বিশ্বদীপ দে: একটা হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখেছিলাম আকাশ দিয়ে। সেই কপ্টারে বসেছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি একই ম্যাচে হাত দিয়ে গোল করে পরের গোলটা এমন করেন, তা ‘শতাব্দীর সেরা গোল’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সেবার মহেশতলায় ফুটবল অ্যাকাডেমি উদ্বোধন করতে এসেছিলেন দিয়েগো মারাদোনা (Diego Maradona)। খেলা ছাড়ার অতদিন পরেও তাঁর হেলিকপ্টার দেখতে সমস্ত বাড়ির ছাদে উঠে এসেছিলেন মানুষ। কিন্তু আটের দশক বা তারপরে যাদের জন্ম তাদের কাছে দিয়েগো মারাদোনা কেবলই এক ঈশ্বরের নাম। যারা মারাদোনাকে তাঁর স্বর্ণযুগে ‘লাইভ’ দেখেনি, তাদের কাছে শেষ পর্যন্ত তিনি বিগ্রহ। কিন্তু আমাদের একজন রাজাও আছেন। যিনি রক্তমাংসের। দেবত্বের ঘেরাটোপে নয়, সবুজ ঘাসে তাঁর টাটকা ফুটবল দেখেছি আমরা। দেখছি এখনও। মঙ্গলবার রাতে যে রূপকথা তিনি উপহার দিলেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে তা আরও একবার মনে করিয়ে দিল আমাদের রাজার নাম লিওনেল মেসি (Lionel Messi)। আমরা তাঁকে রাজা হয়ে উঠতে দেখেছি চোখের সামনেই।
২০০৬ থেকে ২০২২। মাঝে ষোলোটা বছর। ষোলো বছর একটা গাছ কিংবা গির্জার বয়সের হিসেবে কিছুই নয়। আবার বহু প্রাণীর গোটা জীবদ্দশা কেটে যায় এই সময়ে। খেলোয়াড়দের গোটা কেরিয়ার ধরে যায় এই সময়কালের ভিতর। প্রথম বিশ্বকাপ থেকে পঞ্চম বিশ্বকাপে এসে মেসি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় তুলে ধরেছেন তা কেবলই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। প্রথম ম্যাচে সৌদির কাছে হার। সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় মানুষের ধৈর্য প্রায় গোল্ড ফিশের (যার মনঃসংযোগ সবচেয়ে) রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই গুচ্ছ গুচ্ছ মিম ভেসে উঠল ফেসবুকের টাইমলাইনে।
[আরও পড়ুন: ‘পেনাল্টি গোল খুব কৃতিত্বের নয়’, মেসিকে খোঁচা তসলিমার]
কিন্তু এই মেসিকে নিয়ে এত চটজলদি কিছু বলাই মুশকিলের, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল পরের ম্যাচ থেকেই। আসলে ২০০৬ বিশ্বকাপের কিশোর মেসি থেকে আজকের স্থিতপ্রজ্ঞ চ্যাম্পিয়ন মেসির অনেক তফাত। ফলে প্রতিযোগিতা যত এগিয়েছে ততই ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছেন ‘হেটার’রা। যত সময় এগিয়েছে ততই ঝকঝকে হয়ে উঠেছেন এলএম১০। ৫টি গোল করে তিনিই আপাতত সর্বোচ্চ গোলদাতা এই বিশ্বকাপের। সঙ্গে অবশ্য এমবাপেও রয়েছে। পাশাপাশি পেলেকে টপকে বিশ্বকাপের নকআউটে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট, এবারের টুর্নামেন্টে সর্বাধিক চান্স ক্রিয়েট কিংবা ম্যান অফ দ্য ম্যাচ- সমস্ত রেকর্ডই মেসির নামে। সেই সঙ্গে বাতিস্তুতাকে টপকে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল।
কিন্তু এসব তো রেকর্ড বইয়ের জন্য। একটা সময়ের পর তা স্রেফ সাধারণ জ্ঞানের স্টক বাড়াতে কাজ দেবে। মাঠে জ্বলে ওঠা রংমশালগুলিই আসলে থেকে যাবে। থেকে যায়। সাধারণ মানুষ, হেরে যাওয়া মানুষের কাছে মেসি এমন এক মানুষ, যিনি তাঁদের হয়েও লড়াই করেন। আমরা কে চাইনি ওইভাবেই সমস্ত প্রতিকূলতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তরতর করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে? মঙ্গলবার আর্জেন্টিনার ওই তৃতীয় গোলের মতো।
[আরও পড়ুন: ‘এমবাপে-হাকিমির লড়াই দেখতে মুখিয়ে রয়েছি’, বলছেন তিন প্রধানের প্রাক্তন ফুটবলার ডগলাস]
রাতজাগা বাঙালি চোখ কচলে দেখেছে কী করছেন মানুষটা। কী খেলছেন! কীভাবে সম্ভব ওই জাদু প্রদর্শন? এই বিস্ময়, এই ম্যাজিকের জন্যই রাতজাগা। বিশ্বকাপ জেতা না জেতা সেটা অনেক পরের কথা। আপাতত কেবল মুহূর্তগুলিকে মনের কোণে সাজিয়ে রাখা। যা জীবনের অন্ধকার সময়েও আলো দেবে। মারাদোনা আমাদের হয়েও আমাদের নন। তিনি অনেক দূরের তারা। কিন্তু মেসি আমাদের সময়ের সন্তান। ভিড়ের মধ্যে চকিত পাস, আপাত নিস্পৃহ অবস্থা থেকে হঠাৎ ক্ষিপ্র দৌড়… এ পৃথিবী একবার পায় তারে। ছন্দহীন এক সময়ে দাঁড়িয়ে তোমাকে সেলাম ছন্দের জাদুকর।