shono
Advertisement

Breaking News

বিহার গেল, বাংলায় আদৌ জোট চায় কংগ্রেস হাইকম্যান্ড?

‘ইন্ডিয়া’-র শেষ বৈঠকে দ্রুত আসন রফা শেষ করার কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
Posted: 02:03 PM Jan 31, 2024Updated: 02:08 PM Jan 31, 2024

অভিষেক বন্দ্যোপাধায় জোট না-হওয়ার জন্য সরাসরি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে দায়ী করেন। তাঁর বক্তব্য, বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি তুলছেন অধীরবাবু। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তিনি সিবিআই-ইডির পক্ষ নিচ্ছেন। কার্যত বিজেপির ‘বি টিম’-এর মতো কাজ করছেন। এর পর জোট হবে কীভাবে? কলমে কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

নীতীশকুমার যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে ‘জয়প্রকাশ নারায়ণ’ হতে পারবেন না, সে-কথা অনেক দিন আগেই এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। পাটনায় বিরোধী দলের প্রথম কনক্লেভের আহ্বায়ক ছিলেন স্বয়ং নীতীশ। তিনি তখন কট্টর বিজেপি-বিরোধী। তদুপরি কেন এ-কথা বলেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক? তাঁর মূল‌্যায়ন ছিল, ‘নীতীশ কুমার বরাবর আনপ্রেডিক্টেবল। লালুর সঙ্গে থেকেও বিজেপিতে তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। কেউ তাঁকে বিশ্বাস করে না। ফলে সবার আগে উনি জোট ছেড়ে চলে যেতে পারেন।’

সোমবার দেখলাম নীতীশের পঞ্চমবারের ডিগবাজি নিয়ে অভিষেকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছেন সাংবাদিকরা। জবাবে খানিক স্মিত হেসে তৃণমূলের যুবক নেতা বললেন, ‘নীতীশ কুমারের বয়স আমার বয়সের দ্বিগুণ। আমি ওঁকে নিয়ে কী আর বলব।’ হক কথা বলেছেন। নীতীশ এই দফায় যা করলেন তাতে সত্যি কারও কিছু বলার নেই। রাজনীতির সাড়ে বত্রিশ ভাজা হয়ে গিয়েছে একা তাঁর কেরিয়ারেরই। দেড় বছর আগে লালুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবন চলে যাবে তবু এনডিএতে ফিরব না।’ বেমালুম হজম করে ফেললেন সে-কথা। এই নীতীশ কুমারদের জন্যই ভারতের রাজনীতি ক্রমশ ডাস্টবিনে নিমজ্জিত। বড্ড দুর্গন্ধ। জনরায় ধূলায় গড়াগড়ি খায়। 

রাজনীতিকদের একটি অংশ কম-বেশি সুবিধাবাদী। নিজের জমি গদি ঠিক রাখতে দলবদল, জোটবদল, এমনকী, নীতি-আদর্শ বদল করে থাকে। মানুষ এসব মেনে নিয়েই ভোট দেয়। সেই সুযোগে নীতীশ কুমারের দলবদল নাট্যশিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। আগামী দিনে নীতিহীনতা কাকে বলে জানতে হলে হয়তো বলা হবে– নীতীশ কুমারের জীবনী পড়ুন। মুদ্রার অপর পিঠও আছে। রাজনীতির সম্পূর্ণ পাঠ নিতে গেলে উল্টোদিকের সমীকরণকেও কখনও কখনও গুরুত্ব দিতে হয়।

[আরও পড়ুন: ‘সুশাসনবাবু’-র ট্রাপিজ! পঞ্চমবার শিবির বদলে নবমবারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ]

নীতীশ বিহার রাজনীতিতে এত অপরিহার্য কেন? তাঁর তো বিশাল কিছু ভোট ব্যাঙ্ক নেই। তবু কখনও বিজেপি, কখনও আরজেডি তাঁকেই বরণ করে নেয় কেন? কেন অমিত শাহর মতো নেতা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দরজা বন্ধ করার পরও তা খুলে দেন? কেনই-বা চাচাকে ‘৪২০’ বলার পরও লালুপুত্র তেজস্বী ধরতে যান সেই নীতীশেরই হাত? কেন বিজেপি আরজেডির চেয়ে অনেক কম বিধায়ক জেডিইউর থাকা সত্ত্বেও নীতীশই বার বার মুখ্যমন্ত্রীত্ব পান? জরুরি প্রশ্ন। উত্তর পাটলিপুত্রে।

তবে এ-ও বোঝা গেল যে, শুধু নীতীশেরই নয়, নীতি নেই বাকি দলগুলোরও। ক্ষমতার জন্য তারা সুযোগ পেলেই পাল্টিবাজিকেই আঁকড়ে ধরে। সেই সুযোগে দাবার বোড়ে হয়ে নীতীশ কুমার বিহার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। শুধু শিবির বদল নয়, মুখ্যমন্ত্রী পদে এক ব্যাক্তি নবার শপথও বিশ্বরেকর্ড হয়তো।        

বিরোধী জোটের মাথা কংগ্রেস। তাঁরাও নীতীশকে আটকে রাখতে পারল না। ভোটের মুখে ধাক্কা খেল কংগ্রেসের নেতৃত্ব। নীতীশও তাঁর শিবির বদলের জন্য কংগ্রেসকেও দুষেছেন। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সংকট অবশ্য বিহারে থেমে নেই। বাংলায় এখনও পর্যন্ত যা চিত্র তাতে জোট হচ্ছে না। পাঞ্জাবে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে কেজরিওয়াল। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব ১১ আসন কংগ্রেসকে ছেড়ে দিয়ে বলেছেন, এর বেশি আসন হবে না। অর্থাৎ, ‘ইন্ডিয়া’-র যে সুখী পরিবারের ছবিটা কদিন আগেও দেখা যাচ্ছিল, তা অস্তমিত। 

এর দায়িত্ব কংগ্রেসকেই নিতে হবে। বড় শরিক হয়েও নেতৃত্ব দিতে তারা ব‌্যর্থ। বিহারে জোটে ধাক্কার পর বাংলাতেও একা চলার ঘোষণা করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল ৪২ আসনেই প্রার্থী দিচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত একতরফা নয়। নেপথ্য-ভাষণ অনেক। দ্রুত আসন বণ্টন শেষ করার কথা বলছিলেন তৃণমূল নেতারা। কিন্তু কংগ্রেস হাইকম্যান্ড আদৌ কি তৎপর ছিল? তবু তাদের জন্য দুটি আসন অর্থাৎ মালদহ দক্ষিণ ও বহরমপুর ছেড়ে দেন মমতা। তৃণমূল নেতৃত্বের যুক্তি ছিল, রাজ্যে কংগ্রেসের তেমন শক্তি কই! ২০১৯ সালের পরিস্থিতিও নেই। রাজ্য বিধানসভায় কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা শূন্য। তাদের হাতে থাকা দুটি লোকসভার মধ্যে তৃণমূলের অনেক বিধায়ক রয়েছে। তবু জয়ী আসনের নিরিখে মালদহ দক্ষিণ ও বহরমপুর ছাড়া হল। এর বাইরে কোনও আসন চাওয়ার যোগ্যতা কংগ্রেসের নেই।

এই প্রস্তাব উড়িয়ে প্রদেশ নেতৃত্ব হাইকম‌্যান্ডকে জানিয়ে দেয়, দশটির অধিক আসন তাদের দিতে হবে। এমন সব আসনের নাম বলা হয় যেখানে পুরসভা পঞ্চায়েতে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছে। তৃণমূল নেতৃত্ব তখনই বুঝে যায়, বাংলার কংগ্রেস নেতাদের বড় অংশ জোট চান না বলেই এমন উদ্ভট দাবি তুলছেন। তাছাড়া প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরব তারপর জোট কি আদৌ সম্ভব? অভিষেক বন্দ্যোপাধায় জোট না হওয়ার জন্য সরাসরি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীকে দায়ী করেন। তাঁর বক্তব্য, বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দাবি তুলছেন অধীরবাবু। তৃণমূলের বিরুদ্ধে তিনি সিবিআই-ইডির পক্ষ নিচ্ছেন। কার্যত বিজেপির ‘বি টিম’-এর মতো কাজ করছেন। এর পর জোট হবে কীভাবে? তৃণমূল নেতৃত্ব আরও লক্ষ করেছে, আসন রফা নিয়ে কংগ্রেস দিল্লিতে নীরব। কোনও আলোচনার প্রস্তাব তারা দেয়নি। তাগিদও লক্ষ করা যায়নি।

‘ইন্ডিয়া’-র শেষ বৈঠকে দ্রুত আসন রফা শেষ করার কথা বলা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উগ্র তৃণমূল বিরোধিতা বন্ধ করতে প্রদেশ নেতাদের হুঁশিয়ারি দেয়নি হাইকম‌্যান্ড। বরং অধীরবাবুকে পাশে নিয়েই রাজ্যে তাঁর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ করেছেন রাহুল গান্ধী। তাঁকে যদি রাহুল বলতেন মমতা অথবা তৃণমূল সরকারকে আক্রমণ করা যাবে না, জোটকে প্রাধান্য দিতে হবে তাহলে অধীর চৌধুরী মানতে বাধ্য ছিলেন। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি বোঝা যাচ্ছে। এর থেকে এই সন্দেহ জাগে যে, বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতা আদৌ চাইছে না কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। 

জোট না-হওয়ার পিছনে সিপিএমের অদৃশ্য হাত দেখছে অনেকে। কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হলে বেকায়দায় পড়ে যাবে সিপিএম। কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে তারা চলতে চাইছে। মূল লক্ষ‌্য, মুসলিম ভোটের বিভাজন। যেটা ২০২১ সালে তৃণমূল একচেটিয়া পেয়েছিল। তাতে এবার ভাগ বাসানো। কিন্তু মুসলিম ভোট ভাঙলে তো লাভ হবে বিজেপির। সেই প্রেক্ষিতেই মমতা ৪২ আসনে একা লড়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিলেন। এত দিন জোট না করেই লড়ে জিতে এসেছেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী হতেই পারেন। কিন্তু জোট না-হওয়ায় কংগ্রেসের লাভ তো কিছু হচ্ছে না। সিপিএম তাদের এমন সমর্থন রাজ্যে কোথাও দিতে পারবে না যাতে লোকসভা আসন জিতে ফেলা যায়। কিন্তু তৃণমূল পাশে থাকলে অনেক লাভ। উল্টে জোট না-হওয়ায় মালদহ দক্ষিণ ও বহরমপুরে তৃণমূল প্রার্থীর কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ডালুবাবু-অধীরবাবুদের।

মনে রাখতে হবে, অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের পর অনেক প্রেক্ষাপট বদলে গিয়েছে। বিজেপি যেমন মেরুকরণ চাইছে, তেমন এবার সংখ্যালঘু ভোট এক বাক্সে পরার সম্ভাবনা। যে শক্তিশালী, সে ভোট পাবে। এক সিনিয়র তৃণমূল নেতা ভাল ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর কথায়, “মমতাকে এখনও বিশ্বাস করে সংখ্যালঘুরা। তাঁর সমর্থন পেলে দুটি সংখ্যালঘু আধিক্য আসনে লাভ হত কংগ্রেসের। কিন্তু বাকি আসনে কংগ্রেসের যেটুকু ভোট আছে আমরা কি পেতাম? যেভাবে এবং যতটা বিরোধিতা প্রদেশ থেকে করা হল, তার পরও?”

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement