মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলির পক্ষে জোর সওয়াল চালিয়ে যাচ্ছেন। আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মার্কিন স্বপ্ন নয় শেষ হল, কিন্তু এখন পাকিস্তান সম্পর্কে কী হবে মার্কিন নীতি? আমেরিকার সঙ্গে যারা কুড়ি বছর ধরে আফগানিস্তানে ‘ওয়ার অন টেরর’-এ অংশ নিল, তারাই আবার তালিবানের স্রষ্টা ও সবচেয়ে বড় মদতদাতা। পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখন দেখতে হবে ভারতকে। ভারত সঠিকভাবেই ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি নিয়ে চলছে। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
আফগানিস্তান (Afghanistan) কোন পথে, তা এখনই চূড়ান্তভাবে বলার সময় আসেনি। সোভিয়েত চলে যাওয়ার পর যে গৃহযুদ্ধ হিন্দুকুশ পর্বতমালার কন্দরে কন্দরে দেখা গিয়েছিল, এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না, বলা যাচ্ছে না। আফগানিস্তান সম্পর্কে বলা হয়, এখানে সব সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘটেছে। ব্রিটিশরা পারেনি, সোভিয়েত হেরে গিয়েছিল, আমেরিকাও হারল। আফগানিস্তানের পঞ্জশির নাকি সেই উপত্যকা, যেখানে কোনও শক্তি কখনও জয়ের মুখ দেখেনি। সেই পঞ্জশির তালিবানদেরও ‘ওয়াটারলু’ হবে কি না, তা ভবিষ্যৎই বলবে। কয়েক দিন আগেই ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর লেখক ও সাংবাদিক টমাস ফ্রিডম্যান তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যখন বড় বড় ঘটনা ঘটে, তখন সবসময় একটি সকালের সঙ্গে তার পরের সকালটির মধ্যে পার্থক্য করতে হয়। কারণ, প্রতিটি সকালেই এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হয়, যা ইতিহাসে ছাপ রাখে এবং শক্তির ভারসাম্যকে নির্দয়ভাবে জাহির করার চেষ্টা করে।’ অর্থাৎ, ফ্রিডম্যানের মতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দ্রুত সেনা প্রত্যাহারের নীতি যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তা এখনই আফগানিস্তানের পরিপ্রেক্ষিতে বলার সময় আসেনি।
[আরও পড়ুন: CIA-Taliban meet: কাবুলে তালিবানের সঙ্গে গোপন বৈঠক সিআইএ প্রধানের, তুঙ্গে জল্পনা]
ভারত সঠিকভাবেই ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি নিয়ে চলছে। তালিবানের সঙ্গে সম্পর্কটা কী হবে, তা ঠিক করতে ভারতের উচিত আরও অনেকটা সময় নেওয়া। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন। সরকার সেখানে সব দলের মতামত শুনবে। সর্বদলীয় মতামত যাই হোক, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে টমাস ফ্রিডম্যানের মন্তব্যটি সরকারের সত্যিই মাথায় রাখা দরকার। পৃথিবী বলতে শুরু করেছে, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের ভারতের কাছে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে, তালিবান আমলে আফগানিস্তান ফের জঙ্গি সংগঠনগুলির মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠবে এবং আফগান ভূমি থেকেই ফের পাকিস্তানের মদতে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ শুরু হবে। আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থান যে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলিকে উৎসাহিত করেনি, তা নয়। বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করেন এমন বহু কাশ্মীরিকেও তালিবানের পক্ষে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে। ফলে, এদিক থেকে পরিস্থিতি যে ভারতের
পক্ষে উদ্বেগের হবে না, তা মোটেই বলা যায় না।
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের অবস্থান কী হবে, সেটাও প্রশ্ন। পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা-ও দেখতে হবে ভারতকে। আফগানিস্তানে ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলির সৃষ্টি ও উত্থানের পিছনে যে পাকিস্তানের ভূমিকা সবচেয়ে বড়, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। সমানভাবে দায়ী আমেরিকাও। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পাকিস্তান ঠান্ডাযুদ্ধের পৃথিবীতে আমেরিকাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, আফগানিস্তান দিয়ে সোভিয়েত মদতে যে কমিউনিস্ট চিন্তাধারা দক্ষিণ এশিয়ার দিকে ধেয়ে আসছে, তাকে একমাত্র রুখতে পারে তারাই। কমিউনিস্টদের জুজু দেখিয়ে আমেরিকাকে পুরোমাত্রায় পাশে নিয়েছিল পাকিস্তান। ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্ট সরকার বাঁচাতে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়েছিল সোভিয়েত। আফগানিস্তানের মাটিতে আমেরিকার জঙ্গিদের মদত দেওয়ার সেটাই সূচনা।
আফগানিস্তানের সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উৎখাত করতে মুজাহিদদের সঙ্গে হাত মেলাতে সৌদি আরব থেকে ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন ততদিনে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় তার ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। আজ যে হাক্কানি নেটওয়ার্কের বাড়বাড়ন্তে ওয়াশিংটন থেকে নয়াদিল্লি উদ্বিগ্ন, সেই হাক্কানিরাও তখন আফগানিস্তানে যথেষ্ট সক্রিয়। হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন হাক্কানির সঙ্গে কান্দাহারের ঊষর অঞ্চলে মার্কিন কংগ্রেসের বিশিষ্ট সদস্য কাঁধে রকেট লঞ্চার নিয়ে সোভিয়েত হেলিকপ্টার উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, এই ছবি একসময় যথেষ্ট ছড়িয়েছিল। এখন সেই জালালউদ্দিন হাক্কানির ভাই খলিলউদ্দিনের মাথার দাম আমেরিকা ৩৫ কোটি টাকা ঘোষণা করেছে। জালালউদ্দিনের ছেলে আনাস কাতারের দোহায় তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে হামিদ কারজাইয়ের বৈঠকে অংশ নিচ্ছে দেখে এখন ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন বোধ করছে।
তালিবানকে (Taliban) যখন পাকিস্তান ‘ভাল মুজাহিদিন’ বলে শংসাপত্র দিত, তখন তাতে সবচেয়ে বড় সিলমোহর আমেরিকারই পড়ত। ঠান্ডাযুদ্ধের সেই দিনগুলিতে সোভিয়েতকে আফগানিস্তানের মাটিতে যে কোনও মূল্যে পর্যুদস্ত করাই ছিল একমাত্র মার্কিন লক্ষ্য। সন্ত্রাসবাদ তখন আমেরিকার কাছেও ভাল ছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার পর হয়তো আমেরিকা তার দৃষ্টি বদলাতে শুরু করে। ১৯৯২ সালে আফগানিস্তানের এই জঙ্গিরাই কমিউনিস্ট শাসক নাজিবুল্লাকে ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসি দিয়েছিল। আফগানিস্তানে মুজাহিদদের নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের সেই সূচনা। সেই লড়াই শুরু হওয়া পর্যন্ত আমেরিকাকে শোনা যায়নি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরব হতে। দুধ-কলা দিয়ে যে বিষাক্ত সাপ পাকিস্তানের সাহায্য নিয়ে আমেরিকা আফগানিস্তানে বড় করেছিল, তারা যখন ছোবল মারতে শুরু করল, তখন যে পরিস্থিতি ওয়াশিংটনের হাতের বাইরে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লাদেনকে বাগে আনতে না আনতেই সন্ত্রাসবাদ একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমেরিকার বুকের উপর।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমেরিকা তার ভুল নীতিগুলি অবশ্য কখনওই স্বীকার করে না। এবারও দেখা যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলির পক্ষে জোর সওয়াল চালিয়ে যাচ্ছেন। আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মার্কিন স্বপ্ন নয় শেষ হল, কিন্তু এখন পাকিস্তান সম্পর্কে কী হবে মার্কিন নীতি? আমেরিকার সঙ্গে যারা কুড়ি বছর ধরে আফগানিস্তানে ‘ওয়ার অন টেরর’-এ অংশ নিল, তারাই আবার তালিবানের স্রষ্টা ও সবচেয়ে বড় মদতদাতা। ইতিহাসের এত বড় পরিহাস হয়তো আর কিছু নয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালিবানের কাবুল দখল করার পর বলছেন, ‘দাসত্বের বিরুদ্ধে জয়। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি দিয়ে দেশ দখল রাখা যায় না।’ এটাই যদি ইমরানের মত হয়, তাহলে মার্কিন ‘ওয়ার অন টেরর’-এ এতদিন কেন অংশ নিয়েছিল তারা? এসব প্রশ্নের জবাব কূটনীতিতে মেলে না। তালিবানের সঙ্গে চিন ও রাশিয়ার অক্ষ তৈরি হতে পারে, এই জুজু দেখিয়ে পাকিস্তান হয়তো আগামী দিনেও আমেরিকাকে তাদের পাশেই রাখবে। পাকিস্তানের উঠোনে তালিবানের ‘বিষাক্ত সাপ’-এর সঙ্গে হয়তো ভবিষ্যতে মার্কিন ‘ওঝা’দের সহাবস্থান করতে দেখা যাবে।
[আরও পড়ুন: Afghanistan Crisis: দেশ চালাতে ১২ সদস্যের পরিষদ গড়ছে তালিবান, রয়েছেন হামিদ কারজাই ও মোল্লা বরাদর]
আফগান নাগরিকরা ভারতপ্রেমী। দেশ শাসন করতে গেলে এবার তালিবানকে সেকথাও খেয়াল রাখতে হবে। প্রাথমিক ইঙ্গিত সেইরকমই। ভারতের এই মুহূর্তে অ্যাডভান্টেজ এইটুকুই। এছাড়া অপেক্ষা করা ছাড়া ভারতের সামনে বিকল্প কিছু নেই। ফ্রিডম্যানের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিটি সকালের সঙ্গেই পরের সকালের পার্থক্য থাকে। প্রতিটি সকালই শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তনের ইঙ্গিত করে। ভারতকে এখন তাকিয়ে থাকতে হবে, আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহে নিজেদের পক্ষে ভারসাম্যের একটি সকালের লক্ষ্যে।