‘সবুজ পত্র’ সাময়িকীর সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষার পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে মোক্ষম একটি কথা লিখেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতর নয়, বাঙালির মুখে।’ তবে এ-ও মনে রাখতে হবে, বাঙালি যেমন নানা স্তরের বাংলা ভাষাও নানামুখো। মেলবন্ধন তাই জরুরি। কলমে বিশ্বজিৎ রায়
বাংলা ভাষা নিয়ে নানা কথা চলছে। সে-কথার দুই অভিমুখ। প্রথমত, কথা উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের বিদ্যালয় স্তরে বিষয় হিসাবে বাংলা ভাষাকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না, বাংলা পড়তেই হবে। দ্বিতীয় কথা, বাংলা পড়তে-শিখতে হবে। এর বৃহত্তর মানে হচ্ছে, বাংলা ভাষার মাধ্যমে ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান ইত্যাদি পড়ারও অধিকার থাকবে। অর্থাৎ, বিষয় ও মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষার গুরুত্ব স্বীকার করা হচ্ছে। এই দুই ‘অতি পুরাতন’ কথা। তবে কথা পুরনো হলেই তা বাতিল হয়ে যায় না, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিশেষ প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। বিশেষত এ তো কেবল ভাষার সওয়াল-জবাব নয়- এ আসলে এখন ভারতীয় গণতন্ত্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বৈশিষ্ট্য রক্ষার লড়াই। এই লড়াই করতে গেলে বাংলা ভাষার শরীরে নানারকম বাঙালির জবানকে কিন্তু প্রয়োজনমতো ধরতে পারা চাই।
একদা গত শতকের দ্বিতীয় দশকে ‘সবুজ পত্র’ সাময়িকীর সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষার পক্ষে যুক্তি সাজাতে গিয়ে মোক্ষম একটি কথা লিখেছিলেন, ‘বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতর নয়, বাঙালির মুখে।’ চৌধুরীমশাই নিজে ‘এলিট’ বাঙালির প্রতিনিধি, সর্বার্থেই। আর এ-কথাও এতদিন বাদে নির্মোহ ভঙ্গিতে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর চলিত ভাষা মূলত বাঙালি ভদ্রলোকের ড্রয়িং রুমের ভাষা। তাঁর লেখার ভাষায় ছোট ছোট মেধাবী বাক্যের দ্যুতি। ইতিউতি ইংরেজি শব্দের উঁকি। পড়লে বোঝা যায়, তর্কশীল ইংরেজি-ফরাসি জানা বাঙালি ভদ্রলোক আয়েশ করে আড্ডা দিচ্ছেন। এই বাংলায় অন্য বাঙালির ভাষার চিহ্ন কিন্তু খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরীর ভাব-ভাষায় দীক্ষিত ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘আমরা ও তাঁহারা’ রচনায় ইংরেজি না-জানা যে বাঙালির কথা লিখেছিলেন, তাঁদের জবান প্রামথ-বাংলায় মিলবে না। তাই চৌধুরীমশাই যুগান্তকারী যে-কথাটি লিখেছিলেন, সেই কথাটির ফলিত রূপ তাঁর বাংলা হয়ে ওঠেনি।
‘বাংলা ভাষার অস্তিত্ব প্রকৃতিবাদ অভিধানের ভিতর নয়, বাঙালির মুখে’– কথাটি গভীরভাবে সত্য। সেজন্যই যে অভিধান ভাল, তার নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়, মুখের পরিবর্তনশীল ও বিস্তারশীল শব্দভাণ্ডার সংস্করণ থেকে সংস্করণান্তরে গৃহীত হয়। আর-একটা কথা, বাঙালি কিন্তু একমুখো নয়, নানামুখো। এক বাংলা ভাষার নানা চেহারা। এক বাংলার মধ্যে ছত্রিশ জাতের শব্দ মিশে আছে। প্রয়োজনমতো সেই সমস্ত শব্দ নিয়েই বাংলা ভাষার চেহারা নির্মাণ করতে হবে। সংস্কৃত শব্দের ভাণ্ডারটিকেও মোটেই বর্জন করার দরকার নেই। বাঙালির মুখে অনেক সংস্কৃত শব্দ নানা চেহারায় বসবাস করে। তাদের স্বাগত জানানোর পথও প্রস্তুত করা উচিত।
[আরও পড়ুন: হঠাৎ রাহুলকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন কেন্দ্রের শাসকদল?]
