ট্রোলও যে এই সোশ্যাল মিডিয়ার এক সর্বজনগ্রাহ্য স্টেটাস পেয়ে গিয়েছে তার কারণ আমরাই সেটিকে গ্রহণ করেছি with so little resistance৷ অলস অবসরে আমাদের অহরহ লাইক-লাভ-লাফ প্রশ্রয় দিয়েছে এমন এক সংস্কৃতিকে যা আজ দুধ-কলায় পোষা কালসাপ হয়ে নারীদের রজস্রাবকে নিয়ে ঠাট্টা করতেও পিছপা হচ্ছে না৷ এ দায় কার? আলোচনায় সরোজ দরবার
দার্শনিক Slavoj Žižek সিনেমাকে ‘the ultimate pervert art’-এর আখ্যা দিয়েছিলেন, কেননা ‘It doesn’t give you what you desire – it tells you how to desire.’ তাঁর এই কথায় সিনেমার পরিবর্তে যদি সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রোল-সংস্কৃতিকে বসানো যায়, তবে বোধহয় ভুল কিছু হবে না৷ এক শ্রেণির তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এই সংস্কৃতিকে রীতিমতো ‘শিল্প’ হিসেবেই গণ্য করেন এবং সে সম্মানেই রীতিমতো দায়িত্ব সহকারে এটিকে লালন-পালন করেন৷ বস্তুত এটিও সেই ‘পারভার্ট আর্ট’ যা মানুষকে বোঝায়, এবার তোমার হাসির সময় হল৷ কোনও একটি ঘটনা সম্পর্কে সাধারণের ভাবনার গতিপ্রকৃতি কোন দিকে হওয়া উচিত, কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা বিধেয় তা ঠিক করে দিতে আসরে নামে সে৷ যে বিষয় নিয়ে হয়তো মাথা ঘামানোর দরকারই ছিল না, এই ট্রোল-সংস্কৃতি মাথায় হাতুড়ি ঠুকে বলবেই যে, এই বিষয় নিয়ে তোমার সমগোত্রীয় এত হাজার মানুষ ‘লাফ’ দিয়েছে, এত হাজার মানুষ ‘উইঙ্ক’ করেছে, আর তুমি বাদ যাবে কেন? এখন এই ট্রোল-সংস্কৃতিই যখন বিকৃতির পর্যায়ে পৌঁছে সাধারণ মানুষের পরিশীলিত বোধে আঘাত হানে, তখন সমালোচনার ঢেউ ওঠে৷ সন্তান বিগড়ে যাওয়ার জন্য যেমন মা-বাবার দায় কোনওভাবেই অনস্বীকার্য নয়, তেমনই প্রশ্ন ওঠে, এই ট্রোল-সংস্কৃতির বিকৃতির দায় কি আমাদেরও নয়?
যখন যা কিছু জনপ্রিয় ওঠে তখন সেই জনপ্রিয় বস্তুটিকেই ‘জনগণের সংস্কৃতি’ হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়৷ কেননা মানুষ সেই জিনিসকে গ্রহণ করছে৷ চাহিদা তৈরি হচ্ছে এবং সেই চাহিদাপূরণের জন্যই কাজ করছে একটা সংগঠিত ‘ইন্ডাস্ট্রি’৷ অর্থাৎ সাফাইটা এরকম, থিওডোর অ্যাডোর্ন ও হর্কহাইমার যার ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন, “… it is claimed, were derived from the needs of consumers: that is why they are accepted with so little resistance৷” আসলে এটাও সংস্কৃতি তৈরির একটা ‘মেকানিজম’, যা ঠিক করে দেয় সংস্কৃতি হিসেবে কোনটা মেনে নিতে হবে৷ অবশ্যই সামনে শিখণ্ডি করে রাখা হয় জনগণের চাহিদাকে৷ বস্তুত তা মিথ্যে৷ আসলে ‘a cycle of manipulation and retroactive need is unifying the system ever more tightly৷’ এর পিছনেও অবশ্য আছে বাজারের চতুর মস্তিষ্ক৷ এক ছদ্ম চাহিদা খাড়া করে নিজস্ব প্রোডাক্ট সংস্কৃতির নামে জনগণের রক্তে ইনজেক্ট করেই মাস কালচারের নামে ঠকানো হয় সাধারণকে৷ অর্থাৎ ‘ the truth that they are nothing but business is used an ideology to legitimize the trash they intentionally produce৷’ এই জনগণের সংস্কৃতি আর সংস্কৃতি তৈরির মেকানিজমের তত্ত্ব ও তার ফলিত প্রয়োগ, আমাদের বাংলা ইন্ডাস্ট্রির নিরিখে যে কেমন, তার চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন আশিস লাহিড়ী মহাশয়৷ কৌতূহলী পাঠক এবারের ‘শারদীয় সংবাদ প্রতিদিন’-এ তাঁর ‘ কলে-ছাঁটা সংস্কৃতি এবং থিওডোর অ্যাডোর্নো’ প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন৷
ট্রোলও যে এই সোশ্যাল মিডিয়ার এক সর্বজনগ্রাহ্য স্টেটাস পেয়ে গিয়েছে তার কারণ আমরাই সেটিকে গ্রহণ করেছি with so little resistance৷ অলস অবসরে আমাদের অহরহ লাইক-লাভ-লাফ প্রশ্রয় দিয়েছে এমন এক সংস্কৃতিকে যা আজ দুধ-কলায় পোষা কালসাপ হয়ে নারীদের রজস্রাবকে নিয়ে ঠাট্টা করতেও পিছপা হচ্ছে না৷ আজ যখন অসংখ্য সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তখন প্রশ্ন ওঠে দোষ কি শুধু ওই বিশেষ পেজটির অ্যাডমিনের? রসবোধের সূক্ষ্মতা বলে দিনের পর দিন আমরাই কি সংস্কৃতিকে ইন্ধন দিইনি? কোনও জনপ্রিয় নায়ককে, তাঁর বিশেষ কোনও অক্ষমতাকে নিয়ে যখন মশকরা হয়ে চলেছে, তখন কেন মনে হয়নি যে, তা কতটা রসিকতা আর কতটা নোংরামো! যেহেতু সেইসব আক্রমণ তথাকথিত ‘বিলো দ্য বেল্ট’ নয়, অতএব সভ্য জনগণেশ পিঠে কুলো আর কানে তুলো দিয়ে দায় এড়িয়েছে৷ কার্টুন ও পলিটিক্যাল কার্টুনের যে রসবোধ ও উচ্চতা ছিল তা দিনে দিনে নিচে নেমেছে৷ আমরা তো চোখ বুঝেই থেকেছি৷ প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে প্রকাশ্য জায়গা ছেড়ে গোপনে অশ্লীলতা চালাচালি করে সূক্ষ্মতার মুখে ঝামা ঘষেছি৷ যে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনার যে গণতান্ত্রিক পরিসর সোশ্যাল মিডিয়া করে দিয়েছে এবং যা একটি বিশেষ উচ্চতায় উঠতে পারত, তা কি আদৌ আর সে জায়গা থাকছে? যে কোনও পরিচালক, গায়ক, রাজনীতিককে নিয়ে যখন ‘সোশ্যাল’ জনগণ ঠাট্টায় মেতে ওঠেন, তখন কি প্রশ্ন জাগে না যে, সেই ঠাট্টা করার যোগ্যতা আদৌ ঠাট্টাকারীদের আছে কি না? জাগে না বলেই, এই কালচার দিনে দিনে ‘মাস কালচার’-এর চেহারা নিয়েছে৷ এর পরিণামই আজ এমন বেপরোয়া যে, কোনও অশ্লীল পোস্টের প্রতিবাদ করলে কোনও মহিলাকে তাঁর ঋতুকাল নিয়ে প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে৷ ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকে সব্যসাচী সেন ছেলের সঙ্গে অনেক তর্কের পরে বুঝেছিলেন, ঠিকঠাক উত্তর পেতে গেলে ঠিকঠাক একটা প্রশ্ন করতে হয়৷ অর্থাৎ প্রশ্নকারীকে আগে যোগ্য হয়ে উঠতে হয়৷ এই ঠাট্টা সংস্কৃতির অধিকারী আমরাও একই প্রশ্ন কি নিজেদের দিকে করতে পারি না যে, একটা সত্যি ঠাট্টা করার মতো যোগ্যতা কি আমাদের আছে? সে প্রশ্ন দিনের পর দিন উপেক্ষিত থেকেছে বলেই রসবোধের মান এতটা নিচে নেমেছে৷ আরও তলিয়ে দেখলে, এই নোংরামো তাহলে আমাদের তথাকথিত পরিশিলীত চামড়ার ঠিক নিচটিতেই ছিল৷ কেউ বা কারা সেই গোপনীয়তাকেই ফাঁস করে দিয়েছে৷ উইঙ্কল টুইঙ্কল-এরই আর এক সংলাপ অনুকরণে বলতে ইচ্ছে করে, রসিকতাকে আর কত নিচে নামাবে তোমরা!
এই ‘তোমার’ ভিতর থেকে আমিও বাদ নেই৷ আমি ও আমাদের গোপন ইন্ধনেই তো আজ এই বাজারি সংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়েছে৷ অথবা আমাদের গোপন নোংরামির প্রকাশেই তা পত্রপুষ্পে পল্লবিত হয়েছে৷ প্রথম ট্রোলটি থেকেই যদি আমরা একে ঠেকিয়ে রাখতে পারতাম, তবে আজ তা বিষবৃক্ষ হতে পারত না৷ অথচ ছোট ছোট স্বার্থে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়াকে দিনের পর দিন আমরা ব্যবহার করে গিয়েছি৷ আর তাতে তুরুপের তাস হয়েছে ট্রোল৷ একটি ট্রোল যে পরিমাণ লাইক-শেয়ার পায়, রক্ত চাওয়ার আবেদন একই প্ল্যাটফর্মে ছিটোফোঁটাও মনযোগ পায় না৷ অর্থাৎ পার্থক্য গড়েছি আমরাই৷ তার ফলও ভোগ করতে আমাদেরই৷ আজ যা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে হচ্ছে, কাল সেখানেই যে কোনও পরিচিতের মুখ থাকবে না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই৷ এই লেখা লেখার সময়ই দেখছি, এক পরিচিতাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল প্রস্তাব দেওয়ার স্ক্রিনশট আপলোড হয়েছে৷ কোথা থেকে এল এই ঔদ্ধত্যের সংস্কৃতি? এ যদি আমাদের প্রশ্রয়ে না হয় তবে কার!
তাহলে এখন আমাদের করণীয়ই বা কী? সন্দেহ নেই, সোশ্যাল মিডিয়া বাস্তব জীবনের সঙ্গে শুধু জড়িয়েই যায়নি, তাকে রীতিমতো কবজা করে নিয়েছে৷ সুতরাং তাকে জীবন থেকে বাদ দেওয়ার উপায়টি সহজ নয়৷ যাঁরা পারেন, তাঁরা সৌভাগ্যবান৷ আর যাঁরা পারেন না, তাঁরা কি এই আগুনেই হাওয়া দিয়ে যাবেন? এই সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের মনে করায় যে আমরা অনেক কিছু বলতে পারছি৷ কিন্তু তা আসলে আমাদের অনেক কিছু বলতেই ভুলিয়ে দেয়৷ ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটি আমরা বলতে পারি না, বদলে সোশ্যাল মিডিয়ার আশ্রয় নিই৷ আর যেখানে মুড়ি-মুড়কি একদরে বিকোয় সেখানে প্রতিবাদ আর মশকরার ফারাকও খুব ক্ষীণ হয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে পড়ে৷ ফলে বহু পরিচিত মুখকেই দেখা যায় এই ট্রোল-সংস্কৃতিকে ইন্ধন জোগাতে, যাঁরা তথাকথিত সভ্য দুনিয়ায় প্রগতিশীলতার মুখোশটি ছাড়েননি৷ তাহলে কি এটাই বাজার নির্ধারিত আধুনিকতার লক্ষণ? যদি কান্টের কথা অনুযায়ী আলোকপ্রাপ্তির হয়, ‘the human being’s emergence from self-incurred minority. Minority is inability to make use of one’s own understanding without direction from another’, তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই চলতি সংস্কৃতি আমাদের কোথায় নামিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ অতএব পিঠে কুলো, কানে তুলো দিলেও যে বাঁচোয়া তা কিন্তু নয়৷ এখনও যদি রুখে দাঁড়ানো নয়, তবে হুল ফুঁটতে বিশেষ দেরি হবে না৷ আর তাতে অসহায়ত্ব আরও বাড়বে বই কমবে না৷ আমরা কি ভুলে যাব পুরন্দর ভাটের সেই সতর্কবার্তাটি-
উড়িতেছে ডাঁস, উড়িছে বোলতা, উড়িতেছে ভীমরুল,
নিতম্বদেশ আঢাকা দেখিলে ফুটাইবে তারা হুল৷
মহাকাশ হতে গু-খেকো শকুন হাগিতেছে তব গায়
বাঙালি শুধুই খচ্চর নয়, তদুপরি অসহায়৷
The post এই ট্রোল-সংস্কৃতির বিকৃতির দায় কি আমাদেরও নয়! appeared first on Sangbad Pratidin.