shono
Advertisement

নতুন ভারতে কোনও স্থান নেই দ্বিতীয় পছন্দ বা বিকল্পের

এই নয়া ভারত সংসদীয় অধিবেশনের প্রাক্কালে ‘অসংসদীয় শব্দাবলি’-র তালিকা প্রকাশ করে।
Posted: 04:24 PM Jul 20, 2022Updated: 04:24 PM Jul 20, 2022

ভণিতাহীনভাবে শাসক বোঝাচ্ছে, সেই রাজত্ব, যা অদূর ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মানসিকতার প্রতিফলন ঘটবে। এবং সেটাই হবে প্রকৃত ‘ন্যায়’। দুর্বিনীতদের তাই বুঝিয়ে দিতে হবে, হয় এই সামগ্রিকতার অংশ হও, নাহলে নিপাত যাও। নতুন ভারতে ‘দ্বিতীয়’ পছন্দ বা বিকল্পের কোনও অবস্থান নেই। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

 

টনাগুলো পরপর ঘটে যাচ্ছে। সাদা চোখে দেখলে বিচ্ছিন্ন মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতে্যকটি ঘটনাই একে-অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এক সুতোয় গাঁথা। সামগ্রিক দর্শন ও রাজনৈতিক বীক্ষণ বোঝায়, এগুলো ঘটছে না। ঘটানো হচ্ছে। এক বিশেষ বিন্দুতে পৌঁছনোর প্রচেষ্টা। মননশীল নিরীক্ষণ বুঝিয়ে দেয় এতদ্দ্বারা শাসক দেশে কোন ‘আদর্শ রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। সেই রাজত্ব, যেখানে প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত। সবাই একদর্শী ও সমদর্শী। আমি, তুমি, আমরা বা তোমরা প্রত্যেকেই সেই সমগ্রের অংশ। কেউ বিচ্ছিন্ন নই। সেই রাজত্বে ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীগত পরিসর বলে কিছু নেই। তোমরা-আমরা সবাই মিলে সামগ্রিকতা। ভণিতাহীনভাবে শাসক বোঝাচ্ছে, সেই রাজত্ব, যা অদূর ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মানসিকতার প্রতিফলন ঘটবে এবং সেটাই হবে প্রকৃত ‘ন্যায়’। দুর্বিনীতদের তাই বুঝিয়ে দিতে হবে, হয় এই সামগ্রিকতার অংশ হও, নাহলে নিপাত যাও। নতুন ভারতে ‘দ্বিতীয়’ পছন্দ বা বিকল্পের কোনও অবস্থান নেই।

হালের দু’টি ঘটনার দিকে দৃক্‌পাত করা যাক। দুই চরিত্রের একজন দেশের প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি, অন্যজন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেল। হামিদ আনসারির প্রতি বিজেপি কোনও দিনই সদয় ছিল না। কারণ, প্রথমত, তিনি মুসলমান। দ্বিতীয়ত, তিনি কংগ্রেস আমলে নিযুক্ত উপরাষ্ট্রপতি। তৃতীয়ত, রাজ্যসভা পরিচালনায় বিজেপির অহেতুক বায়নাক্কাকে প্রশ্রয় দেননি। চতুর্থত, সামগ্রিকতার অংশ না হয়ে বহুত্ববাদের পূজারি থেকেছেন। তাঁর বিদায়ক্ষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তাই ব্যঙ্গ করে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘এবার থেকে আপনি নিজস্ব বিচারধারা অনুযায়ী চলনে-বলনে স্বাধীন হয়ে যাবেন।’

[আরও পড়ুন: অ্যাবেনোমিক্সের তির, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে-কে মনে রাখবে ভবিষ্যৎ]

সেই আনসারিকে বিজেপি এখন ‘পাকিস্তানের চর, আইএসআই-এর ‘দোসর’ বলে অভিহিত করছে। বিজেপির মুখপাত্রর দাবি, উপরাষ্ট্রপতি থাকাকালীন পাকিস্তানি সাংবাদিক নুসরত মির্জাকে তিনি শুধু ভারতে আমন্ত্রণই জানাননি, তাঁর মারফত দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল তথ্যও পাচার করেছেন।

কোন তথ্যের ভিত্তিতে এত বড় অভিযোগ? বিজেপি দাখিল করেছে সেই সম্মেলনের এক ছবি, যাতে যোগ দিতে ওই পাকিস্তানি সাংবাদিক ভারতে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে যিনি নিজেকে ‘পাকিস্তানি চর’ বলে দাবি করেছিলেন। ছবিতে ওই সাংবাদিক-সহ আরও অনেকের সঙ্গে হামিদ আনসারিকে এক ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে। অভিযোগ খণ্ডন করে আনসারি বলেছেন, সম্মেলনে কোনও প্রতিনিধিকে তিনি আমন্ত্রণ জানাননি। প্রোটোকল অনুযায়ী আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বিদেশমন্ত্রক। বিজেপির অভিযোগ সম্পর্কে আনসারির মন্তব্য, ‘নিতান্তই বিরক্তিকর ঘ্যানঘেনে এক মিথ্যাচার।’