এত কথা প্রমথ চৌধুরী ভাবেননি! এজন্য তাঁকে দোষ দেওয়ার কারণ নেই। তাঁর উদ্দেশ্য যে সাধু, সে-বিষয়ে সন্দেহ করা চলে না। তিনি বাংলা ভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘যে ভাষা আমরা সকলে জানি শুনি বুঝি, যে ভাষায় আমরা ভাবনা-চিন্তা সুখ-দুঃখ বিনা আয়াসে, বিনা ক্লেশে বহুকাল হতে প্রকাশ করে আসছি’, সেই ভাষা বঙ্গজদের বাংলা ভাষা। এই সংজ্ঞা বাংলা ভাষার স্বাধিকারের পক্ষে কথা বলেছে। সংস্কৃতের ছত্রছায়া ও পণ্ডিতি বাংলার মায়া ত্যাগ করে মুখের বাংলার স্বাধিকার ঘোষণা একদিক থেকে ভাষীদের গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েম করার চেষ্টা।
তবু একটা কিন্তু থেকেই যায়। এই সংজ্ঞায় ‘আমরা’ কারা? এটাকে তিনি খুব একটা বাজিয়ে দেখেননি। মনে মনে বাজিয়ে দেখলেও তাঁর লেখার বাংলায় সেই ভাবনার ছাপ পড়েনি। বরং তাঁর আগে বঙ্কিমচন্দ্র এ-বিষয়ে বড় পাকা ভাবনার কথা লিখেছিলেন। তাঁর অভিমত ছিল, ভাষা বিষয়ানুসারী, যে বিষয় ও ভাব আমরা প্রকাশ করতে চাই, সেই বিষয় ও ভাব অনুযায়ী ভাষার চেহারা হবে।
অর্থাৎ, ভাষা নানারকম। দ্বিতীয় যে-কথাটি বঙ্কিম মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তা অতীব উদারনৈতিক সিদ্ধান্ত। মনের ভাব স্পষ্ট করে প্রকাশ করার জন্য যে শব্দ প্রয়োজন সেই শব্দ গ্রহণ করতে হবে। গ্রাম্য, বুনো কোনও শব্দকেই বঙ্কিম বাদ দিতে চাননি, কেবল ‘অশ্লীল’ শব্দ সম্বন্ধে তাঁর আপত্তি ছিল। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ‘অশ্লীল’ বলতে তিনি যৌনাঙ্গ-বিষয়ক শব্দগুলির নিতান্ত নানারকম যৌনক্রিয়াত্মক প্রয়োগের বিরোধী। ‘গ্রাম্য’ ও ‘বুনো’– এই বর্গ নির্দেশের মধ্যে একালের ‘political correctness’ নেই বটে, কিন্তু শব্দগ্রহণের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র যে উদার, তা বোঝা যায়। এই উদারতা প্রমথ চৌধুরীর চলিত ভাষা প্রকল্পে তেমনভাবে ধরা পড়েনি। ধরা না পড়ার কারণ, তিনি সাহিত্য-সরস্বতীকে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষয়িত্রী বানাতে নারাজ। সাহিত্য-রুচিতে তিনি কলাকৈবল্যবাদী অর্থাৎ, সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য সাহিত্য রচনা– তাঁর সামাজিক ফল নিয়ে ততটা মাথা ঘামাতে তিনি নারাজ।
বাংলা ভাষায়, মুখের বাংলা ভাষায়, সুখ-দুঃখ প্রকাশের অধিকার তিনি সমাজ গঠনের জন্য চাননি, চেয়েছিলেন সাহিত্য-রচনার জন্য। তাই হয়তো নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে অন্য বাঙালির ভাষার চিহ্ন তঁার বাংলায় থাকে না। অন্যদিকে বঙ্কিম সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য হিসাবে সৌন্দর্য সৃষ্টি ও সামাজিক মঙ্গল– দুয়ের পক্ষপাতী। ‘বঙ্গদর্শন’, ‘সবুজ পত্র’-র নয়। কৃতবিদ্য (well-educated class) আর সাধারণ; এই দুই শ্রেণির মধ্যে সংযোগ স্থাপনে বঙ্কিম সচেষ্ট। সাহিত্য তাঁর মতে, সেই সংযোগের মাধ্যম। তাই বাংলা ভাষার শরীরে কৃতবিদ্য ও সাধারণ দুই শ্রেণির নানা বাঙালির শব্দ-চিহ্ন রেখে দেওয়ার তিনি পক্ষপাতী। লেখায় কতটা পেরেছেন, সে আলাদা কথা, তবে করতে চেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ যদিও প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজ পত্র’ সাময়িকীর গুরুত্বপূর্ণ লেখক ছিলেন, তবু চিন্তায় তিনি প্রমথ চৌধুরীর মতো কলাকৈবল্যবাদী ছিলেন না। বিশেষ করে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমেই তিনি তাঁর শিক্ষা-চিন্তাকে আটকে রাখেননি। ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বাইরে যে বৃহত্তর সমাজ, সেখানে শিক্ষার বিকিরণের জন্য বাংলা ভাষাকে তিনি প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পরিকল্পিত ‘বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ’ ও ‘লোকশিক্ষা’ গ্রন্থমালা পড়লে বোঝা যায়, এই দুই ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষা বিষয় ও মাধ্যম হিসাবে ভদ্রলোকের মুখের চলিতের সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। আর এটাই যে বাংলা ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার গ্রাহ্য মডেল, তা মেনে নিতেই হবে।
তাই এখন যখন আবার বাংলা ভাষাকে বিষয় ও মাধ্যম হিসাবে পড়াশোনার ক্ষেত্রে নতুন করে গুরুত্ব দেওয়ার কথা উঠছে তখন বাংলা ভাষার শরীরে নানা বাঙালির মুখের ভাষার নিশানকে রেখে দেওয়া চাই। ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়লে বোঝা যায় যে, বাঙালি ইংরেজি-শিক্ষিত ভদ্রলোক নয়, সে বাঙালির মুখের ভাষাও অসম্ভব প্রকাশক্ষম। রামকৃষ্ণদেবের মুখের ভাষার নানা নমুনা কথামৃতে আছে- তা যুক্তি, দর্শন, কল্পনাকে প্রকাশ করেছে অনবদ্য ভঙ্গিতে। দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলালের অন্যতম প্রিয়পাঠ্য ছিল কথামৃত। কমলকুমার মজুমদারের লেখা পড়লে বোঝা যায়, শব্দ-প্রয়োগে তিনি রামকৃষ্ণদেবের পক্ষপাতী। একসময় বাংলা পরিভাষা তৈরির জন্য প্রয়াত চিন্তাবিদ প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য হাত পাততে চেয়েছিলেন কারিগর-শ্রমিকদের মুখের ভাষার কাছে।
সংস্কৃত-লাঞ্ছিত বাংলার চেয়ে তাঁদের মুখের কাজের ভাষার জোর যে অনেক বেশি। বাংলা ভাষা যে এক বাঙালির নয়, নানা বাঙালির ভাষা– তা স্বীকার করে নিলেই বিষয় ও মাধ্যম হিসাবে এ ভাষা পোক্ত হবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক,
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
biswajitray1978@yahoo.com