ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: “ঘুম নেই কেন চোখে…”, বিখ্যাত গানটা মনে আছে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন পর্যাপ্ত ঘুমের ঘাটতি শৈশবেই ভেস্তে দেয় সুস্বাস্থ্যের ফর্মুলাকে। শিশুর মনোযোগ থেকে শুরু করে স্মৃতিশক্তি, এমনকী আবেগও হয় ক্ষতিগ্রস্ত। আবার মহিলাদের শারীরবৃত্তীয় কারণেই দরকার পুরুষের থেকে বেশি ঘুম। ঘুমের দফারফা মানেই হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় চূড়ান্তভাবে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক অবনতি। ধীরে ধীরে এই ঘুমের ঘাটতিই লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে গোটা প্রজন্মকে ঠেলে দিচ্ছে ক্যানসারের (Cancer) দিকে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রঞ্জন ভট্টাচার্যর কথায়, “রাত আটটা বাজলেই মস্তিষ্কের ঠিক পিছন থেকে মেলাটোনিন রাসায়নিক নিঃসরণ শুরু হয়। চলে রাত এগারোটা পর্যন্ত। সেই সময়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লেই ক্রমশ ঘুমের দেশে। আর ঘুম ভাঙবে ঠিক আট ঘণ্টা পর। অর্থাৎ শরীর ঠিক করে রাখে কখন ঘুমের সময়। কিন্তু এখন নগরজীবন থামে রাত আড়াইটে তিনটে নাগাদ। এরপরে ঘুম। ঘুম ভাঙতে বেলা দশটা। ফলে শরীরের উপর হামলা করা হয়। তার ফল হাতেনাতে মিলছে।”
সার্বিক স্বাস্থ্যের লক্ষ্যেই লিঙ্গ ও বয়স নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান ঘুম-ই হল এ বছরের বিশ্ব ঘুম দিবসের থিম। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায় না বলে আক্ষেপ করছেন রঞ্জনের মতো চিকিৎসকরা। ‘মহিলারা মাল্টিটাস্কিং পুরুষদের চেয়ে বেশি ভালো করেন বলেই তাঁদের দশভুজা বলা হয়। এর জন্য মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর নেটওয়ার্কের পরিশ্রমও বেশি হয়। সে জন্যই গড়ে পুরুষদের চেয়ে রোজ ১১ মিনিট বেশি ঘুম দরকার মহিলাদের। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অধিকাংশ পরিবারেই সেটা হয় না সাধারণত।’ চিকিৎসকরা বলছেন, মহিলারাই শুধু নয়, আজকাল শিশুদেরও ঘুমের মানও খারাপ, ঘুমোয়ও কম সময়।
[আরও পড়ুন: ঋতাভরীর হোলি পার্টনার জাভেদ আখতার! বাংলার কী কী বিষয়ে কথা হল? ]
চিকিৎসকদের বক্তব্য, মহিলাদের রাতের ঘুম খারাপ হওয়ার কারণেই তাঁদের মধ্যে আজকাল ক্লান্তি, উদ্বেগ, অবসাদ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা যায় যা আখেরে জৈব ঘড়ির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে হার্টেরও সমস্যা তৈরি করে। পরিসংখ্যান বলছে, মেনোপজ়ের পরে ৩৮-৬০% মহিলাই অনিদ্রার শিকার হন। ফলে ঋতুচক্রের সমস্যা, দেরিতে সন্তান, ওভারিয়ান সিস্ট-এর মতো সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্রে কর্মরত মহিলাদের মধ্যে কম ঘুমের জন্য নানাবিধ সমস্যা দ্রুত বাড়ছে। মার্কিন মুলুকের সিলিকন ভ্যালির সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আগের মতো আজকাল আর শহুরে শিশুরা কেউ-ই রাত ১০টায় ঘুমোয় না। অধিকাংশই বাবা-মায়ের কারণে লেট-নাইট করে। আবার স্কুলের জন্য ভোরে উঠতে হয়। স্লিপ ডিউরেশন এবং স্লিপ কোয়ালিটি, দুটোর অবনতি হওয়ার ছাপ স্বাভাবিক ভাবেই পড়ে তাদের শরীরে। ফলে আগামী প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে গুচ্ছ শারীরিক-মানসিক সমস্যাকে সঙ্গী করেই। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-অ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডারে (এডিএইচডি) ভোগা শিশুদের অর্ধেকেরও বেশি আদতে ঘুমের ঘাটতির শিকার।
তবে ঘুমের ঘাটতি যে ভবিষ্যতে ক্যানসারেরও জন্ম দিতে পারে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। তাঁদের অভিমত, ‘দীর্ঘ দিন ধরে অপর্যাপ্ত ঘুম হলে ক্যানসার-সহ বেশ কিছু রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটাই বেড়ে যায়। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, টানা অপর্যাপ্ত ঘুমের ফলে শরীরের ইমিউনিটিও কমে যায় এবং ক্যানসার, ডায়াবিটিস, এমনকী হৃদরোগের মতো অসুখে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকটা বেড়ে যায়। এর মধ্যে স্তন, কোলন, ডিম্বাশয় ও প্রস্টেট ক্যানসারই বেশি। রাতে আলোর প্রভাবে জৈব ঘড়ি এলোমেলো হয়ে যাওয়া এবং লাগাতার মেলাটোনিন হরমোনের ক্ষরণ কমে গিয়েই এই বিপত্তি দেখা দেয়।