বিজেপিও ভালই জানে, এ দাবি অসত্য। কিন্তু তবু কেন এই একঘেয়ে মিথ্যাচার? এর উত্তরেই নিহিত মূল নকশা। সেই নকশা, যা জাতীয়তাবাদী সচেতন মুসলমানদেরও দেশদ্রোহী প্রতিপন্নে সক্রিয়। বিজেপি বিলক্ষণ জানে, গ্রুপ ছবি কোনও প্রমাণের অকাট্য দলিল হতে পারে না। হলে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও অপরাধী। ঋণখেলাপি, দেশত্যাগী ও আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত মেহুল চোক্‌সির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি বহুচর্চিত। এই সেদিন মোদি-শাহ’র সঙ্গে হাসি মুখের ছবি প্রকাশ করেছেন আর এক দেশত্যাগী আর্থিক কেলেঙ্কারির খলনায়ক ললিত মোদি। উদয়পুরে দর্জি খুনের আসামির ছবি দেখা গিয়েছে স্থানীয় বিজেপি নেতাদের সঙ্গে। শাসকদলীয় নেতাদের সঙ্গে ছবি রয়েছে কাশ্মীরে ধৃত জঙ্গিরও। আনসারি অপরাধী হলে একই যুক্তিতে মোদি-শাহ-সহ বিজেপির নেতারাও নিরপরাধ নন। তবু তাঁরা এই মিথ্যাচারে রাশ টানতে নারাজ। এটাই তাঁদের ‘ব্রেড অ্যান্ড বাটার’ রাজনীতি। হোক অসত্য, তবু প্রচার চাই লাগামহীন। ‘হিন্দুস্তানি’ মন বিষাক্ত করে তোলো, যাতে যুক্তি ও তর্কের পরিসরটুকু পর্যন্ত সৃষ্টি না হয়। ক্ষমতায় গেড়ে বসে ‘৮০-২০’ লড়াইয়ের যে-প্রেক্ষাপট তাঁরা সচেতনভাবে তৈরি করেছেন; যে-লড়াইয়ে নির্বিচারে ব্যবহৃত হচ্ছে বুলডোজার; নাম ও পোশাক হচ্ছে অবাধ ধরপাকড়ের একমাত্র মাপকাঠি; সেই ন্যারেটিভকে সার্থকতর করে তুলতে হামিদ আনসারিরা উপযুক্ত চরিত্র। বড় মাথায় আঘাত করে বুঝিয়ে দেওয়া, তুমি যেই হও, নতুন ভারতে পার পাবে না।

গুজরাট দাঙ্গার নেপথ্য ‘কুচক্রী’ হিসাবে মৃত আহমেদ প্যাটেলকে টেনে আনাও ওই ছকেরই অঙ্গ। সুপ্রিম কোর্টের ‘অনাবশ্যক’ মন্তব্যে বলীয়ান বিজেপি তিস্তা শেতলাবাদকে ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ দিতে কালক্ষেপ করেনি। গুজরাটি পুলিশের নব উদ্যম বিজেপির রাজনৈতিক মস্তিষ্ককে নতুনভাবে সক্রিয় করে তুলেছে। আহমেদ প্যাটেলের সঙ্গে তাই তারা টেনে আনতে দ্বিধা করেনি সোনিয়া গান্ধীকেও। তদন্তকারী দলের সরাসরি অভিযোগ, আহমেদ প্যাটেল ৩০ লাখ টাকা তিস্তাকে দিয়েছিলেন রাজ্যের শাসক দল বিজেপির ‘দাঙ্গা-চরিত্র’ উদ্‌ঘাটনে। সেই টাকা প্যাটেলের ছিল না। ওটা ছিল সোনিয়ার দান! সোনিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা আহমেদ প্যাটেল ছিলেন নিছক যন্ত্র। যন্ত্রী কংগ্রেস সভানেত্রী স্বয়ং। অভিযোগের টাইমিংটা দেখুন। গুজরাট দাঙ্গায় সোনিয়াকে টেনে নামানো হচ্ছে সেই সময়, যখন ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’ মামলায় কংগ্রেস সভানেত্রীর ইডি—তে হাজিরার দিন সমাগত। রাহুল গান্ধীকে পাঁচ দিনে ৫০ ঘণ্টা জেরা করা হয়েছে। সোনিয়ার কপালেও তেমনই কিছু লেখা আছে। অথচ বিজেপি আমলেই এই ইডি ‘কিছু গড়বড় নেই’ বলে মামলার ফাইল বন্ধ করে দিয়েছিল। সারার্থ? সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানো যে, শীর্ষ নেতাদের যদি এই হাল করতে পারি, ভাবো, তোমরা তো তবে কোন ছার!

নেকনজরে না-থাকারা যে নখরা, নূপুর শর্মা ঘটনাবলি তা দেখিয়ে দিচ্ছে। অপরাধী এখনও অধরা, অথচ জেলে পচছেন মহম্মদ জুবেইর, যাঁর কষ্টিপাথর সত্য-মিথ্যার যাচাই করে চলেছে সাংবাদিকতার ধর্ম মেনে। বিচারব্যবস্থাকে কোথায় টেনে নামানো হয়েছে এই মামলা তার জ্বলজ্বলে নমুনা। সম্প্রীতির পক্ষে ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’ বলে যে-মন্তব্যর জন্য জুবেইরের বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা সাজানো হয়েছে, তাতে গত চার বছরে কোথাও উত্তেজনার ফুলকিও দেখা যায়নি। সুপ্রিম কোর্ট আইনের এই প্রবণতাকে ‘ভিশিয়াস সাইকেল’ বললেও নিম্ন আদালত জুবেইরের জামিন অগ্রাহ্য করে চলেছে। ভোগান্তি কার? ওই ২০ শতাংশের। এটাই নতুন ভারত।

এই নয়া ভারত সংসদীয় অধিবেশনের প্রাক্কালে ‘অসংসদীয় শব্দাবলি’-র তালিকা প্রকাশ করে। তাতে শাসকের চরিত্র বেমক্কা উদ্‌ঘাটিত হওয়ায় বিচলিত স্পিকার বলেন, কোনও শব্দই নাকি ‘নিষিদ্ধ’ করা হয়নি। প্রশ্ন করুন, নিষিদ্ধ যদি না-ই হবে, তাহলে ‘অসংসদীয়’ বিবেচনায় শব্দগুলো কার্যবিবরণী থেকে বাদ কেন? উত্তর পাবেন না। প্রশ্ন করার অধিকারটুকুই যে হরণ হয়ে গিয়েছে। নতুন ভারতের এটাই দস্তুর।

তবু এরই মাঝে মহুয়া মৈত্র-র মতো ‘দুর্বিনীত’ কেউ কেউ পানাপুকুরে পদ্মের মতো জেগে থাকেন। অসংসদীয় ‘যৌন হয়রানি’-র প্রতিশব্দ হিসাবে তিনি ‘মিস্টার গগৈ’-কে বেছে নিতে দ্বিধা করেন না। সমাজে কে কীভাবে পরিচিত হবেন, নির্ভর করে ব্যক্তির উপরই। ‘মিস্টার গগৈ’ ধিক্কৃত ও নিন্দিত কৃতকর্মের জন্যই। রাষ্ট্রপতিকেও শুনতে হয়েছে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের অমোঘ প্রশ্ন, “কোন মিস্টার গগৈ ঠিক? প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে যিনি ‘গণতন্ত্র হুমকির মুখে’ মন্তব্য করেছিলেন, না কি প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন যিনি নজির রেখে গিয়েছেন?”

গণতন্ত্র, সংবিধান ও আইনের শাসনের কফিনে নিত্যনতুন পেরেক পোঁতা হচ্ছে। সাম্প্রতিকতম সংস্করণ নতুন ‘অশোক স্তম্ভ’। পশুরাজের পেশিবহুল শরীর, কুঞ্চিত ললাটের ক্রুদ্ধ চাহনি, শানিত দাঁতের শাসানি, চাপা হুংকার ও আগ্রাসন উত্তিষ্ঠত জাগ্রত ভারতের নব বার্তা। ভয়। ভয়ে ভালবাসো। ভয়ে ভয়ে বঁাচতে শেখো। ভয়ে গুটিয়ে থাকো। হয় ভক্তচিত্তের প্রশ্নহীন আনুগত্য, নয়তো সভয়ে সমর্পণ। নতুন ভারতের নববিধান বিকল্পহীন। নবনির্মিত রাষ্ট্রীয় প্রতীকে শাসক-চরিত্রের এই প্রতিফলন নতুন ভারতের ‘লাস্ট স্টেটমেন্ট’।

[আরও পড়ুন: ‘মোদির অশোকস্তম্ভ যেন হিংসার ইঙ্গিত দেয়, সত্য ও শান্তির বাণী মাথায় আসে না’]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement