shono
Advertisement
Indian Railways

গতি বনাম সুরক্ষা, দ্বন্দ্বের রেলযাত্রা

গত ৫ বছরে প্রতি মাসেই ৩টে করে দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে ভারতীয় রেল।
Published By: Kishore GhoshPosted: 09:36 PM Nov 17, 2024Updated: 09:36 PM Nov 17, 2024

এ-দেশে যাত্রীবাহী ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার। আর, দেশের ২% ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৭৫ কিমির উপরে। কাজেই গতির চেয়েও ঢের বেশি প্রয়োজন রেলের সুরক্ষা এবং নিয়মানুবর্তিতা। কিন্তু এর কোনওটাই যাত্রী-সুরক্ষাকে লঘু করে নয়। লিখছেন পার্থপ্রতিম বিশ্বাস 

Advertisement

পরীক্ষায় পড়ুয়াদের পাস-ফেল প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে একদা চর্চায় মশগুল ছিল বাঙালি। কিন্তু পরীক্ষা তো কেবল স্কুলে নয়, বরং জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ– সবকিছুতে পরীক্ষিত সত্যটাই স্থায়ী। ফলে, সেই পরীক্ষায় দেশের রেল কেন ফেল করছে বারবার– তা-ই হয়ে উঠেছে বহু মূল্যের প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি– দেশের আমজনতার গণপরিবহণ ভারতীয় রেলকে নিরাপদ ও জীবন্ত রাখার স্বার্থে।

সম্প্রতি, দেশের ‘তথ্য জানার অধিকার’ আইনে পাওয়া খবরে এসেছে যে, গত ৫ বছরে প্রতি মাসেই ৩টে করে দুর্ঘটনার মুখে পড়েছে ভারতীয় রেল। এই প্রেক্ষিতে, মানুষের সাম্প্রতিক স্মৃতি জুড়ে দগদগ করছে–বালাসোরের করমণ্ডল এক্সপ্রেস থেকে রাঙ্গাপানির কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, কিংবা চক্রধরপুরে মুম্বই মেল থেকে নলপুরের সেকেন্দ্রাবাদ এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় পড়ার মতো ভয়াবহ খণ্ডচিত্রগুলি। এমন ধারাবাহিক দুর্ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গে আশঙ্কা বেড়ে চলেছে প্রতিদিন সোয়া ২ কোটি মানুষের ট্রেনযাত্রার সুরক্ষা নিয়ে।

পরীক্ষায় রেল ‘পাস’ করবে, না, ‘ফেল’ করবে, তা নির্ভর করে রেলের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনার উপরে। ফলে পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ থাকলে সেখানে ফেল করা হয়ে ওঠে এক অনিবার্য পরিণতি। এ-দেশের সাম্প্রতিক রেল দুর্ঘটনার তিন-চতুর্থাংশ হচ্ছে লাইনচ্যুতির কারণে। লাইনচ্যুতি রুখতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন দশকের-পর-দশক ধরে ক্ষয়ে যাওয়া রেললাইনের পরিবর্তন, এবং নতুন লাইন পাতার কাজ। পুরনো বাড়ির মতো পুরনো রেললাইনের ভারবহনের ক্ষমতা কমতে থাকে– বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে। সেই নিরিখে প্রয়োজন, সেই দুর্বল রেলপথের নিয়মিত তদারকি ও প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যপরীক্ষা। এখন উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটেছে রেলের সিগন্যালিং এবং পয়েন্ট-ক্রসিং ব্যবস্থায়। রাস্তায় মোটরগাড়ির চালক স্টিয়ারিং হাতে যেভাবে দিক পরিবর্তন করতে পারেন, সেটা অসম্ভব ট্রেনের চালকের ক্ষেত্রে।

কার্যত, ট্রেনের চালক ট্রেন চালান সামনে থাকা সিগন্যালের সংকেত, এবং বিভিন্ন ক্রসিংয়ে প্রযুক্তিনির্ভর উপায়ে স্থির করে দেওয়া রেললাইনের উপর দিয়ে। আর, পয়েন্ট-ক্রসিং ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকে রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থা। ট্রেনের নিরাপদ-যাত্রা তাই মূলত নির্ভর করে রেলের সিগন্যাল, পয়েন্ট-ক্রসিং ব্যবস্থা এবং রেললাইনের হালের উপরে। এই ত্রয়ীর তদারকির জন্য যেমন চাই উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ, তেমনই চাই প্রতিটি যন্ত্রাংশের নিয়মিত তদারকিতে রেলের সুদক্ষ কর্মীবাহিনীর অভিজ্ঞতা। কেবল ড্রোন উড়িয়ে কিংবা রোবটের সাহায্যে এ-দেশের ১, ২৬,০০০ কিলোমিটার রেলপথের তদারকি সম্ভব নয়। প্রযুক্তিনির্ভর রেললাইন তদারকির জন্য বিশেষ কোচের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য– বেরিয়ে এসেছে দেশের সিএজি রিপোর্টে।

দুর্ভাগ্য, রেলের মতো গণপরিবহণে কর্মী সংকোচনের কারণে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনার ঝুঁকি। রেলে, এই মুহূর্তে, শূন্যপদের সংখ্যা ৩ লক্ষের বেশি, যার মধ্যে আবার সোয়া ১ লাখ কর্মী সরাসরি রেলের সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। উত্তরোত্তর রেলে কমে চলেছে স্থায়ীকর্মী নিয়োগ, বাড়ছে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মীদের রেল পরিকাঠামোর তদারকির কাজে নিয়োগ করা। প্রশ্নের মুখে পড়ছে কর্মীবাহিনীর দক্ষতা, দায়বদ্ধতা।
কর্মী সংকোচনের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণে উত্তরোত্তর বরাদ্দ হ্রাস– রেল দুর্ঘটনার অন্যতম ঝুঁকির কারণ। ২০২২-’২৩ সালে রেলের আয় ছিল ১.২ লক্ষ কোটি টাকা, যার ১৩.৫% খরচ হত পুরনো লাইন সরিয়ে নতুন লাইন পাতার কাজে। এ-দেশের জরাজীর্ণ রেলব্যবস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে এমন বিনিয়োগ প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই কম। মড়ার উপর খঁাড়ার ঘা মারার মতো ওই অপ্রতুল বরাদ্দ আরও কমে ২০২৪-’২৫ এসে দঁাড়িয়েছে ৯.৭ শতাংশে। ফলে, স্পষ্ট হচ্ছে যে, দেশের সরকারি নীতির ভুলের মাশুল দিচ্ছে রেল, নিত্য-নতুন দুর্ঘটনার জঁাতাকলে পড়ে। উল্টে রেলের উৎকর্ষের প্রতীকস্বরূপ সরকার তুলে ধরতে চাইছে ‘বন্দে ভারত’-এর মতো কিছু হাতেগোনা হাই স্পিড ট্রেনকে।

মনে রাখতে হবে, এ-দেশের যাত্রীবাহী ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের মতো। আর
দেশের ২% ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটারের উপরে। কাজেই দেশের আমজনতার চাহিদানুসারে,
গতির চেয়েও ঢের বেশি প্রয়োজন রেলের সুরক্ষা এবং নিয়মানুবর্তিতা। উত্তরোত্তর বেড়ে চলা যাত্রী-চাহিদা সামলাতে প্রয়োজন বাড়তি ট্রেন, চাই বাড়তি গতি। কিন্তু এর কোনওটাই যাত্রী-সুরক্ষাকে লঘু করে নয়।
দেশজুড়ে গালভরা বিজ্ঞাপন– ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’-র। অথচ ট্রেনের সুরক্ষায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে শম্বুক গতিতে। দেশসুদ্ধ মানুষের ধন্দ এখন সেই গতিমান ট্রেনের গতিমাহাত্ম্য নিয়েও।

কারণ ট্রেনের গতি যত উচ্চমাত্রায় যাবে, তত উচ্চগ্রামে পৌঁছবে যাত্রাপথে বিপদের ঝুঁকি। উচ্চগতির ট্রেন চলাচলের পথে সংঘর্ষরোধী প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন বাড়ছে। অথচ দেশের মোট ২% ট্রেন রুটে রয়েছে দুর্ঘটনা-রোধী ‘রক্ষাকবচ’। দেশের রেলপথ জুড়ে সংঘর্ষ-রোধী প্রযুক্তি প্রয়োগের তেমন ব্যয়বরাদ্দও নেই নতুন বাজেটে। এতদ্‌সত্ত্বেও দেশের মানুষের কাছে আধুনিক ভারতের বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন ফেরি করছেন প্রধানমন্ত্রী, এদিকে দেশজুড়ে চলা ট্রেন পরিষেবার হঁাড়ির হাল। নিয়ম করে ঘটে চলা রেলের দুর্ঘটনা এই অপ্রিয় সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করে।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক, নির্মাণ প্রযুক্তি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
drppb@yahoo.in

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • দেশের মোট ২% ট্রেন রুটে রয়েছে দুর্ঘটনা-রোধী ‘রক্ষাকবচ’।
  • এ-দেশের যাত্রীবাহী ট্রেনের গড় গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের মতো।
  • পরীক্ষায় রেল ‘পাস’ করবে, না, ‘ফেল’ করবে, তা নির্ভর করে রেলের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনার উপরে।
Advertisement