shono
Advertisement

Breaking News

শুধু তালিবান নয়, দূর করতে হবে তালিবানি মানসিকতাকেও

ভারতে অনেক গোষ্ঠী রয়েছে যারা তালিবানদের মতোই গোঁড়া মানসিকতা পোষণ ও প্রদর্শন করে।
Posted: 07:10 PM Aug 27, 2021Updated: 07:10 PM Aug 27, 2021

তালিবানকে প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই তালিবানি মানসিকতারও দূরীকরণ প্রয়োজন। সম্প্রতি আদালতের আদেশ অনুযায়ী, ভারত তালিবানি শাসনে নেই, কিন্তু এখানে স্ব-শৃঙ্খলারক্ষাকারী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা তালিবানদের মতোই গোঁড়া মানসিকতা পোষণ ও প্রদর্শন করে। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই

Advertisement

 

কজন ভারতীয় মুসলিমের পক্ষে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সাংবিধানিক’ হওয়া ভারি কঠিন। হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা সারাক্ষণ এমনভাবে ভারতীয় মুসলিমদের দুষ্ট ও ক্ষতিকারক রূপে দাগিয়ে রাখে যে, প্রত্যেকটি মুসলিমের কাছে আশা করা হয়, তারা প্রত্যেকটি ব্যাপারে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে বাধ্য ও বদ্ধপরিকর থাকুক। আবার, ঠিক অন্যদিকে, ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলি চায় প্রত্যেক মুসলিম তাদের কট্টর ধর্মীয় অস্তিত্ব দৃঢ়রূপে ঘোষণা করুক। এই উন্মত্ত ইসলামপন্থা ও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদের মাঝে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মুসলিমরা হয়ে পড়ে বিপন্ন ও ক্রমশ অধিকারচ্যুত। এর সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত মিলবে আফগানিস্তানে তালিবান সন্ত্রাসের অভিঘাতজনিত আলোড়নে। সেই দেশের ঘটনা এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ভাষ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে, অবশ্যই মুসলিম-ভীতির দিক দিয়ে।

হিন্দু দক্ষিণপন্থীরা চায় ভারতের মুসলিমরা তালিবানি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, তাদের স্বৈরিতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুক। কট্টর ইসলাম গোষ্ঠীগুলি চায় ভারতের মুসলিমরা আফগান জঙ্গিদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসাবে দেখুক এবং সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্বের জয়গান গাক। কোনওভাবে যদি কোনও মওলানা কিংবা মুসলিম কোনও জনপ্রিয় মুখ এমন কোনও কথা বলে ফেলে, যা আংশিকভাবে হলেও তালিবানের সমর্থনে যায়, সঙ্গে সঙ্গে ‘বলেছিলাম না, এরা এরকমই’ গোছের রব ওঠে। উল্টোদিকে, মুসলিম পরিচয়ের কেউ কোনওভাবে যদি আক্রান্ত হয় এই দেশে, তাহলে সমস্ত দোষ হিন্দু রাষ্ট্রের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে- সংখ্যালঘুদের প্রতি আসলে কোনও নজর নেই। উত্তরপ্রদেশ ও অসম, দুই রাজ্যে ইতিমধ্যে, দেশদ্রোহিতার মামলার দায় চাপানো হয়েছে সেইসব মানুষের উপর, যারা তালিবানকে সমর্থন করে কোনওরকম কথা বলেছে। লক্ষণীয়, দুই রাজ্যই বিজেপি-শাসিত। একটিতে সম্প্রতি নির্বাচন শেষ হয়েছে। আর-একটিতে পরবর্তী নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। বিষাক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেন সেই ফাটলকে আরও বড় করেছে।

[আরও পড়ুন: Kazakhstan Blast: কাবুলের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণে কাঁপল কাজাখস্তান, মৃত ৪ জওয়ান]

এই চিলচিৎকার ও বাগাড়ম্বরের মধ্যে যা আড়াল হয়ে পড়ে, তা হল কঠোর বাস্তব। যা ধর্মীয় মেরুকরণের কলুষিত রাজনীতির ফাঁপা আওয়াজ প্রকাশ্য করে দেয়। প্রথমে ওই তালিবান সমর্থকদের দিকে তাকানো যাক। প্রথমত, ঘটনা হল এই যে, তালিবান একটি হিংস্র জঙ্গি দল, যারা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করেছে, কোনও গণতান্ত্রিক উপায়ে নয়। বরং, বলপূর্বক। ইসলাম গোষ্ঠীর অটল ধারণা ও বিশ্বাস- তালিবান আফিগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সংঘবদ্ধ কামনার ফসল। পাশ্চাত্যের সুপার-পাওয়ার চালিত কাঠপুতলি-স্বরূপ প্রশাসন তারা চায়নি। কিন্তু এই ধারণা ভুল ও মারাত্মক। বন্দুক কখনও ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের কামনা’ কী হবে, তা নির্ধারণ করতে পারে না। বন্দুকের জোরে পাশতুন তালিবানকেই নেতৃত্বভার দিয়ে দেওয়া যায় না। পাশতুন তালিবান মানেই তো আফগানিস্তান, এমন নয়। কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে। তালিবানদের হাতে অন্যান্য সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব কে অর্পণ করল?

দ্বিতীয়ত, এই কথাটা জোর দিয়ে বলতেই হয় যে, অতীতের তালিবানি শাসনে যারা অত্যাচারিত হয়েছিল, তারা মূলত সহ-ধর্মের মানুষ। আফগানিস্তানে অতীতে মুসলিমরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার ক্ষমতায় তালিবানের প্রত্যাবর্তন করল বটে, কিন্তু সহ-নাগরিকরা কী করে ভুলবে যে, এরাই একদা চরম নিপীড়ন চালিয়েছিল। ফলে কেমন করেই বা এই তালিবানকে ‘ইসলামি ভ্রাতৃত্ব’-র প্রকৃত প্রতিনিধি ভাবা যেতে পারে?

তৃতীয়ত, তালিবান ইসলামের শরিয়তি আইন কঠোরভাবে বলবৎ করছে বলে যারা তাদের অতীতের দোষ সব ক্ষমা করা দিচ্ছে, তারা ভয়ংকর ভুল ধারণার মধ্যে বেঁচে আছে। ভারত ভূমিতে থেকে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার হয়ে তুমি গলা ফাটাবে, আবার সেই তুমি-ই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানিস্তানে শরিয়া প্রযুক্ত হল বলে উল্লাস করবে, এমনটা তো হতে পারে না! তার চেয়েও বড় কথা, সেদেশের মানুষজন এবং বিশেষত নারীদের জন্য শরিয়তি আইনের পরিকাঠামো তৈরি করার যাবতীয় গুরুদায়িত্ব তালিবানের হাতে দিলই বা কে? তালিবানের হয়ে কোনওরকম কৈফিয়ত দেওয়া মানেই ভারত ও আফগানিস্তানের মুসলিম সম্প্রদায় ও নাগরিকদের অধিকারের প্রতি তীব্র অপমান ও অবমাননা প্রকাশ।

এবার তাদের দিকে চোখ ঘোরানো যাক, যারা তালিবানদের অন্যায় কাজের জন্য ভারতীয় মুসলিমদের দোষী সাব্যস্ত করতে চায়। প্রথমত, তালিবানের পুনরুত্থান মৌলিকভাবে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, তা কোনওভাবেই ভারতের অস্বস্তিকর আন্তঃসম্প্রদায় সমীকরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। এর বিরুদ্ধে অাওয়াজ তোলার দায়িত্ব শুধু ভারতীয় মুসলিমদের নয়, বরং ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের, যারা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য শপথ গ্রহণ করেছে তালিবানদের বিরুদ্ধে সোচ্চারে আওয়াজ তোলার জন্য। তালিবানদের পুনরুত্থান কোনও ‘মুসলমান’ কেন্দ্রিক সমস্যা নয়, বরং আফগানিস্তানে শান্তিস্থাপনে বিশ্বব্যাপী বিপর্যয় ও ব্যর্থতার প্রতিফলন।

দ্বিতীয়ত, যারা চাইছে ভারতীয় মুসলিমরা প্রকাশ্যে তালিবানদের বিরোধিতা করুক, তারা পক্ষপাতহীন হয়ে মুক্তমন ও বিবেক নিয়ে বিতর্কে আসুক, যেখানে সকল ধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদ বর্জন করা হবে। কেউ-ই, উদাহরণস্বরূপ বলা যাক, ভারতের সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন সংঘ পরিবারের বংশজাত বজরং দলের ঘৃণাপূর্ণ এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপকে বৈধতা দিতে পারে না, এবং একইসঙ্গে তালিবানদের বিতাড়িত করার দাবি জানাতে পারে না। এ দেশে মুসলমান হত্যাকাণ্ডকে প্রয়োজন অনুসারে যুক্তিসংগত করার জন্য গোরক্ষা আইন বা ধর্মান্তকরণবিরোধী আইন বা তৎসহ ‘লাভ জিহাদ’ আইনের আড়াল নেওয়া হল, যে আইনগুলো তৈরিই হয়েছে সংঘ্যালঘুর উপর অত্যাচারের নিমিত্তে, তারপর তালিবানরা মানবাধিকার বিরোধী বলে শ্বাসরোধকারী ক্ষোভ প্রকাশও করা হল! এক মুখে দু’কথা সাজে না। সর্বজনীন মানবাধিকারকে আংশিকভাবে গ্রহণ বা বর্জন করা যায় না: তালিবানকে প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই তালিবানি মানসিকতারও দূরীকরণ প্রয়োজন। সম্প্রতি আদালতের আদেশ অনুযায়ী, ভারত তালিবানি শাসনে নেই, কিন্তু এখানে স্ব-শৃঙ্খলারক্ষাকারী গোষ্ঠী রয়েছে, যারা তালিবানদের মতোই গোঁড়া মানসিকতা পোষণ ও প্রদর্শন করে। বিষয়টা এটা নয় যে, ঠগবাজ অবৈধ গোষ্ঠীটি মূলধারার না চরমপন্থার, হিন্দু না মুসলিম। হিংস্র জনতার সামনে নিপীড়িত এবং নিপীড়কের পরিচয় অবশ্যই প্রতিটি ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হতে হবে।

তৃতীয়ত, তালিবানের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কঠোরতম নিন্দা জানানোর সময় এটা মাথায় রাখতে হবে যে, তালিবানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন অান্তর্জাতিক সামরিক জোট থেকে কিন্তু আসেনি, বরং এসেছে স্থানীয় অাফগান মানুষদের থেকে। মার্কিনি সেনারা যখন মরিয়ার মতো কাবুল থেকে জনজোয়ার অপসারণ করছে, তখন আফগানি সাহসী নাগরিকরা জীবনমরণ পরিস্থিতি সত্ত্বেও মাটি অঁাকড়ে পড়ে রয়েছে। তারা কি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পাওয়ার যোগ্য নয়? তারাও কি মুসলমান নয়, যারা একটি গোটা সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত ধ্যানধারণা ও ভাবাবেশগুলি ভেঙেছে?

[আরও পড়ুন: Afghanistan Blast: কাবুল বিমানবন্দরে বিস্ফোরণের নেপথ্যে পাকিস্তানের ‘মানসপুত্র’ ফারুকি!]

সেই কারণেই ইসলাম-বিরোধী ও তালিবান (Taliban) সমর্থক- দু’টি দলকেই প্রত্যাখ্যান করতে হবে আমাদের এবং গ্রহণ করে নিতে হবে এমন এক উদার মূল্যবোধ, যেখানে অন্ধকারের দিনগুলিতেও আলোর রেখা দেখা যায়। রাজনীতিবিদ এবং ধর্মীয় উপাসক উভয় গোষ্ঠীই তাদের সমর্থকদের ভয় ও আশঙ্কায় ধুয়ো দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে শাসন করতে চায়, কারণ তাদের দেওয়ার মতো এছাড়া আর কিছুই নেই। চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকট, কোভিড, বন্যা এবং মূল্যবৃদ্ধির সময়ে, আফগানিস্তানে তালিবানের মতো ‘শত্রু’-র দিকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি সুবিধাজনক। ধর্মীয় রাজনীতিকে গণবিভ্রান্তির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা একটি প্রাচীন ফাঁদ, যার বিরুদ্ধে চিন্তাশীল ভারতীয়দের সম্মিলিতভাবে লড়াই করতে হবে।

পুনশ্চ ১৪০-এরও বেশি ভারতীয় মুসলমান তালিবানের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছে ‘ইন্ডিয়ান মুসলিম্‌স ফর সেকুলার ডেমোক্রেসি’ মঞ্চে, সে দলে রয়েছে অভিনেতা, সাংবাদিক, অ্যাকটিভিস্ট ও আইনজীবী। দুঃখের কথা, তাদের বিবেকী কণ্ঠস্বর মিডিয়ায় খুব কম প্রশংসিত হয়, কিন্তু মুসলিম প্রভাবশালী প্রতিনিধিরা, যারা আক্রমণাত্মকভাবে তালিবান মানসিকতা রক্ষা করছে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদের শিরোনাম দখল করে নিচ্ছে! এখান থেকে প্রমাণিত হয়ে যায়, মিডিয়ার আপস করার পদ্ধতি কীরকম, কীভাবে এক ভঙ্গুর সমাজ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে, যেখানে ঘৃণাত্মক বক্তব্যের পল্লবিত হওয়ার জন্য একটি বড় নির্বাচনী ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement