‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগদান করেও সিপিএম ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থান নিয়ে চলতে চাইছে। তারা চাইছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকবে, অথচ জনগণকে বার্তা দেবে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থেকেও না থাকার। এই অবস্থায় বেশিদিন সিপিএমের পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব হবে না, তা বলা বাহুল্য। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী
রাজনৈতিক দ্বিচারিতা করতে গিয়ে জাঁতাকলে পড়েছে সিপিএম। এখন তাদের আম ও ছালা দুটোই চলে যাওয়ার উপক্রম। ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগদান করেও সিপিএম ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থান নিয়ে চলতে চাইছে। রাজনীতিতে এই ধরনের উদ্ভট অবস্থানের কোনও সুযোগ নেই। ভোটে যেখানে ‘ইন্ডিয়া’ ও বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র মধ্যে একটা স্পষ্ট মেরুকরণ হতে চলেছে, সেখানে মধ্যবর্তী কোনও অবস্থান গ্রহণও সম্ভব নয়। সিপিএম চাইছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকব, অথচ জনগণকে বার্তা দেব ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থেকেও না থাকার। সিপিএমের পক্ষে এই ধরনের নীতি মোটেও অভিনব বা বেনজির নয়। এর আগেও তারা এই ধরনের ‘জলে নামব কিন্তু বেণি ভেজাব না’ নীতি নিয়ে রাজনীতি করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে, অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে সিপিএমকে এই ধরনের নীতি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নই করে দেবে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
চূড়ান্ত সাংগঠনিক ব্যর্থতা এবং আদর্শগত দেউলিয়াপনা সিপিএম-কে বাংলার পরিষদীয় ও সংসদীয় রাজনীতিতে ইতিমধ্যে ‘শূন্য’-য় পরিণত করেছে। এখন তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে ভোটের অঙ্কে তাদের এবার এসইউসিআইয়ের মতো দলের পিছনে দাঁড় করিয়ে দেবে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যে সিপিএমের যে সাংগঠনিক হাল তৈরি হয়েছিল, তাতে গোড়াতেই টের পাওয়া গিয়েছিল যে, এই দলটি কালক্রমে বাংলা কংগ্রেসের মতো একটি অপ্রাসঙ্গিক দলে পরিণত হবে। এখন বহু রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মানুষের ধারণা সিপিএম তার চেয়েও খারাপ জায়গায় চলে যাবে। মাত্র দু’-দশক আগেও সিপিএম সম্পর্কে এমন ভাবনা অকল্পনীয় ছিল। বস্তুত, ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের পর সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সিপিএম নির্ণায়ক শক্তির জায়গায় ছিল। আদর্শগত গোঁড়ামি, বদলে যাওয়া বিশ্বকে বুঝতে না-চাওয়ার মানসিকতা ও প্রয়োজনমতো সুবিধাবাদী অবস্থান গ্রহণের পুরনো অভ্যাস সিপিএমকে আজ এই জায়গায় ঠেলে দিয়েছে।
[আরও পড়ুন: দমনমূলক পদক্ষেপ নয়, সংবাদমাধ্যমের গতিপথ হোক উন্মুক্ত]
সদ্য হওয়া ধূপগুড়ির উপনির্বাচনে সিপিএম সাড়ে ৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। সিপিএমের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তাদের ভোট গোটা রাজ্যে ২ শতাংশে নামিয়ে দিতে পারে বলে ভোট বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দুই শতাংশ ভোট নিয়ে এই রাজ্যে যে বেশিদিন সিপিএমের পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা সম্ভব হবে না, তা বলা বাহুল্য। কালক্রমে সিপিএম দক্ষিণ ভারতীয় একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে পরিচিতি পাবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তবে এক্ষেত্রেও সবটা নির্ভর করছে কেরলে সিপিএমের সাংগঠনিক শক্তির উপর। কেরলে যদি সিপিএম ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তাহলে সেখানে তাদের কী অবস্থা হবে, তা এখন থেকেই হলফ করে বলা যায় না।
কেরল ছাড়াও তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশে সিপিএমের দৃশ্যমানতা রয়েছে। সেটা রয়েছে মূলত বিভিন্ন সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মীদের ইউনিয়নের সূত্রে। এসব রাজ্যের ব্যাঙ্ক কর্মচারী, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মচারী বা সংগঠিত কলকারখানার কর্মীরা সাধারণভাবে বামপন্থী ইউনিয়নের ছাতার তলায় সংগঠিত। এই বামপন্থী কর্মীরাই এইসব রাজ্যে সিপিএমের সংগঠনের মূল ভিত্তি। তবে সেই সাংগঠনিক চেহারার সঙ্গে জনসমর্থন মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তামিলনাড়ু বা অন্ধ্রে সমস্ত গাঁ-গঞ্জে লাল পতাকা উড়তে দেখা গেলেও ভোটে তাদের কখনও ২ শতাংশ পেরতে লক্ষ করা যায় না। অর্থাৎ, জনমানসে সিপিএমের রাজনৈতিক প্রভাব নেই। কর্মচারী ও শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরা দলের কাঠামোটিকে শুধু
ধরে রেখেছেন।
এক সময় রাজীব গান্ধীর বিরোধিতা করার জন্য অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরেছিলেন জ্যোতি বসু। বাংলায় ঠিক একইরকমভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করার জন্য সিপিএম কর্মীরা বিজেপির হাত ধরতে আগ্রহী। সেই তাগিদ থেকেই সিপিএম পলিটবুরো ঘোষণা করেছে যে, ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকলেও সমন্বয় কমিটি-সহ কোনও কমিটিতে তারা থাকবে না। পলিটব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়া’ জোট হল আন্দোলন করার একটি মঞ্চ। এর কোনও সাংগঠনিক কাঠামো থাকা ঠিক নয়। বিভিন্ন দলের নেতারা সময়ে সময়ে বসে কিছু সভা-সমিতির দিন স্থির করবেন। সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত পলিটব্যুরো-র বিবৃতিতে লেখা হয়েছে, ‘সিপিআই (এম)-এর অবস্থান হল, এই মঞ্চের (ইন্ডিয়া) শরিক দলগুলির নেতৃবৃন্দই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এই মঞ্চের কোনও সাংগঠনিক কাঠামো থাকা উচিত নয়, তা এমন সিদ্ধান্তের পথে বাধা তৈরি করবে।’
সিপিএমের এই যুক্তি বিস্মিত করছে রাজনৈতিক মহলকে। জোটকে একটা সাংগঠনিক রূপ দেওয়া না গেলে বিজেপিকে লোকসভা ভোটে পরাস্ত করা যে কঠিন, তা বাকি সব রাজনৈতিক দল মনে করছে। কারণ, ‘ইন্ডিয়া’ জোটের একটা সাংগঠনিক কাঠামো নজরে এলেই এই জোট সম্পর্কে একটা বিশ্বাসযোগ্যতা মানুষের তৈরি হবে। এ-কথা ঠিক যে, ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA) জোটে এমন কতগুলি দল শামিল হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক আদর্শ পরস্পরের পরিপন্থী। এখানে এমন কয়েকটি দল রয়েছে, যারা রাজ্যস্তরে বরাবর পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। কিন্তু, বিজেপি সরকারকে হটানোর প্রয়োজনীয়তা থেকেই তারা এই জোটে শামিল হয়েছে। তাদের এই জোটে শামিল হওয়াটা শুধু পাটিগণিতের চোখে দেখলেই হবে না। এর একটা রসায়ন তৈরির প্রয়োজনও রয়েছে। সেই রসায়ন তৈরির প্রয়োজন থেকেই জোটের তিনটি বৈঠকের পর একটি সাংগঠনিক কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তিনটি বৈঠকে অংশ নেওয়ার পর সিপিএম হঠাৎ করে সেই সাংগঠনিক কাঠামোর বিরোধিতা শুরু করেছে।
তবে এ-কথাও ঠিক যে, সিপিএমের এই সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অবস্থান ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সামগ্রিকভাবে দুর্বল করবে না। কারণ, সিপিএমের রাজনৈতিক প্রভাব এখন শুধুমাত্র কেরলেই সীমাবদ্ধ। কেরলে লোকসভা আসনে মাত্র ২০টি আসন। সেখানে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম জোটের সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ জোটের সরাসরি লড়াই হবে। কেরলে বিজেপির অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে কেরলের এই ২০টি আসনের উপর দিল্লিতে কারা সরকার গড়বে, তা নির্ভর করবে না। মাত্র দু’টি লোকসভা আসনের ত্রিপুরাতে সিপিএম এখন কার্যত একটি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক শক্তি। পরিস্থিতি যা, বাংলায় সিপিএমের যেটুকু অস্তিত্ব আছে, লোকসভা ভোটের পর নিশ্চিত করে তাও আর থাকবে না। এমনিতেই সিপিএম-সহ বামপন্থীদের সামনে মতাদর্শগত দিক থেকে এক গভীর শূন্যতা। বামপন্থীরা আজকের বিশ্বে কোনও ‘বিকল্প’ পথের সন্ধান দিতে পারছে না। নতুন প্রজন্ম বামপন্থী রাজনীতিতে আকর্ষিত হচ্ছে না। যেখানে বামপন্থীরা এখনও ক্ষমতায় টিকে আছে, সেখানে ওই ক্ষমতার মধ্য দিয়ে তারা কিছু শক্তি ধরে রাখতে পেরেছে। একবার ক্ষমতা থেকে সরে গেলে বামপন্থীরা শূন্যে পরিণত হচ্ছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মধ্যে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করলে বামপন্থীরা হয়তো বা কিছু মানুষের বিশ্বাস অর্জনে জায়গায় যেতে পারতেন। কিন্তু ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ অবস্থান তাদের আরও মহাশূন্যের দিকে ঠেলে দেবে বলে বোঝা যাচ্ছে।