দিনভর গঙ্গায় প্রতীক্ষাশেষে দু’-একটা ইলিশ জালে পড়লে সেই নাকি অনেক! এখন গঙ্গায় ইলিশ মেলে না, রূপনারায়ণেও নয়। কোলাঘাট খটখটে। ইলিশের ঠিকানা এখন ডায়মন্ডহারবার ও দিঘা- স্বাদে, গন্ধে ও ওজনে ওপারের সঙ্গে যার তুলনাই হয় না! ইলিশকে ভালবেসে তার সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সর্বস্তরে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে, এপারে সেই উদ্যোগ ও ঐকান্তিকতার ছিটেফোঁটাও দৃশ্যমান নয়। তাই দিনান্তে আমরা পদ্মা-মেঘনার উপহারের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকি আর প্রকৃতিকে দোষ দিই। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মুত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে-ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার
সরস শর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।
–ইলিশ, বুদ্ধদেব বসু
কোভিডের ছোবল সামলিয়ে দু’বছর পর দিন কয়েকের জন্য কলকাতা এলাম। এ-আসা অতীতের আর পাঁচটা আসার মতো নয়।
‘তুমি এলে, অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’-র মতো বুক ফুলিয়ে বলার মতো। আমিও এলাম, ইলিশও এল! আহা কি অপূর্ব সমাপতন! যদিও অগৌরবের।
[আরও পড়ুন: তালিবানের উত্থানে দুনিয়াজুড়ে ফের বাড়ছে সন্ত্রাসবাদ! তবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করাটাই সভ্যতা]
কয়েকটা বাজার ঘুরলাম। পরিচিত গৃহে ঢুঁ মারলাম। বৃষ্টি-বিবর্ণ কলকাতায় সর্বজনীন ইলিশ-উৎসবের বদলে চোখে পড়ল নব্য ধনীর গর্বিত উল্লাস, ছাপোষা আটপৌরে বাঙালির আক্ষেপজনিত হা-হুতাশ, মধ্যবিত্তীয় নোলা-সর্বস্ব লোভীর অক্ষম দৃষ্টিপাত ও দরিদ্রের অনুচ্চ হাহাকার। ভরা আশ্বিনে প্রলম্বিত টইটম্বুর বর্ষায় রসনাপ্রিয় আম-বাঙালি চনমনে হওয়ার বদলে স্মৃতি-বেদনাতুর। অতীতবিলাসী। উমার মতো ইলিশকেও তারা বরণ করেছে কিন্তু ঘরে তুলতে পারেনি।
হায়, কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ এখন অতীত এবং পরনির্ভরতার প্রতীক!
খবরের ফেরিঅলাদের কাছে ঘনঘোর বর্ষায় ‘ইলিশ অদর্শন’ ইদানীং আলোচনার মধ্যমণি। ইলিশের অপ্রতুলতা সংক্রান্ত বিজ্ঞজনদের কাটাছেঁড়ায় বাঙালির মন ভারাক্রান্ত।
‘হা ইলিশ, কোথা ইলিশ’ আর্তনাদের মাঝে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, নদী-সমুদ্রের চঞ্চলমতি নাব্যতা হ্রাসে ইলিশের গতিপথ সংকুচিত হওয়া ইত্যাদি তথ্য বাঙালিকে অতৃপ্ত করে। সেসব প্রতিবেদন পড়ি আর ভাবি, ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’-এর মতো কেন কেউ দৃপ্তকণ্ঠে বলে না, প্রকৃতির মার ইলিশ-অদর্শনের একমাত্র কারণ নয়, বরং ভাবের ঘরে চুরির নির্ভেজাল উদাহরণ।
এই বঙ্গে ইলিশ-অনুপ্রবেশ বন্ধ হওয়া সমাজ, সরকার ও বঙ্গবাসীর নিদারুণ ব্যর্থতার চূড়ান্ত নিদর্শন। মানুষের অসাফল্যের দায় প্রকৃতির উপর চাপানো শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও। এ কথাটা এত জোরের সঙ্গে বলছি, কারণ, মারটা প্রকৃতির হলে এপারের মতো ওপারও রেহাই পেত না। ইলিশকে ভালবেসে তাকে বাঁচাতে যা যা করা দরকার ওপার বাংলাই করেছে। আমরা পারিনি। ওরা পেরেছে বলে তৃপ্ত। সমৃদ্ধ। আমরা পারিনি বলে পরমুখাপেক্ষী।
শুধু পারিনি বলাটাই সব নয়, বলা দরকার ‘পারার মতো পারা’-র জন্য যে ভালবাসা ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন, সরকার ও জনগণের যে তাগিদ থাকা দরকার, তার ছিটেফোঁটাও আমরা দেখাতে পারিনি। আমরা যা করেছি তা অকাজের। খাবলা মারার মতো। লোকদেখানি। দায়সারা। তাই, ফি বর্ষায় আমরা চাতক পাখি হয়ে চেয়ে থাকি ওপারের দিকে। উমা আবাহনের মতো বরণ করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাঠানো পুজো উপহার, হাজারে হাজারে ইলিশের শব!
এপারে ইলিশের বাৎসরিক উৎপাদন এখন কোন তলানিতে ঠেকেছে জানা নেই। কোনও সরকারি তথ্য চোখে পড়েনি। শুনি, দিনভর গঙ্গায় প্রতীক্ষাশেষে দু’-একটা জালে পড়লে সেই নাকি অনেক! এখন গঙ্গায় ইলিশ মেলে না, রূপনারায়ণেও নয়। কোলাঘাট খটখটে। ইলিশের ঠিকানা এখন ডায়মন্ডহারবার ও দিঘা- স্বাদে, গন্ধে ও ওজনে ওপারের সঙ্গে যার তুলনাই হয় না! পদ্মা-মেঘনার উপহারের জন্য তাই এত হাপিত্যেশ করে বসে থাকা।
এ-বাংলায় ইলিশের আজ যা হাল, প্রায় তেমনই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ও-বাংলায়, এই শতাব্দীর গোড়ায়। ২০০১-’০২ সালে বাংলাদেশে ধরা পড়া ইলিশের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল দু’লক্ষ টনেরও কম। দু’বছর পর তা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টনে। দেখা যায়, শুধু পরিমাণ নয়, মাপেও খাটো হয়েছে ইলিশ। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিরল। সরকারের টনক নড়া তখনই শুরু। শুরু হয় গবেষণা ও ‘ইলিশ বাঁচাও অভিযান’। গড়ে তোলা হয় ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’। বাস্তবায়ন শুরু ২০০৫ সাল থেকে। ফল আজ হাতেনাতে। ১৫ বছরে বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। এখন দেশের মোট সোয়াশো নদীতে ইলিশের আনাগোনা। বাৎসরিক উৎপাদন ছ’লক্ষ টনের কাছাকাছি। দেড় দশক আগে বাজার দাপাত ‘খোকা ইলিশ’, আজ উলটো পিরামিড। বাজার ছেয়ে আছে দেড়-দু’কেজির ইলিশে। ছোট ইলিশ দুয়োরানির সন্তানের মতো অবহেলিত।
ওরা কেমনভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেছে, আর আমরা কী করছি বা করার ভান করছি; আমাদের কতখানি খাতায়-কলমে, কতটা বাস্তবায়িত, কতটাই বা আন্তরিক, সেই ফারাক অবিশ্বাস্য!
বাংলাদেশ তাদের অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে বিজ্ঞানসম্মতভাবে। পদ্মা, মেঘনা ও তাদের শাখানদীগুলোয় যেখানে মা ইলিশ ফি বছর ডিম ছাড়ে, সেখানে গড়ে তুলেছে সাত হাজার বর্গ কিলোমিটারের পাঁচটি অভয়াশ্রম। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জুন এই অভয়াশ্রমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। মার্চ-এপ্রিলে সেখানে নিষিদ্ধ সব ধরনের মাছ ধরা। ওই সময় খোকা ইলিশ কিছুটা বড় হয়ে ফিরে যায় সমুদ্রে। অক্টোবরে কোজাগরী পূর্ণিমার আগুপিছু দেশ জুড়ে ২২ দিন ইলিশ মাছ ধরা ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এবছর সেই নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে ৪ অক্টোবর থেকে। হাসিনার সাড়ে চার হাজার টন উপহারের রপ্তানি ওই সময়ের মধ্যেই সারতে হবে। সেটা অসম্ভব বলে ওপারের ইলিশ ব্যাপারীরা নিষেধাজ্ঞার সময় কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। না হলে ভরসা দেশের বাজার।
সংরক্ষণের কিছু ব্যবস্থা এপারেও যে নেওয়া হয়নি তা নয়। কিন্তু প্রধানত তা খাতায়-কলমে। নিয়ম থাকলেও নিয়ম না মানা এখনও দস্তুর। যাঁরা ইলিশের উপর নির্ভরশীল, নিষিদ্ধ সময়ে তাঁদের জীবনধারণের বিকল্প উপায় ভাবা হয়নি। অথচ বাংলাদেশ ইলিশ-নির্ভর জেলেদের তালিকা তৈরি করেছে। তাদের পরিচয়পত্র দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার সময় পরিবারপিছু বিনামূল্যে ৪০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। কোথাও হাঁস-মুরগি, ছাগল, ভ্যান রিকশা অথবা সেলাই মেশিন।
ইলিশ সংরক্ষণ প্রচারকে তারা গণ আন্দোলনের রূপ দিয়েছে। শামিল করেছে সরকার, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও কোস্ট গার্ডদের। বছরভর সারা দেশের শহর-গ্রামে প্রচার চলে। বিরামহীন। আইন ভাঙলে মাছ, নৌকো, ট্রলার বাজেয়াপ্ত হয়। জাল পোড়ানো হয়। জেল-জরিমানা হয় বিক্রেতা ও ক্রেতা দু’পক্ষেরই।
পশ্চিমবঙ্গে খোকা ইলিশ ধরা পড়লে অর্ধেক বাজেয়াপ্ত হয়, ওখানে পুরোটাই। বিলানো হয় অনাথাশ্রমে। এই কড়াকড়ির ফল? ‘ওয়ার্ল্ডফিশ’-এর তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশে উৎপাদিত হত বিশ্বের ৬৫ শতাংশ ইলিশ, ভারতে ২২ শতাংশ। আজ বাংলাদেশে হচ্ছে ৮৬ শতাংশ, ভারতে মাত্র ১০! পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশে গড় ইলিশের ওজন ছিল ৬০০ গ্রাম, আজ কেজি ছুঁইছুঁই!
বাংলাদেশে ইলিশ বিপ্লবের জনক অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব। এ বাংলার ইলিশ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ঘনিষ্ঠ। তবু এই বঙ্গে ইলিশ নিরুদ্দেশ। কারণ, ইলিশকে ভালবেসে তার সংরক্ষণে ওপারের সরকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সর্বস্তরে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছে, এপারে সেই উদ্যোগ ও ঐকান্তিকতার ছিটেফোঁটাও দৃশ্যমান নয়। প্রকৃতিকে দোষ দিয়ে ও হা-হুতাশ করে ওপারের করুণায় এপারের বেঁচে থাকা, যা অগৌরবের ও গ্লানিময়।
মডেল নাগালের মধ্যেই। প্রয়োজন দুই বাংলায় একই সঙ্গে তারিখ মিলিয়ে তার রূপায়ণ। ইলিশকে ভালবেসে স্রেফ ইলিশের জন্য নড়েচড়ে বসলে ওপারের মতো এই বঙ্গের ঘরে ঘরেও মিলবে সরস সরষের ঝাঁজ। হাসিনা-নির্ভরতা কাটিয়ে তখন গর্বের সঙ্গে আমরাও বলতে পারব, ‘দুয়ারে ইলিশ।’