প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট ফোটোগ্রাফার তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবিদের দিয়ে কথা বলাতে পারতেন। ভাল ছবির জন্য করতে পারতেন সবকিছু। প্যাশন ও অধ্যবসায়ে কখনও ঘাটতি পড়েনি। ‘সংবাদ প্রতিদিন’ ও ‘রোববার’ তাঁর ছবিতে চিরধন্য। লিখছেন ভাস্কর লেট।
‘শঙ্খবাবুকে শুইয়ে দিয়েছিলেন।’ সহকর্মীর মুখে প্রথম যখন এই বাক্যটি শুনি– তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে– আমাদের চলতি ডাকে ‘তারাদা’– স্তম্ভিত না হয়ে পারিনি। খবরের কাগজের চিত্রগ্রাহক মাত্রই
অল্পবিস্তর ডাকাবুকো হন। তা’ বলে এমন দাপট? প্রবাদপ্রতিম শঙ্খ ঘোষকে জমি ধরিয়ে দিয়েছেন!
বিষয়টা বলার মতো। ‘রোববার’-এর একটি সংখ্যার জন্য (‘কবিতার মুহূর্ত’) শঙ্খ ঘোষের ছবি তুলতে গিয়েছিলেন তারাদা। নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে-তুলতে একসময় মেঝেয় শুতে বলেন শঙ্খবাবুকে এবং সেই অবস্থায় ছবি তোলেন। এতটা অন্যরকমের ছবি পেয়ে সম্পাদকীয় দফতর আপ্লুত, আহ্লাদিত। স্যরকে পরে অনিন্দ্যদা জিজ্ঞেস করেছিল– কোনও অসুবিধে হয়নি তো! শঙ্খ ঘোষের সংক্ষিপ্ত ও সরস উত্তর ছিল– ‘শুইয়ে দিয়েছিলেন।’
‘রোববার’ পত্রিকার বহু বিখ্যাত সংখ্যা তারাদার ছবিলাঞ্ছিত চিরধন্য। আনকোরা ভাবনা ও অভিনব লেখাপত্তর ‘রোববার’-এর উল্কাসদৃশ উত্থানকে যদি ত্বরান্বিত করে, তাহলে তারাদার তোলা ছবি ‘রোববার’-কে দিয়েছিল তৃতীয় নয়নের উদ্ভাস। নিজের সব অভিজ্ঞতা, স্নেহ এবং সম-ভাবনা ‘রোববার’-কে উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি।
[আরও পড়ুন: বাংলার প্রত্যেক মা, বোন আমার পরিবার’, বারাসতের মঞ্চ থেকে দৃপ্ত ঘোষণা মোদির]
কেমন মানুষ ছিলেন? চুম্বকে, অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়ার পরে তারাদা আর কিছু চিনতেন না। ছবিবস্তু ও ক্যামেরা, মাঝে তখন যা কিছু আসছে– সব অনভিপ্রেত, দুচ্ছাই। তুঙ্গ প্যাশন ছিল, অমানুষিক জেদ ছিল, আর ছিল তীব্র একমুখিতা। সময়ে-সময়ে ছবির নেশায় তাড়িত হয়ে এতটাই এগিয়ে যেতেন– সম্পাদকীয় দফতর ফ্যাকাসে হয়ে যেত। একবার, ২৩ জানুয়ারি, ‘নেতাজি ভবন’ গিয়েছি তারাদা ও আমি। শিশুদের একটি অনুষ্ঠান ‘কভার’ করতে। কাজের পরে ভবনের মিউজিয়াম ঘুরে দেখছি। সঙ্গে নেতাজি ভবনের নিজস্ব লোকজন। ওখানে ছবি তোলা মানা। তারাদা কিন্তু হাতে ক্যামেরা ঝুলিয়ে গোপনে ছবি তুলে যাচ্ছেন। হালকা আওয়াজ শাটারের। কর্মীরা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সন্দেহের বশে, তারাদার ক্যামেরা বার দুয়েক পরীক্ষা করা হল। সব ক্লিয়ার, নির্দোষ। তবু ওই অস্বস্তিকর আওয়াজ থেকে-থেকেই হচ্ছে। বেরিয়ে এসে জানতে চাইলাম– ‘কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছিল ছবি না-তুলতে। তবু তুললেন, কেন?’ তারাদার সাফ জবাব: “এত ভয় নিয়ে সাংবাদিকতা ক’রো না। যে-সাংবাদিকের নামে রিপোর্ট হয় না, সে সাংবাদিক না কি!”
বলতে এখন অসুবিধা নেই, তারাদার লুকিয়ে তোলা ছবি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। আর, ‘নেতাজি ভবন’ থেকে ফোনও এসেছিল ভর্ৎসনা-বার্তা জানাতে। তারাদা সব শোনেন, এবং নির্বিকার গলায় বলেন– ‘ধুর’!
‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় চুটিয়ে কাজ করেছেন আমাদের প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে। এত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, একডাকে চিনত সকলে। তারাদা গল্প করতেন সত্যজিৎ রায়ের। উত্তমকুমারের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভার। রঘু রাইয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার। চোখ গোল-গোল করে শুনতাম। মেজাজি মানুষ ছিলেন। এই হয়তো খর গলায় কাউকে পঁাচকথা শুনিয়ে দিলেন, কিছু পরে তাকেই আবার ডেকে নিলেন খোশগল্প করার জন্য। নেশা ছিল না কোনও। সিগারেট বা অ্যালকোহল– দেখিনি কখনও স্পর্শ করতে। নানা ধরনের মরশুমি ফল খেতে ভালবাসতেন। মাঝে মাঝে নিয়েও আসতেন দফতরের জন্য কিনে। বয়সকে মোটে পাত্তা দিতেন না। টি-শার্ট ও জিন্স সম্বৎসর। শীতে এর উপরে বাহারি জ্যাকেট। বাইসেপ্স দেখিয়ে বলতেন– ‘দেখেছ, আমার হাতের গুলি!’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে যে-ভবনটি রয়েছে দক্ষিণ কলকাতায়, একবার সেখানে গিয়ে ছবি তোলার সময়, ওখানকারই মেম্বার এক প্রৌঢ়কে অবলীলায় তারাদা বলে দেন– ‘দাদু, চেয়ার ছেড়ে উঠে দঁাড়ান তো একটু! ওটায় উঠে আমি সিলিংয়ের দিকের কিছু ছবি তুলব।’ তারপর জুতো-সহ চেয়ারে উঠে ছবি তোলেন। ওই প্রৌঢ় ভূতগ্রস্ত প্রায়। একমাথা সাদা চুলের সমবয়সি কোনও মানুষ যে তঁাকে ভরা সভায় ‘দাদু’ বলতে পারেন– ভাবতে পারেননি।
[আরও পড়ুন:খড়গপুর রেল কলোনির উচ্ছেদ রুখতে আন্দোলনের নির্দেশ মমতার]
তারাদার তোলা ছবি এখনও ‘রোববার’ আর্কাইভের সম্পদ। প্রয়োজন হলেই আমরা সেগুলির দ্বারস্থ হই। এখনও নানা ইস্যু পরিকল্পনার সময় সখেদে বলে উঠি– ‘থাকত যদি তারাদা, এই সংখ্যাটা জমে যেত!’ এ-ই হল তারাদার ম্যাজিক। ‘রোববার’-এর সঙ্গে তঁার সান্নিধ্য ইনসেপারেবল, ফেভিকলের আঠার চেয়েও প্রবল আসক্তিতে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে। ঝিম-ধরা কোনও সন্ধ্যায়, বর্ষামুখর কোনও দুপুরে কখনও বা ভ্রম হয়– এই বুঝি গটগটিয়ে, ক্যামেরা বাগিয়ে, তারাদা ঢুকল এসে দফতরে। আর স্বভাবসিদ্ধ বেখাপ্পা গলায় বলে উঠল– ‘এখনও অ্যাসাইনমেন্ট রেডি হয়নি কেন?’