্রযুক্তি বসায়। ২০২২ সাল থেকে কাজ করতে শুরু করে এই আধুনিক প্রযুক্তি। কিন্তু সেই থেকে কার্যত বসেই রইল। কারণ দেড় কোটি টাকার ‘স্কাডা’ চালানোর সেনাপতিই নেই দুর্গাপুর ব্যারাজে! সূচনা থেকেই ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার। তিন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই স্কাডার রাডার নিয়ন্ত্রণ করেন। দামোদরের বন্যা পরিস্থিতিতে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় ওই ব্যবস্থাপনার কঙ্কালসার হাড়-পাঁজর বেরিয়ে আসায় সমালোচনা করেছেন সাংসদ স্বয়ং।
কী এই ‘স্কাডা’? দুর্গাপুর ব্যারেজের সুপারভাইজার কন্ট্রোল এবং ডেটা নথিভুক্তিকরণ কেন্দ্রটিই হলো স্কাডা। উপগ্রহ নির্ভর স্বয়ংক্রিয় অপারেশন সিস্টেম চলে একটি বিশেষ সফটওয়্যার মারফত। সেই সিস্টেমটাই একজন বিশেষজ্ঞ অপারেটরের অভাবে বন্যা পরিস্থিতির সময় কার্যত বেকার থাকে। এই কেন্দ্রটি কেন্দ্রের জলসম্পদ মন্ত্রকের ‘ন্যাশনাল হাইড্রোলজি প্রজেক্টে’র অধীনে একটি অত্যাধুনিক উদ্যোগ। রাজ্যের সেচ ও জলপথ বিভাগ অবশ্য এই কেন্দ্রটির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে।
[আরও পড়ুন: হামাসের হামলায় মৃত মার্কিনিরা, ইজরায়েলে যুদ্ধবিমান-রণতরী পাঠাল ক্ষুব্ধ আমেরিকা]
বর্ধমান দুর্গাপুরের বিজেপি সাংসদ (BJP MP) সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া সম্প্রতি দামোদর ব্যারাজে জল ছাড়া দেখতে গিয়ে ওই কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তার পর উপহাস করেন তিনি। বিরক্ত হন কেন্দ্রটির বেহাল দশা দেখে। কারণ, জরুরি পরিস্থিতিতে সিস্টেমটি পরিচালনা করার জন্য কেউ না থাকায় কেন্দ্রটি ছিল তালাবন্ধ। তিনি সেচ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এই সংকটময় সময়ে যখন চালানোর দরকার তখন কেন এটি চালু করা হলো না?” ব্যারেজ নিয়ন্ত্রণকারী রাজ্য সেচ দপ্তরের দামোদর হেড ওয়ার্কসের নির্বাহী বাস্তুকার সঞ্জয় মজুমদার বলেন, “আমাদের গ্রুপ-ডি কর্মীরা সময়ে সময়ে এটি পরিচালনা করতেন।
কিন্তু, বর্তমান বন্যা সতর্কতার কারণে, সবাইকে ফিল্ডে নিয়োগ করা হয়েছে ব্যারেজ পরিকাঠামো তদারকি করার কাজে।” এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্যে দক্ষ কর্মীর অভাবও স্বীকার করেন তিনি। মাইথন এবং পাঞ্চেত (প্রায় ৬০থেকে ৮০কিমি দূরে) উজানের জলাধারগুলি থেকে নিয়ন্ত্রিত জল ছাড়ার তথ্য পেতে, সুস্পষ্ট সহায়তার জন্য কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। আসানসোল, মাইথন, পাঞ্চেত জলাধারে রাডার নির্ভর সেন্সর বসানোর পাশাপাশি, স্রোত নিয়ন্ত্রক স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমটি বজায় রাখার জন্য গেটের ওঠানামা সবটাই করবে এই স্কাডা। ব্যারেজের স্পিলওয়ে গেটের সিরিজে ৬ সেট ওয়াটার লেভেল সেন্সর সে জন্যই বসানো হয়েছে।
এছাড়াও,মাইথন,পাঞ্চেত এবং আসানসোল-দুর্গাপুর ব্যারেজে নদীর প্রবাহ নিরীক্ষণের জন্য ৩ টি আলাদা সেন্সর সেট বসানো হয়েছিল। এই সিস্টেমটি ডিভিসি’র ‘কাস্টমাইজড’ ক্লায়েন্টদের প্রতি ঘন্টায় জলের পরিস্থিতি জানানোর জন্য। ব্যারেজ কন্ট্রোল রুম থেকে সমস্ত তথ্য একটি ওয়েব সার্ভারে আপলোড করা হয় ঘণ্টায় ঘণ্টায়। সঞ্জয় মজুমদার বলেন, “আমরা সম্প্রতি একজন সহকারী প্রকৌশলী পেয়েছি। যিনি এখন থেকে সিস্টেমটি দেখাশোনা করবেন। আমাদের এখন এই কেন্দ্রের জন্য একজন নিজস্ব বিশেষজ্ঞ নেই এ কথা সত্য।”
[আরও পড়ুন: শাহরুখকে খুনের হুমকি! Y+ ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দিচ্ছে মহারাষ্ট্র সরকার]
সেচ দপ্তর জানা গিয়েছে, ব্যারাজের ১, ২৭, ৩৩, ৩৪ নম্বর লকগেটগুলি ত্রুটি থাকায় এখন সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। আর প্রশ্ন এখানেই, বছর চারেক আগে ব্যারেজের ১ নম্বর লকগেট নতুন করে বসানো হয়। তার মধ্যে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় আবারও বিপর্যয়ের আশঙ্কা? সাংসদ সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া জানান, “কয়েকটি লকগেটের ত্রুটি রয়েছে। জলস্তর কমলে সেগুলোর মেরামত কাজ শুরু হবে”। তিনি আরও বলেন, “আধুনিক মানের মনিটারিং সিস্টেম বসেছে। তবে সেসব অপারেটিং করার দক্ষ কর্মীর অভাবে বন্ধ।”
১৯৫৫ সালে দামোদর নদের উপর দুর্গাপুর ব্যারেজটি তৈরি হয়। উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের প্রসার ও বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি, হাওড়া জেলার কৃষিকাজে সেচের সুবিধার জন্য। মোট ৩৪টি লকগেট। ব্যারেজের ক্যাচমেন্ট এরিয়া ২৩, ৩৭০ বর্গ কিলোমিটার। সর্বাধিক জলের গভীরতা ৬৪.৪৮ মিটার। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে সংস্কার না হওয়ায় বর্তমানে পলি পড়ে নাব্যতা কমেছে দামোদরের এই দুর্গাপুর ব্যারেজের।